ছবি : সংগৃহীত

জরুরি কাজে গিয়েছিলাম কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায়। কী সুন্দর টলটলে জল! যেদিকে চোখ যায় শুধু জল আর জল। বিস্তৃত জলরাশি কী অপরূপ মহিমা নিয়ে বিছিয়ে আছে হাওরের বুক জুড়ে। কোথাও কোথাও ছোট্ট দ্বীপের মতো জেগে আছে খণ্ড খণ্ড সবুজ।

গরু-মহিষের দল হাওর জলে ভাসিয়ে দিয়ে ছোট ডিঙি নৌকায় করে কৃষাণ-রাখাল যাচ্ছে তাদের পাশে পাশে। অথৈ জলে দীর্ঘ পথ সাঁতার কেটে গরু-মহিষেরা ঘাস খেতে যাচ্ছে। হাওরে ভাসছে অসংখ্য ছোট ছোট ডিঙি নৌকা।

মাছ মারার চেষ্টায় লিপ্ত সৌখিন মাছ শিকারি। বাতাস বইছে হুহু করে। কেমন যেন মন উদাস করা পরিবেশ। একটু পর পর আসছে ইঞ্জিনের নৌকা। তার ভট ভট শব্দ শোনা যায় অনেক দূর থেকে। দেখা মেলে দুয়েকটি স্পিডবোটও। শাঁ শাঁ শব্দ তুলে জল কেটে তীব্র বেগে এগিয়ে যায় এই যান্ত্রিক জলযান।

আরও পড়ুন >>> পাহাড়ি ঢলে ভাঙল বাঁধ : ফসল ডুবির দায় কার? 

ইঞ্জিন নৌকা কিংবা স্পিডবোট চলে গেলেই আবার সব সুনসান নীরব। শুধু বাতাসের আওয়াজ। আর জলের বয়ে চলার বিজবিজ শব্দ। মাথার ওপর ওড়ে জীবনানন্দের শঙ্খচিল, সাদা বক। ভাসমান জলজ উদ্ভিদ কিংবা কচুরিপানার শরীরে অলস বসে থাকে দুয়েকটা পানকৌড়ি।

শ্যাওলা রং শরীরের কানিবকের দেখাও মেলে আশপাশে চোখ মেললে। কী সুন্দর! কী যে মনোরম সুন্দর সবকিছু। শহুরে গতি এই হাওরে যেন পথ হারিয়েছে। এখানে সবকিছুই অপার্থিব মন্থর সুন্দর। দেখে খুবই ভালো রাগে। মনের মাঝে পুলক নয়, কেমন যেন বিরহ জাগে।

শুকনা মৌসুমে হাওরের জেগে ওঠা ভূমিতে পায়ে হেঁটে চলার কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু সময়ের পথ বেয়ে এক সময় পরিবর্তন আসে সেই ধারায়। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে হাওরে। নাও, পাও সব গুটিয়ে ফেলার প্রয়াসে হাওরের বুক কেটে তৈরি হয় সড়ক...

তবে এই অপরূপ আনন্দের মাঝেও লুকিয়ে আছে ভয়ংকর বেদনার গল্প। তীব্র মন খারাপের কাহন। হাওর এলাকায় এক সময় প্রচলিত ছিল—‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও।’ অর্থাৎ বর্ষার সময়ে এই এলাকার হাওর বাওর সব জলের নিচে চলে গেলে নৌকাই ছিল চলাচলের একমাত্র বাহন।

শুকনা মৌসুমে হাওরের জেগে ওঠা ভূমিতে পায়ে হেঁটে চলার কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু সময়ের পথ বেয়ে এক সময় পরিবর্তন আসে সেই ধারায়। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে হাওরে। নাও, পাও সব গুটিয়ে ফেলার প্রয়াসে হাওরের বুক কেটে তৈরি হয় সড়ক। অলওয়েদার সড়ক হাওরবাসীর মনে খুশির বান আনে। দেশজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল উন্নয়নের অংশীদার হতে পেরে হাওরবাসী গর্বে ভাসে। আনন্দে হাসে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর না যেতেই এই সড়ক এখন হাওরবাসীর গলার কাঁটা?

ইটনা, মিঠামইন এবং অষ্টগ্রাম উপজেলা সংযুক্ত করে হাওরের পেটের মাঝে যখন সড়ক নির্মাণ করা হয়, তখন এটির ৩০ কিংবা ৩৫ ভাগ এলিভেটেড কিংবা উড়ন্ত সড়ক করার পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেই পরামর্শে তখন কান দেয়নি কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন >>> ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ : বঙ্গোপসাগরে নয়, ঝড় তুলছে কফির কাপে

এখন আবার হাওরের সব সড়ক এলিভেটেড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা! তাহলে লাভের লাভ কী হলো? মানুষের শ্রমে ঘামের টাকায় তাহলে এই ধরনের অপরিকল্পিত উন্নয়নের মানে কি? কে দেবে উত্তর? উত্তর দেওয়ার কেউ কি আছেন এখানে?

