ছবি : সংগৃহীত

টানেলের কথা আসলেই প্রথমেই চলে আসবে লন্ডনের টেমস নদীর কথা। আমরা এতদিন ধরে যে টেমস নদীকে জেনে এসেছি লন্ডনের ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যের কেন্দ্র হিসেবে, সেই টেমস নদীর নিচেই পৃথিবীর সর্বপ্রথম আন্ডার ওয়াটার টানেল নির্মাণ করা হয়েছিল।

উনিশ শতকের শুরুতে (১৮০৫ সাল) টেমস নদীর উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বিভিন্ন অপশনের সাথে টানেল তৈরির পরিকল্পনা করা হয় এবং অনেকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে প্রকৌশলীরা ১৮১৪ সালে নদীর নিচে টানেল নির্মাণ করা অসম্ভব বলে মতামত দেন। কিন্তু ফরাসী প্রকৌশলী মার্ক ইসামবার্ড ব্রুনেল (Marc Isambard Brunel) এই কথা মেনে না নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান এবং একসময় ১৮১৮ সালে টানেল তৈরি করার জন্য নির্মাণ করেন ‘টানেলিং শিল্ড’ নামের যন্ত্র। এরপর আবার শুরু হয় টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা আর ১৮২৩ সালে শুরু হয় টেমস এর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণযজ্ঞ।

বহু ঘটনা, চ্যালেঞ্জ, নির্মাণজনিত ও প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায় বেশকিছু মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি পার করে ১৮৪৩ সালের ২৫ মার্চ এই টানেল মানুষের ব্যবহারের জন্য খুলে দিয়ে সূচনা হলো পৃথিবীর প্রথম আন্ডার ওয়াটার টানেল। এরপর প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়নের ফলে অনেক দেশে টানেল নির্মাণ হয়েছে আর এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশও প্রবেশ করতে যাচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সবচেয়ে আধুনিক, ব্যয়বহুল ও সংবেদনশীল সংযোগ ব্যবস্থা, আন্ডার ওয়াটার রোড টানেলের যুগে, যার নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ নামে।

১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর। এরপর প্রায় আড়াই বছর পর ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও চট্টগ্রাম নগরীর ক্রমবর্ধমান যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এই টানেল।

বাংলাদেশের সাথে বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগ আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে এই বন্দরের মাধ্যমে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই বন্দরের কাছাকাছি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে এবং আরও গড়ে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু চট্টগ্রামে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার মতো একমাত্র উপযুক্ত স্থান হচ্ছে আনোয়ারা।

আনোয়ারাতে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে সত্য কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, আনোয়ারার সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি কোনো সংযোগ নেই। বন্দর থেকে আনোয়ারা যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে দিয়ে শাহ্‌ আমানত সেতু, যা একদিকে যেমন অনেক দীর্ঘ একটা পথ অন্যদিকে আনোয়ারা ও বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট যানবাহন চট্টগ্রাম শহরের যানজট আরও বাড়িয়ে তুলবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও চট্টগ্রাম নগরীর ক্রমবর্ধমান যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এই টানেল।

এছাড়া গভীর সমুদ্র বন্দরকেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চলের জন্য সরাসরি পতেঙ্গা বা চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে আনোয়ারার সংযোগ করা প্রয়োজন। এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে আনোয়ারার সরাসরি যোগাযোগের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি ব্রিজ বা টানেলের।

কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ধরে রাখা আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন কারণ এই চ্যানেল ধরেই কন্টেনারবাহী জাহাজ মালামাল নিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাতায়াত করে। যেহেতু ইতিমধ্যেই কর্ণফুলীর ওপরে দুটি সেতু রয়েছে তাই তৃতীয় আরেকটু সেতু একদিকে নদীর নাব্যতা কমিয়ে দিতে পারে অন্যদিকে প্রবল জোয়ার-ভাটার কারণে ব্রিজের পিলার ও ফাউন্ডেশনের নিচের মাটি সরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

তাই তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হওয়া সত্ত্বেও ব্রিজ করার চেয়ে টানেল নির্মাণ করাটা অনেক বেশি টেকসই সমাধান। যদিও Cable-Stayed Bridge (কেবল স্টেড ব্রিজ) বা Suspension Bridge (সাসপেনশন ব্রিজ) নির্মাণের বিষয়টি বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়েছে কি না এবং হলে কী কী সমস্যার কারণে তা বাদ দেওয়া হলো সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

টানেলের ধারণা আমাদের দেশে এই প্রথম এবং আমাদের চালকেরা এর সাথে পরিচিত নয়। তাই টানেলের নিরাপদ ব্যবহার এবং প্রবেশ ও বের হওয়ার প্রান্তে নিরবচ্ছিন্ন যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করা এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি রাখা খুব জরুরি।

