সুনামির মতো ভয়াবহভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে আঘাত করেছে। প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এবারের করোনা সংক্রমণকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা হচ্ছে কেন? ২০২০-র ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো করোনা রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। তারপর ক্রমান্বয়ে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আবার একসময় সেটা কমে আসতে শুরু করে। ২০২১-র জানুয়ারি মাসে সংক্রমণের হার বেশ কমে যায়। পুরো ফেব্রুয়ারি এবং মার্চের প্রথমদিকে সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসে। কোনো কোনো দিন এই হার তিন শতাংশের কম হয়।

কোনো দেশ বা অঞ্চলে একনাগাড়ে তিন-চার সপ্তাহ সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের কম হলে তখন সেই দেশ বা অঞ্চলে করোনা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। সেদিক থেকে আমাদের দেশে করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রিত হয়। এবছর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষদিক থেকে সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে থাকে। ক্রমান্বয়ে এই হার ২৩ শতাংশ অতিক্রম করে যায়। করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল বিধায় এখনকার সংক্রমণকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা হচ্ছে।

এবারের করোনা সংক্রমণের ধরন আগের চেয়ে ভিন্ন এবং আগ্রাসী। আক্রান্ত রোগীর জ্বর তেমন থাকছে না। তবে পাতলা পায়খানা ও বমি থাকছে। অনেকে শুধু ক্লান্ত বোধ করে। আক্রান্ত হওয়ার দুই বা তিনদিনের মধ্যে শ্বাস কষ্ট দেখা দেয় এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। হাসপাতালে আনার পর অনেককে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দিতে হয়।

এবারের করোনা সংক্রমণের ধরন আগের চেয়ে ভিন্ন এবং আগ্রাসী। আক্রান্ত রোগীর জ্বর তেমন থাকছে না। তবে পাতলা পায়খানা ও বমি থাকছে। অনেকে শুধু ক্লান্ত বোধ করে। আক্রান্ত হওয়ার দুই বা তিনদিনের মধ্যে শ্বাস কষ্ট দেখা দেয় এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়।

গতবছর যে পরিমাণ রোগীকে আইসিইউ-তে স্থানান্তর করা হয়েছিল এবার তার থেকে দুই বা আড়াইগুণ বেশি রোগীকে আইসিইউ-তে নিতে হচ্ছে। এবার মৃত্যুর হারও আগের চেয়ে বেশি। দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে শিশু ও তরুণরা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই মারা যাচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আগের সমস্ত সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় হয়েছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালগুলো পরিপূর্ণ। কোনো হাসপাতালে সাধারণ শয্যা অথবা আইসিইউ বেড খালি নেই। রোগী নিয়ে স্বজনেরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছে। অনেকে পথিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যুবরণ করছে।

হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যাপক হারে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এমনিতেই ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। গত এক বছরের বেশি সময়ব্যাপী তারা একনাগাড়ে কোভিড-১৯ রোগী নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের প্রণোদিত অথবা চাঙ্গা করার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে যেকোনো সময়ে চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে গত একবছরে স্বাস্থ্য বিভাগের দৃশ্যমান উন্নতি কতটা হয়েছে? উন্নতি নিশ্চয় হয়েছে, তবে সেগুলোর দ্বারা স্বাস্থ্য খাতে গুণগত তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। আজ থেকে দশ মাস আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘দেশের প্রতিটি জেলায় আইসিইউ স্থাপন করা হবে।’

বর্তমানে দেশের ৩১টি জেলাকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের নিরিখে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। এই ৩১ জেলার মধ্যে পনেরোটিতে এখনো কোনো আইসিইউ নেই। তার মানে গত দশ মাসে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়নি। যদিও গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি কয়েকমাস যাবৎ কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ও ভাণ্ডারে কম বেশি দু’শয়ের মতো আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটর মজুদ রয়েছে। সেগুলো কেন স্থাপন করা হলো না সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। গত এক বছর সময়কালে আইসিইউ-তে কাজ করার উপযোগী প্রশিক্ষিত ডাক্তার, নার্স ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর্মী গড়ে তোলার খবর আমি শুনিনি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা ও আইসিইউ-র বেড বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। হাসপাতালের বেড দ্রুত জোগাড় করা যায় কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল চাইলেই পাওয়া যায় না। সাথে সাথে নির্মম সত্য হলো হাসপাতালের বেড বাড়িয়ে করোনা ঠেকানো সম্ভব নয়। এজন্য প্রতিরোধী কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে।

করোনা প্রতিরোধী কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রধান কৌশল হলো জনসাধারণকে এই কর্মসূচির সাথে সংযুক্ত করা। কিন্তু আমাদের দেশে জনসম্পৃক্ততার কাজটি সঠিকভাবে করা হয়নি। শুধুমাত্র প্রশাসনিক নির্দেশে সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। সেজন্য এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়নি।
মানুষজন মাস্ক পরতে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে মোটেই আগ্রহী নয়। তাদেরকে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করার দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়নি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে প্রতিহত করতে গত ২৮ মার্চ আঠারো দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। সেখানে ব্যাপক অস্পষ্টতা ও দোদুল্যমানতা বিদ্যমান।

দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে শিশু ও তরুণরা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে অনেকেই মারা যাচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আগের সমস্ত সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

সামগ্রিক বিপর্যয় রোধে গত পাঁচ মার্চ দেশে সাতদিনের ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা করার আগে বলা হলো ‘লকডাউন’। ঘোষিত হওয়ার পরদিন বলা হলো ‘কঠোর নিষেধাজ্ঞা’। মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষ নিজেই এই কর্মসূচির সঠিক চরিত্র সম্পর্কে সন্দিহান। করোনাভাইরাসের সুপ্তিকাল বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড হলো ১৪ দিন। অর্থাৎ শরীরে প্রবেশের পর চৌদ্দ দিন পর্যন্ত ভাইরাসটি রোগ তৈরি করতে পারে। এজন্য করোনাভাইরাসের সংক্রমনধারাকে ছেদ করতে কমপক্ষে ১৪ দিনের লকডাউন দেওয়া বিজ্ঞানসম্মত। লকডাউন দেওয়া হলো অথচ খেলা ও মেলা চলছে, কলকারখানা ও গার্মেন্টস খোলা, বেসরকারি অফিস খোলা। অন্যদিকে বিপনিবতান, দোকানপাট বন্ধ। বিষয়টিকে জনসাধারণের কাছে সঠিক মনে হয়নি। তারা বিক্ষুব্ধ, বিক্ষোভ করছে। গণপরিবহন প্রথমে বন্ধ রেখে পরে চলতে দেওয়া হলো। সব মিলিয়ে লকডাউন পর্বটি একটি প্রহসনকাণ্ডে রূপ নিল।

একটি বিষয় পরিষ্কার যে, কর্তৃপক্ষ একটি সুবিন্যস্ত পূর্ণ পরিকল্পনা ব্যতিরেকে করোনা প্রতিরোধের কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। অর্থাৎ গত বছরের মার্চে আমরা যে জায়গায় ছিলাম এবছরের এপ্রিলেও আমরা সেখান থেকে খুব একটা সামনে যেতে পারিনি। সুনামির বেগে ধেয়ে আসা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মহাবিপর্যয় তৈরি করতে চলছে। ন্যূনতম কোনো সময় নষ্ট না করে প্রতিরোধের কঠিন দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদ দিয়ে তার দায় শোধ করতে হবে।

ডা. লেলিন চৌধুরী ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