হাওরে যখন ভাসছিলাম যান্ত্রিক যানে, সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় এক সংবাদকর্মী। জলের নিচে তলিয়ে থাকা অলওয়েদার সড়ক পেরোচ্ছিলাম মনে হয় তখন আমরা। তো, সেই সংবাদকর্মী তখন বিড়বিড় করে বলছেন—‘হাওরের পানিকে আটকালে সে অভিশাপ দেবেই। পানির অভিশাপ বড় ভয়ংকর!’

বৃহত্তর সিলেট, ময়মনসিংহ এবং কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে ছোট বড় মিলিয়ে ৩৭টির মতো হাওর রয়েছে। বর্ষাকালে এগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত হয়ে মিঠাপানির সাগরে পরিণত হয়। ফলে একটি অঞ্চলে কিংবা কয়েকটি হাওরে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে তার প্রভাব অন্য অঞ্চলে পড়তে বাধ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজারসহ এই অঞ্চলের বন্যার পেছনে কিশোরগঞ্জের হাওরের পানি সরাসরি দায়ী না হলেও পরোক্ষ প্রভাব তো আছেই।

বন্যায় ভাসছে উত্তরের বেশ কয়েকটি জেলা। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট কয়েকটি জেলার অবস্থা বেশ খারাপ। পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে এসব অঞ্চলে। তিস্তার তীব্র ভাঙনে এই অঞ্চলের অবস্থা শোচনীয়। ফসলি জমিতো যাচ্ছেই বসতবাড়ি দোকানপাট বাজারঘাটও যাচ্ছে তিস্তার পেটে।

প্রতি বছরই বন্যা হয় এসব অঞ্চলে। এর কারণ হলো এই সময়টায় উজানের দেশের সবগুলো বাঁধ খুলে দেয়। হু হু করে আসতে থাকে উজানের ঢল। প্লাবিত জনপদের সঙ্গে ভাসতে থাকে মানুষের জীবন জীবিকা তিলেতিলে গড়ে ওঠা স্বপ্ন-সবই। অথচ সরকারের পর সরকার আসে, যায়। তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি আর হয় না।

প্রতি বছরই বন্যা হয় এসব অঞ্চলে। এর কারণ হলো এই সময়টায় উজানের দেশের সবগুলো বাঁধ খুলে দেয়। হু হু করে আসতে থাকে উজানের ঢল। প্লাবিত জনপদের সঙ্গে ভাসতে থাকে মানুষের জীবন জীবিকা তিলেতিলে গড়ে ওঠা স্বপ্ন-সবই...

এখনো হয়নি। শুধু আশ্বাসের বাণী মিলছে বছর পর বছর ধরে। হ্যাঁ, পৃথিবী জুড়ে উজানের দেশ ভাটির দেশের সঙ্গে এক ধরনের বৈষম্য করে থাকে। তাই বলে এতটা? বর্ষার সময় তারা পানি ছেড়ে দেয়-প্লাবিত হয় আমাদের বিশাল এলাকা। আবার ফসলের ফলানোর সময় পানি আটকে রেখে প্রায় মরুভূমি বানিয়ে ফেলে আমাদের উত্তরাঞ্চল।

আরও পড়ুন >>> কেন বারবার দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে? 

আম, ইলিশ, জামদানি পাঠানোর সংস্কৃতি ভালো। বন্ধুত্ব এগিয়ে নেওয়ার অব্যাহত চেষ্টার প্রক্রিয়ায় দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু অধিকার কড়ায় কণ্ডায় বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে নমনীয় হওয়া মোটেও কাম্য নয়।

বন্যা হচ্ছে পদ্মা পাড়ের বিভিন্ন জেলায়ও। শস্যবতী জলবতী পদ্মা সর্বগ্রাসী রূপে দেখা দিচ্ছে রাজবাড়ির গোয়ালন্দসহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দখলে দূষণে আমাদের নদীগুলো মৃতপ্রায়।

কলকারখানার বর্জ্য মিশে নদীর জল আলকাতরার রূপ নিয়েছে বিভিন্ন জায়গায় বহু আগেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশ-গালভরা এই বুলি এখন মানুষ ভুলতে বসেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও যে বিভিন্ন জেলায় স্রোতস্বিনী নদী ছিল, ভরা জলের যৌবন ছিল আমাদের নদীগুলোর-সেই দৃশ্য আজ কোথায়?

সবই তো উধাও মানুষের নির্বিচার লোভের কাছে। অতএব এখনো সময় আছে-নদীগুলো বাঁচান। লোভ কমান। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো একটু উদ্যোগী হোন। উপরে বলা কথাটা আবারও বলি-জলের অভিশাপ বড় ভয়ংকর। জলকে আটকে দিলে সে অভিশাপ দেবেই।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টেলিভিশন