নিরাপত্তায় পুরো টানেলকে সিসি টিভি মনিটরিং করা হবে। এখন ৩৫ ফুট প্রস্থের দুই লেনের একেকটি টিউব যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬ ফুট, সেইখানে কোনো গাড়ি যদি নষ্ট হয় বা দুর্ঘটনা ঘটায় এবং সেইখানে যদি উদ্ধার কাজে ক্রেন ব্যবহার করতে হয় তাহলে পর্যাপ্ত হেডরুম না হলে তা পরিচালনা করা কষ্টকর হতে পারে।

এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক অনেক পুরোনো ট্রাক চলাচল করে যেগুলো বিকল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই টানেলে এই ধরনের পুরোনো ট্রাক প্রবেশ সীমিত করা প্রয়োজন। এছাড়া ট্রাক থেকে কন্টেইনার পড়ে যাওয়া একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। টানেলের ভেতরে এই ধরনের ঘটনা এড়ানোর জন্য টানেলে প্রবেশ করার পূর্বে কন্টেইনারগুলো সঠিক নিয়মে স্থাপন ও সংযুক্ত করা হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম শহরের ৩ বছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, মোটরসাইকেলের সাথে ট্রাক/লরির সংঘর্ষের হার বেশি। টানেলে ভারী যানের চলাচল বেশি হবে এবং মোটরসাইকেল একটি দুর্ঘটনাপ্রবণ বাহন হওয়ায় টানেলের নিরবচ্ছিন্ন চলাচল ও মোটরসাইকেল আরোহীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এর চলাচল বন্ধ রাখা জরুরি।

চট্টগ্রামে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার মতো একমাত্র উপযুক্ত স্থান হচ্ছে আনোয়ারা। আনোয়ারাতে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার মতো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে সত্য কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, আনোয়ারার সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি কোনো সংযোগ নেই...

এছাড়া দাহ্য পদার্থ ও শিল্প কারখানার রাসায়নিক দ্রব্য পরিবহনের প্রোটকল সঠিকভাবে পরীক্ষা করে টানেল ব্যবহারের অনুমতি দিতে হবে। টানেল চালু হয়ে গেলে এর প্রবেশ ও বের হওয়ার মুখে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। টানেলের পতেঙ্গা প্রান্ত একটি পর্যটন কেন্দ্র যেখানে প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী আসে যারা টানেলের সংযোগ সড়ক ব্যবহার করবে। এদের বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে চলাচল করে এবং টানেলের এই প্রান্তে পথচারী চলাচল ও পারাপারের পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এর ফলে পথচারীদের অনিয়ন্ত্রিত চলাচল একদিকে যেমন যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবে তেমনি দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলা এই ঝুঁকি বেশি।

টানেলের দুই প্রান্তে বিশেষ করে পতেঙ্গা অংশে পথচারী চলাচল ও পারাপারে ফুট ওভারব্রিজ, রেলিংসহ ফুটপাত স্থাপন করে নিরবচ্ছিন্ন পথচারী চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে প্রায় ২০০ মিটারের মধ্যে বড় দুটি সংযোগস্থল রয়েছে। এত কাছাকাছি দুটি বড় সংযোগস্থল থাকার ফলে, টানেল সংশ্লিষ্ট যান ও অন্যান্য দিকে চলাচলকারী যানের কারণে যানজট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়া যেহেতু এই টানেল দিয়ে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যান চলাচল করবে তাই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ট্রাফিক পুলিশের মতামত গ্রহণ করে আধুনিক সিগন্যাল বাতি ও প্রযুক্তি সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। টানেল ও এর সাথে সংযুক্ত সব সড়কে নির্ধারিত গতিসীমা মেনে চলা জরুরি। এজন্য ওভারস্পিড হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলা বা জরিমানা টোলের টাকা একসাথে আদায় করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

সাধারণত কোনো উচ্চগতির সড়কে গোলচত্বর থাকলে সেই গোলচত্বরের ওপরে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উঠে যায়, যার উদাহরণ আমারা যমুনা ব্রিজ এপ্রোচে দেখেছি। তাই টানেলের প্রান্তে গোলচত্বর সঠিকভাবে সাইন-মার্কিং করা এবং এর পূর্বে গতি কমানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে সড়কের গাড়ির চাপ বৃদ্ধি পাবে তাই সেই অংশ এবং কক্সবাজার সড়কের লেন বৃদ্ধি না করলে দ্রুত গতিতে অনেক গাড়ি এসে ভালো মানের সড়কের অভাবে যানজট সৃষ্টি করবে যা টানেল ব্যবহারের সুফল হ্রাস করে দিতে পারে।

৩.৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১১ মিটার দূরত্বে স্থাপিত দুই টিউবের সমন্বয়ে নির্মিত টানেল ও সাথে ৫.৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যেমন আনোয়ারার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবে তেমনি ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমিয়ে দেবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার।

শুধু দূরত্ব বা সময়ের বিচারেই নয়, এই টানেল বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়। এই প্রকল্প থেকে লব্ধ জ্ঞান আমাদের প্রকৌশলীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেবে যা সামনের দিনে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার জন্য নিয়ামক হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক (অন-লিভ), এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট; সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর, বিআইজিআরএস