ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন যাদের মৃত্যুতে আশপাশে খুব একটা ওচড়-মোচড় লক্ষ্য করা যায় না। চেতনা-বেদনার উল্লেখযোগ্য প্রকাশ ছাড়াই তারা সমাহিত হন। অনেকে মনে করছেন কবি আসাদ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। দীর্ঘ আশি বছরের কবি জীবন পার করে তিনি নীরবেই যেন চলে গেলেন—এমন খবর কোনো কোনো সংবাদপত্রেও দেখেছি। কিন্তু আসলেই কি তাই! আমার তা মনে হয় না।

আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবি ছিলেন। তার এই পরিচয় মূলত কবিতার জগতে আত্মপ্রকাশের কালসূচক। তিনি ওই দশকে কবিতা লিখে বিদ্বৎসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন; কবি-স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু আসল কথা তিনি দশক পেরিয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কবি ছিলেন। তাকে অতীতের স্মৃতি আর কবিতা ভাঙিয়ে খুব একটা চলতে হয়নি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি অন্তরালের মানুষ ছিলেন না।

বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ মানুষ তাকে চেনেন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাকে কি কবি হিসেবে চেনেন! হ্যাঁ, আসাদ চৌধুরীকে তারা কবি হিসেবেই চেনেন। ওই শ্রেণির সবাই কি তার কবিতা পড়েছে! বাংলাদেশে বই পড়ার সেইদিন গত হয়েছে বহু আগেই। অথবা কোনোদিনই বইপড়ার এমন অবস্থা ছিল না। তবু কবিতা না-পড়েও আসাদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি চেনেন। কারণ, তিনি দীর্ঘ আশি বছর পুরোদস্তুর একটা কবির জীবনযাপন করেছেন।

কাঁধে ঝোলা, পানের রসে ভেজা হাসি হাসি লাল ঠোঁট, রঙিলা রসনা, দীপ্তিমান চোখ আর এলোচুলের আসাদ চৌধুরীকে এই দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি না-পড়েও কবি হিসেবেই চেনেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ওই একই বেশে টেলিভিশনে তার নিয়মিত উপস্থিতির ব্যাপার। ছোট ছোট বোধগম্য বাক্যে শিল্পসাহিত্য বিষয়ক টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কবি আসাদ চৌধুরীকে চেনেন না এমন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ খুব কমই বোধ করি আছেন। কিন্তু সুদূর বিদেশে মৃত্যু হওয়ায় আপাত মনে হচ্ছে আসাদ চৌধুরীর বিদায় ঘটল নীরবে। আসলে তা নয়।

ওই যে আসাদ চৌধুরীর মুখাবয়বের কথা বলছিলাম। বলছিলাম পানের রসে লাল টুকটুকে ঠোঁট-জিহ্বা, সাথে মিষ্টি সুমিত হাসি, উসকো-খুসকো চুল, দীপ্তিমান দুটো চোখের কথা। প্রথম জীবনে আধুনিক বসন-ব্যসনে অভ্যস্ত থাকলেও দ্রুতই তিনি নিজস্ব চেতনার অনুকূলে বিশেষ এই সুরতে ফিরে আসেন।

আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের ষাটের দশকের কবি ছিলেন। তার এই পরিচয় মূলত কবিতার জগতে আত্মপ্রকাশের কালসূচক। তিনি ওই দশকে কবিতা লিখে বিদ্বৎসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন; কবি-স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তিনি যেকালে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন সেইকালে এই মুখাবয়ব অচল প্রায়। ঢাকার কবিসমাজে ঢুকে পড়েছে হালফ্যাশন, স্যুট-বুট, ঠাট-বাট, পশ্চিমা কেতা। কবিতাও সেইরকম একটা কেতাদুরস্ত ভাব আয়ত্ত করে ফেলেছে। কবিতা ও কবিরা পঠন-পাঠন আর অনুসরণ করে বেড়াচ্ছেন ইউরোপ-আমেরিকা; নিদেনপক্ষে কলকাতা। কবিতায় দেখা দিচ্ছে পরাবাস্তববাদ। ভাষায় আর উপমায় চোখে পড়ার মতো হিসেবিপনা তো আছেই।

