ছবি : সংগৃহীত

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় দিনটি মনে রাখার মতো। এইদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একসাথে দুটি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন বা টিকা সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। একটি হচ্ছে ম্যালেরিয়ার টিকা। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উদ্ভাবিত এক ডোজের ম্যালেরিয়া ভ্যাকসিন।

অন্যটি হলো জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি করা ডেঙ্গু প্রতিরোধী কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন। তবে ডেঙ্গুর এই ভ্যাকসিনটি কেবলমাত্র ৬ থেকে ১৬ বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে।

পৃথিবীর যেসব দেশে প্রচুর ডেঙ্গু রোগী রয়েছে এবং যেসব দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানকার শিশুদের জন্য এই টিকার ব্যবহার অনুমোদিত হয়েছে।

মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি (Strategic Advisory Group of Expert-SAGE) এর সুপারিশ অনুযায়ী এই অনুমোদন দেওয়া হয়।

বিজ্ঞানজগতের একটি সুবিখ্যাত ও মর্যাদাপূর্ণ মেডিক্যাল জার্নালের নাম হচ্ছে ‘দ্য ল্যানসেট’। ১৮২৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে জার্নালটি প্রকাশিত হয়ে আসছে।

২০২৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ল্যানসেট জার্নালে ‘ডেঙ্গু কবলিত বাংলাদেশে, ডেঙ্গুর উপধরণ ও বয়স নির্বিশেষে মানুষের শরীরে টিভি০০৫ টিকার নিরাপত্তা ও টেকসই প্রতিরোধ ক্ষমতা : একটি দৈবচয়ন ভিত্তিক নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা (Safety and durable immunogenicity of TV005 tetravalent dengue vaccine, across serotypes and age groups,in dengue-endemic Bangladesh : a randomised controlled trial)’ নামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান টিভি০০৫ নামের ডেঙ্গুর এই টিকাটির প্রস্তুতকারক।

বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবির তত্ত্বাবধানে ১ থেকে ৫০ বছর বয়সের ১৯২ জন স্বেচ্ছাসেবকের ওপর টিভি০০৫ টিকার একটিমাত্র ডোজ প্রয়োগ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। এই টিকার ক্ষেত্রে এটা ছিল দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে দুটি বিষয় দেখা হয়।

তিন বছরব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয় এক ডোজ টিকা প্রয়োগে ডেঙ্গু ভাইরাসের সবগুলো উপধরনের বিরুদ্ধে মানবদেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় এবং টিকাটি মানুষের জন্য নিরাপদ।

প্রথমত টিকাটি মানুষের জন্য কতটা নিরাপদ এবং দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে মানবদেহে টিকার দ্বারা কত দিনের জন্য কী পরিমাণ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। তিন বছরব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয় এক ডোজ টিকা প্রয়োগে ডেঙ্গু ভাইরাসের সবগুলো উপধরনের বিরুদ্ধে মানবদেহে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় এবং টিকাটি মানুষের জন্য নিরাপদ।

এরপর টিভি০০৫ টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হবে। এতে নিরাপদ, কার্যকর ও টেকসই প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চিত হলেই কেবল টিভি০০৫ টিকা ব্যবহার করার কথা ভাবা যাবে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ একটি জটিলতর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ডেঙ্গু এখন মৌসুমি রোগ থেকে সাংবাৎসরিক রোগে পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয়ত ডেঙ্গু এখন মোটেই শহুরে রোগ নয়, এটি এখন মহানগর-নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

একদিকে মশার স্বভাবচরিত্র বদলে গিয়েছে, অন্যদিকে ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গ ও লক্ষণে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশব্যাপী মশক নিধনের কোনো সু-সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার উদ্যোগ নেই।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ কতগুলো বড় শহরে মশা মারার কিছু বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সেইগুলো মোটেই কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। অবশ্য ডেঙ্গু প্রতিরোধের নামে বিপুল হাঁকডাক, বক্তৃতাবাজি, ভাঁওতাবাজি, বিদেশভ্রমণসহ নানা প্রদর্শনবাদী কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। তাতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বা এডিস মশা নির্মূল না-হলেও সাধারণ মানুষের করের বিপুল পরিমাণ অর্থ নিঃশেষ হয়েছে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষ, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। জীবনহানি, স্বাস্থ্যহানি ও সম্পদহানির ভয়াল খড়গের মতো কালান্তক ডেঙ্গুর থাবা থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য কি করা যেতে পারে?

বৈশ্বিকভাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা একমত যে, কেবলমাত্র এডিস মশা নির্মূলকরণের মাধ্যমে ডেঙ্গুর মোকাবিলা করা সম্ভব। তবে সম্প্রতি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন সবার মনে নতুন আশাবাদের সঞ্চার করেছে।

একসময় আমাদের ভ্যাকসিন তৈরির সামর্থ্য ছিল। তখন এইদেশে নিয়মিত টিকা প্রস্তুত হতো। সেই সক্ষমতাকে আমরা নিজেরা বিনষ্ট করেছি। সময়ের সাথে পৃথিবী সামনে এগিয়ে যায়, আমরা গেছি পেছনে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত হওয়ার পর জাপানের কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন ব্যবহারের কথা আমরা ভাবতেই পারি। অন্তত প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কিউডেঙ্গা টিকার দ্বারা ডেঙ্গু প্রতিরোধী সুরক্ষা দেওয়া যায়। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে।

একসময় আমাদের ভ্যাকসিন তৈরির সামর্থ্য ছিল। তখন এইদেশে নিয়মিত টিকা প্রস্তুত হতো। সেই সক্ষমতাকে আমরা নিজেরা বিনষ্ট করেছি। সময়ের সাথে পৃথিবী সামনে এগিয়ে যায়, আমরা গেছি পেছনে। তবে এখন ভ্যাকসিন তৈরিতে আবার সক্ষমতা অর্জন করার সময় এসেছে।

ওষুধ প্রস্তুতে ‘প্রযুক্তি হস্তান্তর (Technology transfer)’ একটি সুবিদিত বিষয়। বাংলাদেশের সামর্থ্য থাকলে জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে এদেশেই কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন তৈরি করা যেত। টিভি০০৫ ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল সফল হলে সেটির 'প্রযুক্তি হস্তান্তর' সংক্রান্ত আলোচনার পথে অগ্রসর হওয়া যেত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টিকাটি তৈরির ক্ষেত্রে তিনটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে যুক্তিবদ্ধ হয়েছে। সফল প্রমাণিত হলে,ভারতীয় প্রতিষ্ঠান তিনটি প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে ভারতে ডেঙ্গুর টিকাটি তৈরি করবে। অবশ্য ভারতীয় গবেষকগণ নিজেরাও একটি ডেঙ্গুর টিকা উদ্ভাবনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

বাংলাদেশে আমরা কেন যেন গবেষণা বিমুখ। গলাবাজি, বক্তৃতাবাজিতে আমরা অতি সফল। কিন্তু গবেষণায় আত্মনিবেদিত হতে পারি না। প্রদর্শনবাদী ও ফুটানি ধরনের কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দের অভাব হয় না। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার জন্য অর্থ ও পরিবেশের বড়ো বেশি অভাব।

এই আত্মবিনাশী নষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা, জ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক জীবন গড়ার পথে অগ্রসর হতে হবে। এজন্য সরকার পরিচালনাকারীদের রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ডা. লেলিন চৌধুরী ।। চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