সম্প্রতি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলতি উপাচার্যের মেয়াদ শেষে পরবর্তী উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সরকার রুটিন দায়িত্বের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার রীতি চালু করেছে। এটি নতুন রেওয়াজ। উপাচার্য নিয়োগের সরকারি আদেশে সাধারণত বলা হয় যে, উপাচার্যের শূন্যপদে পরবর্তী উপাচার্য নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজের ধারাবাহিকতার স্বার্থে দৈনন্দিন রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হলো। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কেউ যেমন প্রো-ভিসি বা ট্রেজারার (যদি থাকে), জ্যেষ্ঠ ডিন বা সিনিয়র প্রফেসর এই দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। তবে এর ব্যতিক্রমও হয়েছে, যেমন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকেও উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারি আদেশ দেওয়া হয়েছিল। যা নিয়ে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন।

শিক্ষকরা মনে করেন যে, একজন রেজিস্ট্রারকে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব দেওয়া একটি নজিরবিহীন ঘটনা। সাধারণ নিয়মে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে প্রো-ভিসি বা ট্রেজারার (যদি থাকে), জ্যেষ্ঠ ডিন বা সিনিয়র প্রফেসর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অবশ্য উল্লেখ্য যে, উল্লিখিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের পদ শূন্য হয়েছিল। তাই রেজিস্ট্রারকেই উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব দিতে হয়েছিল। এ নিয়ে দেশের অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদরা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে সবগুলো শীর্ষ পর্যায়ের পদ যে শূন্য তা কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জানা ছিল না? কেন তারা এ ব্যাপারে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না? এটি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলার একটি বাস্তব চিত্র।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত। প্রজ্ঞাবান, যোগ্য, সৎ উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া কিছুটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য নিয়োগের প্রচলন করেছে সরকার।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত। এখানে সরকারকে অত্যন্ত সর্তকতার সাথে উপাচার্য নিয়োগ করতে হয় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রের অন্যতম স্পর্শকাতর জায়গা। তবে বাস্তবতা হলো একজন প্রজ্ঞাবান, যোগ্য, সৎ একাডেমিশিয়ান প্রফেসরকে খুঁজে বের করে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া কিছুটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার বটে। তাই সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য তথা রুটিন দায়িত্বের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার প্রচলন চালু করেছে।

আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটি ভালো মনে হলেও উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ দিতে সরকার ৪-৫ মাস সময় নেয়। যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। উপাচার্য পদটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর পদ অথচ সেই উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে কর্তৃপক্ষের বা সরকারের প্রস্তুতি, উদ্যোগ ও পদক্ষেপ দেখে মাঝে মাঝে অবাক হতে হয়। মনে হয় যেন দেখার কেউ নেই। আসলেই কি তাই? এখন যেখানেই (বিশ্ববিদ্যালয়) চলতি উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হচ্ছে সেখানেই সরকার অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য বা রুটিন দায়িত্বের উপাচার্য নিয়োগ দিচ্ছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই সরকার সময়মতো উপাচার্য নিয়োগ দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না। আর এভাবে উপাচার্য নিয়োগ বিলম্বিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হচ্ছে।

উপাচার্য হওয়ার প্রতিযোগিতায় শিক্ষকরা নিজেরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন, নিজে ভিসি হতে না পারলেও অন্যকে কিভাবে ঠেকানো যায় সেই চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন। নামে বেনামে একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি দফতরে চিঠি প্রেরণ করেন ও পত্রিকায় নেতিবাচক সংবাদ ছাপান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব প্র্যাকটিসে এখন অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

উপাচার্য পদটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর পদ অথচ সেই উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে কর্তৃপক্ষের বা সরকারের প্রস্তুতি, উদ্যোগ ও পদক্ষেপ দেখে মাঝে মাঝে অবাক হতে হয়। মনে হয় যেন দেখার কেউ নেই।

একজন রুটিন দায়িত্বের উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কি করতে পারবেন আর কি করতে পারবেন না তা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মত। আসলে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বের কর্মপরিধির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনাও নেই। তাই অনেক উপাচার্য নিজের পছন্দ মতো কাজ করেন। যেমন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম মাহবুব হাসানের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট সভা ছাড়াই সাময়িক বরখাস্ত হওয়া এক কর্মকর্তাকে দায়িত্বে পুনর্বহাল ও পাঁচ কর্মকর্তাকে বদলির অভিযোগ উঠেছিল।

আবার অনেক উপাচার্যকে নিজের পছন্দের লোককে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব বা বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে দেখা যায়। রুটিন দায়িত্বের উপাচার্যের এহেন ক্ষমতার দাপট বা কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম অসন্তোষ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সরকার কেন সময়মতো উপাচার্য নিয়োগ দিচ্ছে না? রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে যদি সময়মতো প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় কেন? নাকি সরকারের কাছে এর গুরুত্ব কম? নাকি আগ্রহের অভাব? নাকি উপাচার্য প্রার্থীদের পক্ষে বা বিপক্ষে রাজনৈতিক সুপারিশ যথেষ্ট নয়? 

এরকম শত শত প্রশ্ন সামনে আসতে থাকে উপাচার্য নিয়োগ বিলম্বিত হওয়ায় কারণে। সুতরাং উপাচার্য নিয়োগ কেন সময়মতো সম্ভব হচ্ছে না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম গতিশীল রাখতে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত করা প্রয়োজন। উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। অন্তত ছয় মাস আগে থেকেই এই বিষয়ে আগাম চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। প্রয়োজন হলে একটি শক্তিশালী কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে সম্ভাব্য উপাচার্যদের সংক্ষিপ্ত তালিকা নিরূপণ করা যেতে পারে, যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান বজায় রাখতে যথাসময়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ খুবই জরুরি।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান মিয়া ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়