অক্ষরবৃত্ত আর গদ্য ছন্দের করগোনা কড়া নজরদারিতে সবাই লিখে চলেছেন কাফ্রি সেনার মতো শিরদাঁড়া সোজা করা সব কবিতা। জীবনের নৈরাশ্য আর ক্লান্তিতে ঠাঁসা প্রায় সব কবিতা। সেই তুলনায় আসাদ চৌধুরী তো কোথাকার কোন ‘গাঁওয়ার’; যাপন আর কবিতা দুই ব্যাপারেই।

একে তো একটা ‘পশ্চাৎপদ’ মুখাবয়ব, তার ওপর আবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিতা লেখেন স্বরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। মধ্যযুগের অনুষঙ্গ কবিতার মধ্যে শুধু আমদানি করেই ক্ষান্ত হন না, কবিতার লাইনও গীতিময়তার ভারে বাতাসে নুয়ে পড়া কচি ধানের পাতার মতো খালি নুয়ে নুয়ে পড়তে চায়।

মধ্যযুগীয় লীলালাস্যে এক লাইন যেন আরেক লাইনের গায়ে মেয়েলি ঢংয়ে গড়িয়ে পড়ে। আসাদ চৌধুরীর কবিতা, ভঙ্গিতে বেশ চটুল। আর বিষয়ে যতটা না ব্যক্তিগত তার চেয়ে বেশি সামষ্টিক। একটা রৌদ্রকরোজ্জ্বল স্পষ্টতা, কখনো কখনো মিষ্টতা তার কবিতার সর্বাঙ্গ জুড়ে থাকে। তিনি যেন অনেকটা দলছুট। অথবা তারও দল আছে। কিন্তু সেই দল সংখ্যায় লঘু।

আমি জানি না ষাটের দশকে আসাদ চৌধুরী তার অগ্রজ কবি জসীমউদ্দীনকে তিনি কী চোখে দেখতেন! তার সতীর্থরা অবশ্য জসীমউদ্দীনকে খুব একটা যে নিতে পারতেন তা কিন্তু না। কিন্তু একটা খবর আমাদের কাছে আছে। তা হচ্ছে, আসাদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ওই ষাটের দশকেরই গুরুত্বপূর্ণ কবি ও সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ কিন্তু বলেই রেখেছেন যে, ‘আসাদের কবিতা প্রথমদিকে আমার ভালো লাগতো না।... তার ও আমার জীবন ও শিল্প তথা কাব্যবিশ্বাস তো মেরুদূর ব্যবধির জিনিশ, আমরা দুজন তো স্পষ্টত ও উচ্চারিতভাবেই দুই কাননের পাখি।’ (বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা-২৮৫-২৮৬)

আসাদ চৌধুরীর যাপন আর কবিতার মধ্যে ছিল খাঁটি পূর্ব-বঙ্গীয় ব্যাপার। তাকে বাংলাদেশের ভাষা, সাংস্কৃতিক ইতিহাস আর নিজস্ব কাব্যপ্রগতির সাথে সহজেই মিলিয়ে পাঠ করে ওঠা যায়।

