১০৪ নম্বর সেইন্ট স্টিফেন্স রোডে যথাসম্ভব কম ভাড়ায় উপ-ভাড়াটে হিসেবে বাস করি। বাসার ঠিক সামনের ৩০ ফুট প্রশস্ত রাস্তাটি পেরোলেই সেইন্ট স্টিফেন্স প্রাইমারি স্কুল। আমার ছেলে এই স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রদের একজন। দুষ্ট ছেলের বাবাদের স্কুলে ডাক পড়ে। আমারও পড়ল। এ কথা সে কথার পর তার টিচার বললেন, যদি খুব জরুরি কাজ না থাকে ৩টার সময় আবার স্কুলের এসো, মাত্র ৩০ মিনিটের জন্য, আমাদের নতুন এমপি স্টিফেন টিম আসবেন, তিনি এই এলাকার মানুষের সমস্যার কথা শুনবেন। সমাধান করতে চেষ্টা করবেন।

আমি বললাম, আমার তো কোনো সমস্যা নেই। তিনি বললেন, আছে। স্কুলের মাঠটা যদি বড় হতো তাহলে তোমার ছেলের দুষ্টুমিটা মাঠই শোষণ করে নিত। ক্লাসরুমে করার মতো দুষ্টুমি আর এনার্জি থাকত না। স্কুলের সীমানায় খালি জায়গা আছে, স্টিফেন চেষ্টা করলে সেখান থেকে কিছুটা জায়গা স্কুলের সঙ্গে যোগ করতে পারেন, তাতে মাঠটা বড় হবে।
কাজেই ছেলের স্বার্থ বিবেচনা করে রাস্তা পেরিয়ে তিনটায় হাজির হলাম। স্টিফেন টিম আগেই এসেছেন। নির্বাচনের আগে ডাকযোগে স্টিফেন টিমের চিঠি পেয়েছি। তিনি শ্রমিক দলের হয়ে নিউহাম নর্থ-ওয়েস্ট থেকে নির্বাচন করছেন। আমি যদি তাকে উপযুক্ত মনে করি তাকে যেন ভোট দিই। আমি স্বল্প সময়ের জন্য বিলেতবাসী বটে, কিন্তু ভোটার নই। তবে ভোটের কৌতূহল তো আছে। নির্বাচনে একটি বাড়ির দেয়ালে দুটি পোস্টার বাদে অন্তত দশ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে কোথায় কারো পোস্টার চোখে পড়েনি। যে দুটি পোস্টার দেখেছি তাতে কোনো ছবি নেই। কেবল লেখা আছে, ভোট ফর স্টিফেন টিম, প্রচারণায়: লেবার পার্টি, নিউহাম।

একটি বড় শক্তির স্নেহছায়া ও আশীর্বাদ যদি না থাকে ভোট অর্ধেক কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তো থাকবেই- আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যদি সুষ্ঠু ভোটও হয় সেক্ষেত্রেও বলা হয় মার্কাটা পেলেই হলো...

কথা বলার বিলেতি কায়দা কিছুটা রপ্ত করেছি বলেই সাহসের সঙ্গে বললাম, দেয়ালে লাগানো আপনার দুটো পোস্টার দেখলাম। তিনি বললেন, তিনিও দেখেছেন। এভাবে পোস্টার লাগানো তিনি অ্যাপ্রুভ করেন না। কিন্তু তার কয়েকজন অতিভক্ত বাংলাদেশি সমর্থক আছেন, কাজটা তাদের।  যে বাড়ির দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো আছে সেটিও তাদের একজনের বাড়ি। তিনি একাধিকবার দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বললেন এটা দেখে তোমার নিশ্চয়ই খারাপ লেগেছে। আমার অন্যান্য ভোটারেরও খারাপ লাগতে পারে। এগুলো আমিই তুলে নেব।

নব্বইয়ের দশকে ডাকযোগে আসা নির্বাচন প্রার্থীর আবেদন পড়েছি, কিন্তু রাস্তাঘাটে দেয়ালে দেয়ালে চাররঙা হোক কি কালো আর ধলা হোক, কোনো পোস্টারই চোখে পড়েনি।
স্টিফেন টিম ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের ছাত্র। প্রযুক্তি খাতে পনের বছর চাকরি করার পর রাজনীতিতে এসেছেন, তার নির্বাচন এলাকায় ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ভোটাররা ভোট দিতে কার্পণ্য করেন না। তিনি টনি ব্লেয়ার এবং গর্ডন ব্রাউনের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছিলেন।

২০১০ সালের একদিন তিনি কনস্টিটিউয়েন্সি সার্জারি করছিলেন— এটা কাটাছেঁড়া কিছু নয়, নিজ নির্বাচনী এলাকার লোকজনের অভাব শুনছিলেন। ব্যবস্থাপত্র ও দিচ্ছিলেন।
সেদিনের দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেধাবী ছাত্রী রোশনারা চৌধুরী। করমর্দন করতে তিনি যখন হাত বাড়ালেন, রোশনারা তার পেটে ছয় ইঞ্চি ছুরি ঢুকিয়ে দিলেন। পরপর দু’বার। রোশনারা ধরাও পড়লেন। খোলামেলাভাবে কারণটাও বলল। আমেরিকার সঙ্গে ইরাকে ব্রিটিশ বাহিনীর আক্রমণ সমর্থন করে স্টিফেন টিম ভোট দিয়েছেন। সুতরাং মৃত্যুই তার প্রাপ্য। কিন্তু তিনি সেরে উঠেছেন, রোশনারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে এখন কারাবাস করছেন।

