ছবি : সংগৃহীত

ঘটনাস্থল রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়া। মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং রাবেয়া আক্তারের দুটি সন্তান। বড় ছেলের নাম আরাফাত, বয়স নয় বছর। ছোট সন্তান মেয়ে, ওর নাম রাইদা, বয়স ছয় বছর। আনন্দে ভরা একটি সংসার।

২০২৩ সালের ১৮ আগস্ট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরাফাত মৃত্যুবরণ করে। পরবর্তী সাতদিনের মাথায় অর্থাৎ ২৫ আগস্ট মারা যায় রাইদা। মৃত্যুর কারণ সেই ভয়ংকর ডেঙ্গু। এক সপ্তাহের মধ্যে দুই সন্তানকে হারিয়ে শোকবিদ্ধ মা-বাবা পাথরের মতো স্তব্ধ।

ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যকারো পক্ষে এই শোকের তীব্রতা অনুভব করা অসম্ভব। ইব্রাহিম-রাবেয়ার শোক জর্জরিত অবয়ব যেন ২০২৩ সালের ডেঙ্গু কবলিত বাংলাদেশের বেদনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। দুই সন্তান হারিয়ে যন্ত্রণার অতি-উত্তপ্ত কড়াইতে ঝলসানো রাবেয়া-ইব্রাহিম দম্পতির পাশে শোক-সংহতির বার্তা নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র বা দায়িত্বশীলদের কেউ ওদের পাশে গিয়ে  দাঁড়িয়েছিল কি? অথবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা? না, কেউ ওদের পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা জানায়নি।

আরও পড়ুন >>> শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়? 

সারাক্ষণ দেশের কল্যাণে ব্রতী রাজনৈতিক দলগুলোর ছোট-বড় নেতাদের কেউ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন, মহৎপ্রাণ বুদ্ধিজীবী বা অন্য কেউ বেদনার ভাগ নিতে ছুটে যায়নি সন্তানহারা দম্পতির পাশে। শুধু রাবেয়া-ইব্রাহিম নয়, কত মানুষের বুক ও সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গিয়েছে কালান্তক ডেঙ্গুর আক্রমণে। এইসব মানুষের কাছে ক’জন মানবিক মানুষের সহমর্মী উপস্থিতি দেখা গিয়েছে?

২০০০ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়। এরমধ্যে বছরওয়ারি মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ২০২৩ সালে। যদিও ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হতে আরও কয়েক সপ্তাহ বাকি রয়েছে। এই সময়ে মানুষের মনকে নাড়া দেওয়ার মতো অনেক বেদনাদায়ক মৃত্যু ও ভোগান্তির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আমরা দেখেছি এসব ভোগান্তি ও মৃত্যুতে সমাজবদ্ধ মানবিক মানুষের মতো আমরা ব্যথিত বা আলোড়িত হইনি এবং হচ্ছি না। মৃত্যু, বিশেষ করে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুকে মানুষ স্বাভাবিক মনে করে যেন নির্বিকার মেনে নিচ্ছে।

সারাক্ষণ দেশের কল্যাণে ব্রতী রাজনৈতিক দলগুলোর ছোট-বড় নেতাদের কেউ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন, মহৎপ্রাণ বুদ্ধিজীবী বা অন্য কেউ বেদনার ভাগ নিতে ছুটে যায়নি সন্তানহারা দম্পতির পাশে।

মানুষের দুঃখ, দুর্যোগ, মৃত্যু, দুর্ঘটনা, ঝড়, বন্যা, সাইক্লোন, মহামারি ইত্যাদিতে বাঙালি কখনো নিশ্চুপ নিষ্ক্রিয় হয়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকেনি। সমবেতভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে, দুঃখ-দুর্দশার কারণ মোচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এইরকম বহু ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সেইসবের উল্লেখ করা নিছক বাহুল্য হবে। সেই চির সহমর্মী বাঙালির কাছে ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু এখন কি গা সয়ে গিয়েছে?

