ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে পূর্বের সব ইতিহাস ভেঙে নতুন রেকর্ড করল ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর এবং মৃত্যুর সংখ্যা দুটোতেই অন্যান্য বছরের পরিসংখ্যানকে ছাড়িয়ে গেছে ২০২৩ সাল।

এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে বছরের শুরু থেকেই সতর্কবার্তা দিয়ে এসেছি আমি—তা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন গুরুত্ব সহকারে প্রচারও করেছে। ডেঙ্গু নামক পাগলা ঘোড়াকে থামাতে পারিনি আমরা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিস্তৃত হয়েছে দেশের সব জেলায়। সগর্বে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আর ছড়িয়ে যাচ্ছে ডেঙ্গু।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়েছে আগেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুর সংখ্যাও পাঁচশত ছুঁই ছুঁই। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আক্রান্তের হার বেশি আর মৃত্যুর সংখ্যা নারী ও শিশুদের বেশি। আক্রান্তের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।

আরও পড়ুন >>> শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়? 

যে বয়সী মানুষজন সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম তারাই অধিক ঝুঁকিতে। তাই পারিবারিক আর্থিক ক্ষতিও অপরিসীম। মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট, চিকিৎসা ব্যয় সবমিলিয়ে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনছে এই ডেঙ্গু। মৃত্যু ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি শিশু, নারী এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা।

ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, মশা নিয়ন্ত্রণ ও জনসম্পৃক্ততার জন্য সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশনের কোনো উদ্যোগই যেন কাজে আসছে না। ডেঙ্গু ঢাকা থেকে জেলা শহর, জেলা শহর থেকে উপজেলা হয়ে এখন গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

ডেঙ্গুকে ইতিপূর্বে আমরা শহরের রোগ হিসেবে জানতাম এবং তাই সবসময় প্রচার করে এসেছি। কিন্তু এডিস মশা তার স্বভাব বদলে এখন স্থান করে নিয়েছে শহর থেকে উপশহর ও গ্রামে।

ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, মশা নিয়ন্ত্রণ ও জনসম্পৃক্ততার জন্য সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশনের কোনো উদ্যোগই যেন কাজে আসছে না।

বাংলাদেশের গ্রামগুলোরও চরিত্র বদলেছে। গ্রাম এখন আর সেই পূর্বের গ্রাম নেই। অপরিকল্পিত নগরায়নের থাবায় গ্রাস করে নিয়েছে গ্রামের পুকুর, নদী-নালা, খাল, বিল, মেঠো পথ। যার যার ইচ্ছেমতো যে যেভাবে পারছে স্থাপনা তৈরি করছে গ্রামের বাসিন্দারাও। শহরের স্বাদ নিতে ব্যস্ত সবাই।

আমাদের গবেষণা দল গ্রামে ডেঙ্গুর কারণ বিশ্লেষণ ও গবেষণা করতে গিয়ে যেসব তথ্য বের করে এনেছেন তা অবাক করার মতো। বিভিন্ন গ্রামে এডিস মশার প্রজনন ও ঘনত্ব জরিপ করতে গিয়ে গ্রামে ডেঙ্গু হওয়ার মূল যে কারণগুলো উঠে এসেছে তা হলো—

১) ঘরবাড়ি নির্মাণের জায়গা কমে যাওয়া;

২) অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ;

৩) গৃহস্থালির পানি সরবরাহ সিস্টেম না থাকা;

আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ 

৪) ড্রেনেজ সিস্টেম না থাকা;

৫) খাল-বিল, পুকুর ভরাট করে ফেলা;

৬) গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য বৃষ্টির পানি ড্রাম, মটকা, বালতি ইত্যাদি পাত্রে জমিয়ে রাখা;

৭) সর্বোপরি গ্রামবাসীর এডিস মশা ও এর প্রজননস্থল সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা;

বিভিন্ন গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে জমিয়ে রাখা পানিতে আমরা যখন এডিস মশার লার্ভা পেলাম এবং তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এটি ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বাচ্চা। তারা এটি কোনোভাবেই বুঝতে চাইছিলেন না। তাদের মতে এটি পানির পোকা এর দ্বারা কোনো রোগ হয় না।

এমনও অনেক বাড়ি আমরা পেয়েছি যেখানে বাড়ির গৃহকর্তীকে অনেক অনুরোধ করেও এডিস মশার লার্ভা ভর্তি পাত্রের পানি ফেলে দিতে রাজি করাতে পারিনি। নানাভাবে গ্রামের মানুষদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি পানি ঢেকে রাখতে হবে। এমনভাবে রাখতে হবে যেন কোনো ছিদ্র না থাকে। কারণ ছিদ্র থাকলে তা দিয়ে স্ত্রী মশা ঢুকে ডিম পারবে ও লার্ভা হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইতিমধ্যে সতর্কবার্তা জারি করেছে যে, বিশ্বের অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে থাকবে...

বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিনে ঘুরে একজন গবেষক হিসেবে আমার মনে হয়েছে এডিস মশার প্রজনন পাত্র ব্যবস্থাপনা ছাড়া গ্রামে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আর এই পাত্র ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কাজটি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে হবে নিজেদেরই।

বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, এডিস মশার ঘনত্ব এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এই কয়েকটি প্যারামিটারকে মাল্টিফেরিয়েট অ্যানালাইসিস করে কম্পিউটারে আমরা যে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সেপ্টেম্বর মাস থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে কার্যক্রমগুলো চলছে তা চলমান রাখতে হবে অন্যথায় বিপরীত হতে পারে।

আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গুর নতুন হটস্পট : এইবারও কি ব্যর্থ হব? 

২০২৩ সালে ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়েছে সারা বাংলাদেশে। মশা ভবিষ্যতে সুপার পতঙ্গ হয়ে নানা ধরনের রোগ নিয়ে আরও ভয়াবহ হয়ে আসবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইতিমধ্যে সতর্কবার্তা জারি করেছে যে, বিশ্বের অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে থাকবে। ভবিষ্যতের সঙ্কট মোকাবিলায় গ্রাম এবং শহর বিবেচনায় বাহকবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার বাস্তবায়ন করতে হবে।

ডেঙ্গু সমস্যা ২০২৩ সালের জন্য সাময়িক সমাধান হলে ভুলে যাওয়া যাবে না। পরিস্থিতির উন্নতি হলেই সঙ্গে সঙ্গে আগামী দিনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন করে নিতে হবে।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com