আমার বিষয় স্টিফেন টিমও নন, রোশনারাও নন। আমার বিষয় নির্বাচনের পোস্টার। বিলেতে আমি প্রার্থীর ছবি সংবলিত পোস্টার দেখিনি, দেখেছি ডাকে পাঠানো মুদ্রিত এক পৃষ্ঠার চিঠি।

ছাপাখানা এবং কাগজওয়ালাকে কিছু লাভ করিয়ে দেওয়া ছাড়া পোস্টারের কি দরকার। আমাদের দেশে ভোটের যে সংস্কৃতি তাতে পোস্টার দেখে মুগ্ধ হয়ে কেউ ভোট দিয়েছে এ পর্যন্ত শুনিনি। পোস্টার ভোটার টানে না। তবুও আমি পোস্টারের বিপক্ষে নই। যে নির্বাচন কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছে, সে নির্বাচনে প্রার্থীদের এক-রঙা পোস্টার দেখছি। অধিকাংশ পোস্টারে কেবল প্রার্থীর ছবিই দেখেছি, আর মার্কার ছবি। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে পোস্টারের শীর্ষে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখেছি, মাঝখানে প্রার্থীর ছবি, নৌকার ছবি।

এটাও স্বাভাবিক মনে হয়েছে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর আলোতে দেশ স্বাধীন হয়েছে সেখানে তার দলের তুলনামূলকভাবে কম আলোকিত প্রার্থীরা তার আলো ধার নিয়ে নির্বাচন করতেই পারেন। সূর্য ছাড়া চাঁদও তো অন্ধকার। শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত যেহেতু বঙ্গবন্ধুকেই নিতে হবে, ভোটটা প্রকারান্তরে তার নামে দেওয়াটাই উত্তম। আর সবাই কমবেশি রাবার স্ট্যাম্প।

আমরা উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, গতিময় একটি দ্বিতীয় অর্ধশতক চাই, যে সময় সংসদ সদস্যরা সিকি কিংবা দু’আনি মানুষ হবেন না, হবেন ষোলো আনা মানুষ।

টাগবোট যেমন ইঞ্জিনবিহীন বড় বোটকে টেনে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, ব্যাপারটা তেমনই। আরিচা-নগরবাড়ি কিংবা আরিচা-দৌলতদিয়ায় গাড়িভর্তি ফেরি একসময় টাগবোট টেনে নিয়ে যেত। টেনে নিয়ে আসত। টাগবোট না থাকলে সেই বোট বাস্তবিকই প্রতিবন্ধী।

একটি বড় শক্তির স্নেহছায়া ও আশীর্বাদ যদি না থাকে ভোট অর্ধেক কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তো থাকবেই- আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যদি সুষ্ঠু ভোটও হয় সেক্ষেত্রেও বলা হয় মার্কাটা পেলেই হলো, তারপর কলাগাছ দাঁড় করিয়ে দিলেও সমস্যা নেই। সঠিক মার্কা পেয়ে বহু বিচিত্র প্রার্থী (কেউই কলাগাছের মতো নিঃস্পৃহ নন) সাংসদ হয়েছেন।

তবুও ধরে নিই পোস্টারের আশীর্বাদ দাতার ছবির গুরুত্ব অর্ধেক আর প্রার্থীর গুরুত্ব অর্ধেক। সেক্ষেত্রে প্রার্থী ষোলআনার যোগ্যতা দাবি করতে পারে না, পারেন বড়জোর আটখানার। ফিফটি পার্সেন্ট।

১৯৯১ পরবর্তী সময়টাতে নিজেদের সংসদীয় গণতন্ত্রী বলে আমরা যথেষ্ট বড়াই করে থাকি। এ সময় পোস্টারে যোগ হয় আরও একটি ছবি। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং দলীয় প্রার্থী অন্যদিকে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া এবং দলীয় প্রার্থী।

তাত্ত্বিক গণিতের হিসাবে ভোটার আকর্ষণের শক্তি ভাগাভাগি করলে প্রার্থীর শক্তি দাঁড়ায় ৩৩.৩৩ ভাগ। পরবর্তী সময় কোথাও যোগ হয় তাদেরও সন্তান। আবারও ছবির চারজনের একজন হিসেবে গাণিতিক তত্ত্বে ষোলো আনা শক্তির বারো আনাই প্রার্থীকে টেনে তোলার জন্য। সিকিভাগ কেবল প্রার্থীর নিজস্ব শক্তি। প্রার্থীকে টানার জন্য পোস্টারের মানুষ আরও বাড়ালে প্রার্থী হয়ে পড়বেন দু’আনি বা একআনি মানুষ।

রাজনৈতিক হিসাবটা ঠিক গণিতের হিসাব নয়, এটা মানতেই হবে। এখানে সমষ্টিগত শক্তিই বেশিই কাজ করে। হয়তো সেক্ষেত্রে কে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন তাতে কিছু এসে যায় না। তবুও বাংলাদেশের অর্ধশত বছর পার করার পর আমরা সিকি মানুষ কিংবা দু’আনি মানুষ নিয়ে কেন সন্তুষ্ট থাকব?

বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় অর্ধশত বছরেও কি কেবল সিকি মানুষদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠাব? কেবল প্রার্থী আর তার প্রতীক কিংবা প্রার্থী ও তার দলের নামই কি যথেষ্ট, পোস্টার যথেষ্ট হবে না? যদি তা না হয় টাগবোটকে টানতে হবে প্রতিবন্ধী একেক জন প্রার্থী।

আমরা উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, গতিময় একটি দ্বিতীয় অর্ধশতক চাই, যে সময় সংসদ সদস্যরা সিকি কিংবা দু’আনি মানুষ হবেন না, হবেন ষোলো আনা মানুষ।

আন্দালিব রাশদী ।। কথাসাহিত্যিক