মান্নান আরও বলছেন, ‘আমার গভীর-প্রোথিত নামহীন নৈরাশ্য’ আর ‘আসাদের সামাজিক উজ্জ্বল আশা’। নিজের সাথে না মিললেও আসাদ চৌধুরীর নিজস্বতা কোথায় তা মান্নান সৈয়দ নির্দেশ করেছেন এভাবে—“পাঠক অনায়াসে তাকে নিজেই আবিষ্কার ক’রে নিতে পারেন। ‘তবক-দেওয়া পান’ এই নাম থেকেই, কবি-পরিকল্পিত প্রচ্ছদের সুদর্শন জামদানি-শাড়ির লাল-সবুজ কাজ থেকেই ভিতরের কবিতাগুলির মর্ম বিচ্ছুরিত : দেশজতা। দেশজতা—এই একটি শব্দে আসাদের কবিতা চিহ্নিত করে নেওয়া যায়। এদেশের লোকঐতিহ্যকে আসাদের কবিতা খুব প্রবল-উজ্জ্বলভাবে আঁকড়ে ধরেছে: প্রাচীন লোকসাহিত্য, বৈষ্ণব পদ, লালন শাহ থেকে আসাদ তার কবিতার উপকরণ খুঁজে পেয়েছেন...; লোক-কবিতার আরেক উপকরণ ছড়ার ব্যবহার আসাদের কবিতায় তাই পৌনঃপুনিক...। আসাদের এইসব ছড়ায় আঞ্চল ভাষার বুনন তাই খুব স্বভাবশোভন; পূর্ব-বঙ্গের লোক-ভাষার সঙ্গে আসাদ মিশিয়েছেন আবেগের আন্তরিক তাপ।” (বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৭)

মান্নান সৈয়দের এই বক্তব্যের পক্ষে ও আসাদ চৌধুরীর কবি স্বভাবের ধরনের অনুকূলে একটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে ‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থের ‘ফুল ফুটেছে থোকা থোকা’ কবিতা থেকে—‘ফুল ফুটেছে থোকা থোকা/তাঁতির পুতে বড়ই বোকা/জোলার ছাওয়াল জোলা রে/শাড়ি গামছা ঝোলা রে।/পান খাওয়ালি বিনা চুনে/তবুও তাঁতি লুঙ্গি বুনে/তাঁতির পুতগো করি মানা/লুঙ্গি থুইয়া শাড়ি বানা।/দেশ ভইরাছে মাইয়া লোকে/শাড়ি বানা থাকবি সুখে।/সোনার দেশ রে দুঃখে কই/লুঙ্গি পরার পুরুষ কই?’

বিত্ত নাই, বেসাত নাই, প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়, জলের মধ্যে লেখাজোখা, যে পারে পারুক, ঘরে ফেরা সোজা নয় ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে আসাদ চৌধুরী প্রকাশভঙ্গির ব্যাপারে আরও সচেতন হয়েছেন। কিন্তু তার ওই মূল প্রবণতা বরাবরই অটুট থেকেছে। এর সাথে সবসময়ই তার কবিতায় সক্রিয় থেকেছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি অপরিসীম দরদ। এই দরদি উচ্চারণের স্মারক হয়ে আছে যে পারে পারুক কাব্যগ্রন্থের ‘শহীদের প্রতি’ কবিতার এই প্রশ্নে—‘তোমাদের যা বলার ছিলো/বলছে কি তা বাংলাদেশ?’

মোদ্দা কথা, আসাদ চৌধুরীর যাপন আর কবিতার মধ্যে ছিল খাঁটি পূর্ব-বঙ্গীয় ব্যাপার। তাকে বাংলাদেশের ভাষা, সাংস্কৃতিক ইতিহাস আর নিজস্ব কাব্যপ্রগতির সাথে সহজেই মিলিয়ে পাঠ করে ওঠা যায়। এই ব্যাপারটাই আসাদ চৌধুরীকে তার কালের কবিদের থেকে আলাদা করেছে বলে মনে হয়। এই ঘরানাটি বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে বরাবরই ক্ষীণ। কিন্তু আমার একটা দৃঢ় ধারণা এই যে, এই ধারাটিই বাংলাদেশের কবিতার আসল ধারা।

আসাদ চৌধুরীদের এই কাব্যধরনটিই বাংলাদেশের নিজস্ব আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রগতির সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করি। এই ধারার ভেতর দিয়েই প্রকাশ পেতে পারে ‘আমাদের আধুনিকতা’র খাঁটি রূপটি।

ড. কুদরত-ই-হুদা ।। প্রাবন্ধিক, গবেষক ও শিক্ষক
kudratehuda@gmail.com