ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ বছরে পৃথিবীতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আটগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর ১২৯টির মতো দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহ, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশগুলোয় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশসমূহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে।

বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ২০১৯ সালে। সেই বছর বাংলাদেশেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ছিল। তবে এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

আরও পড়ুন >>> শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়? 

ডেঙ্গু জ্বরের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। উপসর্গ ও লক্ষণ অনুযায়ী এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে পাঁচ লাখ মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে ৪০ হাজারের বেশি রোগী মৃত্যুবরণ করে। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানীরা ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য চেষ্টা শুরু করে।

১৯২০ সাল থেকে ডেঙ্গু জ্বরের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রয়াস শুরু হয়। আমরা জানি ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি উপধরন। এগুলো হচ্ছে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। অবশ্য আফ্রিকার একটি মাত্র স্থানে ডেন-৫ ধরনের ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। এর ব্যাপ্তি ঐ নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে ছড়ায়নি বলে ডেন-৫ কে সাধারণ আলোচনার বাইরে রাখা হয়।

বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ২০১৯ সালে। সেই বছর বাংলাদেশেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ছিল। তবে এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের বৈশিষ্ট্য হতে হবে একটি ভ্যাকসিন দিয়ে চার উপধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষাশক্তি তৈরি করা। এই সমস্যার সমাধান করতে না পারার জন্যই ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা যাচ্ছিল না।

২০১৫ সালে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সফল ভ্যাকসিন তৈরির ঘোষণা দেয় যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সানোফি ও লুই পাস্তুর ইনকরপোরেশন, সংক্ষেপে বলা হয় সানোফি-পাস্তুর। ভ্যাকসিনের নাম রাখা হয় ‘ডেঙ্গভ্যাকসিয়া (Dengvaxia)’।

প্রথমে দাবি করা হলো এই ভ্যাকসিনটি ডেঙ্গু ভাইরাসের সবগুলো উপধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারবে। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল যারা আগে ডেঙ্গুর কোনো একটা উপধরন দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে কেবলমাত্র তাদের শরীরে এই ভ্যাকসিন প্রতিরোধ শক্তি তৈরি করতে পারে।

আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব? 

যারা আগে সংক্রমিত হয়নি এমন কাউকে ডেঙ্গভ্যাকসিয়া প্রয়োগ করা হলে তাদের দেহে ডেঙ্গুর তীব্র সংক্রমণের মতো লক্ষণ ও উপসর্গ হতে পারে। এসব কারণে এই ভ্যাকসিনকে গণটিকা দান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

২০২২ সালের শেষ নাগাদ জাপানের টাকেদা (Takeda) ফার্মাসিউটিক্যালস ‘টাক-০০৩ [TAK-003 (Tetravalent Dengue Vaccine Candidate)]’ নামের একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়। টাক-০০৩ এর বাণিজ্যিক নাম হচ্ছে ‘কিউডেঙ্গা [QDENGA® (Dengue Tetravalent Vaccine)]’। থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ডেন-২-কে অক্ষশক্তি ধরে এমন একটি ভ্যাকসিনের ধারণা (Concept) তৈরি করে, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের সবগুলো উপধরনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে টাকেদা ফার্মা কিউডেঙ্গা তৈরি করে।

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে এই ভ্যাকসিন কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। কিউডেঙ্গা ৬ বছর ও তার বেশি বয়সের সবাইকে দেওয়া যায়। দু'টি ডোজ দিতে হয়। প্রথম ডোজ দেওয়ার তিনমাস পরে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হয়। এতে শরীরে জীবনব্যাপী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।

এটি ইনজেকশনের সাহায্যে চামড়ার নিচে দিতে হয়। কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ডেঙ্গুর লক্ষণ ও উপসর্গ প্রতিরোধ করে ৮০.২০ শতাংশ এবং হাসপাতালে ভর্তি কমায় ৯০.৪০ শতাংশ। কিউডেঙ্গার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অতিসাধারণ ও খুব কম।

...প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে এই ভ্যাকসিন কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। কিউডেঙ্গা ৬ বছর ও তার বেশি বয়সের সবাইকে দেওয়া যায়। দু'টি ডোজ দিতে হয়।

ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইউকে, আইসল্যান্ড, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ অনেকগুলো দেশ কিউডেঙ্গা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ডেঙ্গু সংক্রমণে জর্জরিত দেশ ইন্দোনেশিয়া ৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের জন্য কিউডেঙ্গার গণটিকা দেওয়া শুরু করেছে।

ভারতের প্যানেসিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস ও সেরাম ইন্সটিটিউট যৌথভাবে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরির শেষপ্রান্তে চলে এসেছে। ওদের ভ্যাকসিনটির তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে।

ডেঙ্গুর ভ্যাকসিনের বিষয়ে বাংলাদেশের কী করা উচিত? ২০১৯ সালের আগে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ছিল শহুরে রোগ। কিন্তু ২০১৯-র মহামারির সময়ে ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূল করা একটি পর্বত সমান বিশাল কাজ। এর জন্য যে পরিমাণ সম্পদ ও প্রশিক্ষিত জনবলের প্রয়োজন তা আমাদের নেই।

আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ 

অন্যদিকে ডেঙ্গুর কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদহানি হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এর বিশাল নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ব্যবহারের দিকেই যেতে হবে।

এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের মধ্যে কিউডেঙ্গা আমাদের সঠিক নির্বাচন হতে পারে। তবে তার আগে কিউডেঙ্গার ব্যবহারজনিত ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। ডেঙ্গুর গণটিকাদান কর্মসূচি গ্রহণের আগে বাংলাদেশে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনের বিজ্ঞানসম্মত ট্রায়াল হতে হবে।

এছাড়া অন্য যে বা যেসব টিকা আবিষ্কারের পথে রয়েছে তার খোঁজখবর রাখতে হবে। সবকিছু মিলে আগামী বছর ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই আমরা ডেঙ্গু ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারি।

ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূল, আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়া ও ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন প্রদানের মাধ্যমেই ডেঙ্গু নামের কালান্তক অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।

ডা. লেলিন চৌধুরী ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