ছবি : সংগৃহীত

যে সময় আমেরিকার কাগজে-কাগজে রবীন্দ্রনাথের চেহারার সঙ্গে যিশুর সাদৃশ্যের কথা লেখা হচ্ছে তখনো রবীন্দ্রনাথ নিজের মনের ভাব গোপন না করে স্পষ্টই পশ্চিমের হুড়োতাড়ার বিরুদ্ধে মত রাখছেন, ‘আমি এই দৌড়োদৌড়ি দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি… এ যেন ঠেলাঠেলি, ছুটোছুটি আর অর্থ উপার্জনেরই দেশ।’ 

হয়তো এর বাইরেও একটা আমেরিকা তার আদিগন্ত বিস্তৃত ভুট্টাক্ষেতে, নদীতে, পাহাড়ে জেগে আছে। তবু সেখানে তিনি তা পাননি যা প্রথম সূর্যোদয়ের দেশ তাকে দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমি জাপানে দেখেছি সাধারণ মজুররাও নদীর ধারে দাঁড়িয়ে পনেরো মিনিট ধরে স্তব্ধ হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে মগ্ন হয়ে আছে, তাদের কালো চোখের দৃষ্টি সুরে কোমল, এই দৃশ্যের সঙ্গে লন্ডন শহরের দৃশ্যের তুলনা করেছি, জনতা ছুটে চলেছে ঊর্ধ্বশ্বাস, তাদের মুখ উদভ্রান্ত।’

আরও পড়ুন >>> অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক? 

কিন্তু ইউরোপও কি প্রবল ভালোবাসেনি রবীন্দ্রনাথকে? ইউরোপ জুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কী অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা ছিল তা এখন জানলে বিস্ময় জাগে।

কবির প্রতি ভালোবাসায় বোধহয় অন্যসব দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল জার্মানি। ভিয়েনাতে, কোলনে সহস্র লোক সমবেত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনতে। না, হুজুগের ভিড় ছিল না সেটা।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা জার্মান অনুবাদে আদৌ শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছে কি না তা নিয়ে বক্রোক্তি করেছিল ব্রিটিশ শাসনের ধ্বজাধারী সেই সময়ের স্টেটসম্যান। কিন্তু সত্যকে বদলানোর সাধ্য তার ছিল না।

রয়টার্স খবর করেছিল, পাঁচ-ছ’হাজার লোক আধক্রাউন থেকে দশ শিলিং পর্যন্ত মাথাপিছু খরচ করে রবীন্দ্রনাথের ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন। সন্ধ্যায় কবি তার কবিতা পড়েছিলেন বাংলায় এবং তা অনূদিত হয়েছিল জার্মানে। মানুষের প্রবল ভালোবাসা পেয়েছিল সেই কবিতারাও।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা জার্মান অনুবাদে আদৌ শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছে কি না তা নিয়ে বক্রোক্তি করেছিল ব্রিটিশ শাসনের ধ্বজাধারী সেই সময়ের স্টেটসম্যান। কিন্তু সত্যকে বদলানোর সাধ্য তার ছিল না।

কেবল জার্মানি নয়, চেকোস্লোভাকিয়ার গ্রামে গ্রামে অভিনীত হতো ‘ডাকঘর’, আর মূল চরিত্রগুলোয় অভিনয় করতো মেয়েরাই। মানুষের ভিড়ে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যেত না সেখানে।

আরও পড়ুন >>> রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য 

লন্ডনের একটি কাগজে ‘জার্মানি কী পড়ছে’ নামের প্রবন্ধে লেখা হয়েছিল, ভারতবর্ষের কবির বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। একই ব্যাপার ঘটেছিল রাশিয়াতেও। সেইখানে রবীন্দ্রনাথের বই প্রকাশ পাওয়া মাত্রই লক্ষ পাঠক তা সংগ্রহ করতেন।

মৈত্রেয়ী দেবীর লেখায় আমাদের পরিচয় হয়েছে এক আশ্চর্য নারীর সঙ্গে, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ভাইঝি লিলি ফ্রয়েড। ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণের সময় তিনি কবির কাছে বাংলা কবিতা আবৃত্তি করতে শিখেছিলেন। এবং কোনো কোনো জায়গায় রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার পর তার কবিতা আবৃত্তি করতেন।

....কেবল জার্মানি নয়, চেকোস্লোভাকিয়ার গ্রামে গ্রামে অভিনীত হতো ‘ডাকঘর’, আর মূল চরিত্রগুলোয় অভিনয় করতো মেয়েরাই। মানুষের ভিড়ে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া যেত না সেখানে।

১৯৫৩ সালে লন্ডনে আলাপ হওয়ার মুহূর্তে মৈত্রেয়ী দেবী যখন খবরটি বিশ্বাস করবেন কি করবেন না সেই দোলাচলে ভুগছেন তখন শুভ্রকেশা লিলি তিরিশ বছর আগে আয়ত্ত করা ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ নির্ভুল উচ্চারণে আবৃত্তি করে উপস্থিত বাঙালিদের আপ্লুত করেছিলেন। 

রবীন্দ্রনাথ যখন বিবিধ বিষয়ে পাশ্চাত্যের কঠোর সমালোচক হয়েও এই ভালোবাসার টানে ভেসে যাচ্ছেন, মনে করছেন যে তার জীবনের শেষদিনগুলোর ওপরে পাশ্চাত্যের অধিকার রয়েছে তখন দেশের ভেতরেই গণ্যমান্য কিছু রাজনীতিবিদ তাকে কুৎসিত আক্রমণ করছেন; নাইটহুড এবং নোবেলের বিনিময়ে তিনি পশ্চিমের কাছে বিকিয়ে গেছেন, এমন কথাও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের

আর সেই সময়েই জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইটহুড পরিত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ। লর্ড চেমসফোর্ডকে চিঠি লিখে ওই খেতাব ফিরিয়ে নেওয়ার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথই পরে বলেছেন, ‘আমার এত অহংকার নেই যে সাহিত্যিক কাজের জন্য আমাকে যে সম্মান দেওয়া হয়েছিল, অভদ্রতা করে তার প্রতি কপট ঘৃণার ভাব দেখাবো। আমি জনসমক্ষে এমন কোনও কাজই করতে চাই না, যাতে এতটুকু নাটকীয়তা ঘটে। কিন্তু এই বিশেষ ব্যাপারে আমাকে দায়ে পড়েই তা করতে হয়েছে যখন কিছুতেই কোনও রাষ্ট্রনেতাকে দিয়ে পাঞ্জাবে যে ঘটনা ঘটেছিল তার উপযুক্ত প্রতিবাদ করাতে পারলাম না।’

বিশ্বপথিক বলেই কি রবীন্দ্রনাথ আরও বেশি করে ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন? সারা পৃথিবীর সুর কানে বাজত বলেই কি তিনি সবচেয়ে বেশি শুনতে পেতেন, দেশমাতৃকার কান্না? শিলাইদহের কৃষক কিংবা বোলপুরের চাষির দুঃখে তাই কি এত কাতর হতেন তিনি? এবারের বাইশে শ্রাবণ সেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও ভাবা প্রয়োজন।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক (ভারত)