‘রাতের আকাশে নিশ্চুপ সাক্ষী দূরের ঐ ধ্রুবতারা’, ‘আজ সারাদিন তুমি তুমি করে কষ্টে থেকেছি আমি’, ‘জীবনটা শুধু হিসেবের যন্ত্র নয়, বেহিসেবি জীবনের মন্ত্র নয়’–সহ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের স্রষ্টা কায়েস চৌধুরীর চলে যাওয়ার আজ দুই বছর পূর্ণ হতে চলল। প্রয়াণ দিবসে নিভৃতচারী, বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল এ মানুষটির জন্য রইল অন্তরের গভীরতম শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তিনি ছিলেন নাট্যকার, নির্মাতা, চিত্রপরিচালক, শিক্ষক, অভিনেতা, ট্রেইনার, উপস্থাপক, গণযোগাযোগ ও অডিও ভিজ্যুয়াল বিশেষজ্ঞ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিষয়ক পরামর্শকসহ নানামাত্রিক পরিচয়ে অনন্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। অল্প কথায় তাকে নিয়ে কিছু বলা আমার জন্য কঠিন ও দুঃসাধ্য একটি বিষয়। তার সুবিশাল কর্মযজ্ঞকে কেবল যদি সংখ্যাগত মানদণ্ডে হিসাব করা হয়, তাহলেও তার পরিধি হবে ছোট কোনো উপন্যাসের মতো দীর্ঘ; আর গুণগত উৎকর্ষ –সেটি সময়ই নির্ধারণ করবে। স্ত্রী হিসেবে এই সৃষ্টিশীল মানুষটাকে আমি পেয়েছি এগারো বছর। সংখ্যার হিসাবে এগারো বছর দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট হলেও প্রস্থে ছিল বেশ অনন্ত। তাকে আমরা খুব কাছ থেকে দেখা ও অনুভবের সুযোগ ঘটেছিল প্রতিদিনের প্রাত্যহিকতায়। আমাদের যৌথ জীবনের টানাপড়েন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা, মত-মতভেদ, পছন্দ-অপছন্দ সকল কিছুর ঊর্ধ্বে আজ তিনি। বহুমাত্রিক এই মানুষটিকে নিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা প্রসঙ্গ আমি লিখব, তার বিস্তৃত কর্মযজ্ঞের কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরব।

নব্বইয়ের দশকে তার রচনা, পরিচালনায় প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘না’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এটি সেসময়ে সাড়া জাগানো ও দর্শক জরিপে শ্রেষ্ঠ ধারাবাহিক হিসেবে নির্বাচিত হয়। ওই সময়কার নাটক, সিনেমাগুলো অনেকটাই ‘ফুল দাও, ফুল নাও’- এ ওরিয়েন্টিড ছিল। সময়ের চাহিদা এবং সমাজ পরিবর্তনে বলা যায়, এটি ছিল আধুনিক ও সময়োপযোগী একটি সৃষ্টিকর্ম। পরবর্তীকালে এনটিভি, এটিএন বাংলা ও বৈশাখী টেলিভিশনেও এটি প্রচারিত হয়।

কায়েস চৌধুরীর সকল সৃষ্টিকর্মকে ছাপিয়ে যায় ১৯৯৫ সালে তার চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে ‘তুমি রবে নিঃশ্বাসে, তুমি রবে বিশ্বাসে’- এ তথ্যচিত্রটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন, স্বাধীনতা অর্জন, নতুন জন্ম নেওয়া এক জাতিকে জন্মলগ্ন থেকে গড়ে তোলা এবং তার বিয়োগাত্মক বিদায় নিয়ে নির্মিত এ তথ্যচিত্রটি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট ডিএফপিতে এর প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তথ্যচিত্রটি দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পরে এ তথ্যচিত্রটি বহির্বিশ্বের অনেকগুলো দেশে প্রচারিত হয়।

তার উল্লেখযোগ্য আরও একটি নির্মাণ ‘হজ পারফরমেন্স স্টাডি’ সৌদি সরকারের অর্থায়নে নির্মিত। পৃথিবীর ৬৫টি দেশে এটি প্রচারিত হয়। ‘দ্য গোল্ডেন মারিন পয়েন্ট’- এটি সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের অর্থায়নে নির্মিত হয়। তিনি সাত শতাধিক দেশি ও আন্তর্জাতিক কর্পোরেট প্রোফাইল নির্মাণ করেন। তার পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র– ‘জনগণের পালা’ (লোক-কাহিনি ও গাননির্ভর পালা), ‘নারী ও শিশু পাচার’ প্রচারিত হয় জার্মান টেলিভিশন এআরডি-১-এ। বিবিসিতে প্রচারিত হয় ‘ভাসমান যৌনকর্মী’; জাপানে প্রচারিত হয় সুন্দরবন নিয়ে ‘দ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট অ্যান্ড অ্যামাজিং ফিশিং ওয়ে’; শিশুশ্রমের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র ‘হিউম্যান মেশিন’ বিবিসিতে প্রচারিত হয়; ‘আরব ডেজার্ট লাইফ’ সৌদি আরব টেলিভিশনে প্রচারিত হয়; ‘চাইল্ড লেবার ইন বাংলাদেশ’ বিবিসিতে প্রচারিত হয়; নারীশ্রম নিয়ে তথ্যচিত্র ‘সময়ের এক ফোঁড়’ বিবিসির শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার অর্জন করে ২০০০ সালে। গ্রামীণ চেক নিয়ে নির্মিত তাঁতিদের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র ‘জীবন চরকা’ তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো তথ্যচিত্র। ‘আর্সেনিক অ্যালার্ট’ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিউবওয়েলে তোলা পানিতে আর্সেনিক উপাদানের জন্য মানুষের রোগ-শোক ও সম্পূরক বিষয়ে নির্মাণ করেন। এটি সেরা তথ্যচিত্র নির্মাণের পুরস্কার লাভ করে, আয়োজনে ছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ফোরাম নেদারল্যান্ড (২০০০)। তিনি ৬৫টি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি ১০৫টি টেলিভিশন নাটকের চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন। তার ব্যক্তিজীবনও ছিল বর্ণাঢ্য। জাতীয় পর্যায়ে তার সৃষ্টিকর্মগুলো যেন সংরক্ষিত হয় সেই দাবি রাখছি।

লেখক : কায়েস চৌধুরীর সহধর্মিণী, শিক্ষক ও নজরুল সংগীতশিল্পী