২০২৩ সালের ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারি কালান্তক চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিবেদনে কেবলমাত্র নথিভুক্ত বা রিপোর্ট করা হয়েছে এমন মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হবে বলে ধারণা করা হয়।

ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কর্মকৌশল দুটি। প্রথমটি হচ্ছে—ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূল করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীর সঠিক চিকিৎসা দেওয়া। প্রথম কাজটির দায়িত্বে আছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয় তার অধীনস্থ সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ইত্যাদির মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের দায়িত্ব পালন করে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন >>> মশার আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ 

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী একটি সমন্বিত পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। মশা নির্মূলের জন্য এডিস মশার প্রজননস্থল ও বাসস্থান বিনষ্ট করতে হয়। একইসাথে প্রাপ্তবয়স্ক মশা ও মশার লার্ভা বা শুককীট মারার জন্য ওষুধ ছিটানো হয়।

অতীতে অনেকবার দেখা গিয়েছে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার বা কর্তৃপক্ষ সঠিক সময়ে উদ্যোগ না নিলে জনসাধারণ স্ব-উদ্যোগে কাজটি শুরু করে দেয়। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছাত্রছাত্রী, রোভার স্কাউট, বয়েজ স্কাউট, গার্লস গাইড, খেলাঘর, কচিকাঁচা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রভৃতি এগিয়ে আসে। অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোও হাত লাগায়।

এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযুক্ত জায়গাগুলো পরিষ্কার করার কাজটা এরা সবাই মিলে সারাদেশে একত্রে শুরু করলে চিত্রটি কেমন দাঁড়াতো? বাংলাদেশের বহু মহৎ অর্জনের নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা নিজেদের ক্যাম্পাসে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র অর্থাৎ জমে থাকা পানির জায়গাগুলো পরিষ্কার ও ধ্বংস করার কাজ শুরু করতে পারতেন।

ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কর্মকৌশল দুটি। প্রথমটি হচ্ছে—ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নির্মূল করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীর সঠিক চিকিৎসা দেওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কাজটি শুরু হলে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই কার্যক্রম শুরু হয়ে যেত। ক্রমে সবাই হাত লাগাতো। বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাত দেশের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিবর্গ এইরকম একটি উদ্যোগ নিয়ে সারাদেশে ডাক পাঠাতে পারতেন। ২০২৩ সালের ডেঙ্গু মহামারি মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত কেউ অগ্রসর হয়ে মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়নি।

ডেঙ্গুর চিকিৎসায় অতি প্রয়োজনীয় একটি ওষুধ হচ্ছে শিরাপথে ব্যবহারের স্যালাইন। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা অমানবিকভাবে স্যালাইনের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ মুনাফা শিকারিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত দরকার ছিল। তা করার জন্য উষ্ণ হৃদয়ের কোনো সাহসী প্রাণ এগিয়ে আসেনি।

আরও পড়ুন >>> ডেঙ্গুতে আর কত মৃত্যু হলে আমাদের টনক নড়বে? 

ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো রোগীকে মশারির ভেতরে রাখা। ডেঙ্গুরোগীকে কামড়িয়ে একটি এডিস মশা যদি পাঁচজন সুস্থ মানুষকে কামড়ায় তাহলে তাদের শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস প্রবেশ করবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনেক ডেঙ্গু রোগীকে মশারি দেওয়া হয় না। কারণ মশারির সরবরাহ নেই।

অবশ্য দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের চিত্র একইরকম। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কেন জরুরি ভিত্তিতে মশারি সংগ্রহ করা হয়নি—তার কোনো জবাব নেই। এইসব ক্ষেত্রে ধনাঢ্য ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান সাধারণত এগিয়ে আসে। যেমনটি আমরা করোনা মহামারির সময় ‘হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা’-র বিষয়ে দেখেছি। এইবার তা হলো না।

প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু কখনো গা-সওয়া হতে পারে না। যখন দেশের অগ্রসর নাগরিকগণ বিনা প্রতিবাদে এই ধরনের মৃত্যুকে মেনে নেয় তখন বুঝতে হবে জাতির মননে জড়ত্ব বাসা বেঁধেছে, তারা নির্জীবতা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। মানুষের মানবিকতা যখন হ্রাস পেতে থাকে তখনই তার অধঃপতন যাত্রা ত্বরান্বিত হয়। ডেঙ্গু মহামারির এই বিপর্যয় কালে দেশে যে মানবিক মানুষের আকাল পড়েছে সেটা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে প্রকাশিত হলো।

ডা. লেলিন চৌধুরী ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