ছবি : সংগৃহীত

সুন্দরবন কি এখনো দস্যুমুক্ত? আর কোনো ডাকাত দল নামেনি? নিয়মিত সুন্দরবনের খোঁজ খবর রাখেন এমন অনেকেই এই প্রশ্নটি করেন। উত্তরে বলি, সুন্দরবন দস্যুমুক্ত। এরপরের প্রশ্ন, তাহলে সংবাদ মাধ্যমে দেখি যে সুন্দরবনে আবার দস্যুতা শুরু হয়েছে? আমি বলি, দস্যুতা তৈরির চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টা সবসময়ই থাকে। কিন্তু শুরুতেই তারা ধরা পড়ে যায়।

সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত রাখতে সংশ্লিষ্টরা তৎপর আছেন বলেই দস্যুদল বড় হতে পারে না। পাঁচ বছরে দস্যুতার উদ্যোগ ছিল ৫-৭টি। তবে একটি অপচেষ্টাও স্থায়ী হয়নি। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা ধরা পড়েছে। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ার আগে কাজটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার জন্য সহজ ছিল না।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর। বাগেরহাট স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করে সুন্দরবনের ছয়টি দস্যু বাহিনী। ভিডিও কনফারেন্সের এই আয়োজনে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন হয় দস্যুমুক্ত। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন ‘দস্যুমুক্ত সুন্দরবন’। অবশ্য কয়েক বছর আগেও সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হবে তা কেউ কল্পনাও করেনি।

দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের যাত্রা শুরু ২০১২ সালে। বন-উপকূলের দস্যুতা নির্মূলে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দস্যু দমনে এটিই প্রথম সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রয়াস। র‍্যাব মহাপরিচালকের নেতৃত্বে সেই টাস্কফোর্স কাজ শুরু করে।

একের পর এক অভিযান চলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার এসব অভিযানে অসংখ্য বনদস্যুর মৃত্যু হয় বন্দুকযুদ্ধে। গ্রেফতার, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, দস্যুদের সহযোগীদের ওপর চাপ প্রয়োগসহ নানামুখী তৎপরতা চলতে থাকে। কোণঠাসা হয় সুন্দরবনের দস্যুরা।

অবাধ দস্যুতায় ভাটা পড়ে। সুন্দরবনের দস্যুরা খোলামেলা চলাফেরা বন্ধ করে দেয়। দিনের বেলা সরু কোনো খালের শেষ প্রান্তে লুকিয়ে থাকতো। রাতে চলাফেরা আর সুযোগ পেলেই সাগরে হানা দিতো জলদস্যুরা। অপহৃত জেলেদের নিয়ে ঢুকে পড়তো বনের গহীনে। সময়ের সাথে বাড়তে থাকে তাদের অত্যাচার, চাঁদার হার আর মুক্তিপণের পরিমাণ। বন-উপকূলের জেলেদের কাছে সেই সময়টি হয়ে ওঠে দুঃসহ।

বনদস্যু-জলদস্যুদের জীবনও কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারের তৎপরতায় তাদের অপকর্মের গণ্ডি ছোট হয়ে আসে। কিন্তু অত্যাচারের তীব্রতা বেড়ে যায়। সুন্দরবনের দস্যুতা নিয়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে জানতে পারি, দস্যুরাও তাদের অপরাধ জীবন উপভোগ করছে না। ঘুম, নাওয়া-খাওয়া বিহীন জীবন থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু জঙ্গলে আটকে পড়া এই অপরাধীদের ফেরার পথ নেই। মৃত্যু ছাড়া বেরুনোর পথ নেই। এরপর দফায় দফায় আত্মসমর্পণের প্রস্তাব করে তারা।

পাঁচ বছরে দস্যুতার উদ্যোগ ছিল ৫-৭টি। তবে একটি অপচেষ্টাও স্থায়ী হয়নি। এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা ধরা পড়েছে। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ার আগে কাজটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার জন্য সহজ ছিল না।

২০১৬ সালের ৩১ মে প্রথম দস্যুদলটি আত্মসমর্পণ করে। ২০১৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে সবগুলো দস্যুদল আত্মসমর্পণ করে। আভিযানিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আত্মসমর্পণের এই উদ্যোগ কাজে আসে। নানামুখী প্রতিবন্ধকতা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ সফল হয়।

আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের সমাজে পুনর্বাসন ছিল প্রথম চ্যালেঞ্জ। স্থানীয়দের সহযোগিতা, আত্মসমর্পণ করা দস্যুদের চেষ্টা ও র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় তারা পুনর্বাসিত হয়েছে। ৩২৮ জন বনদস্যুর মধ্যে তিন থেকে পাঁচজন আবার বিপথে গেছে। বাকিরা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে। কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া অনুদান ও সরকারের সুযোগ সুবিধা সেই পালে বাতাস দিয়েছে।

সর্বশেষ আত্মসমর্পণ করা জলদস্যু-বনদস্যুদের প্রতি যে প্রতিশ্রুতি ছিল সরকার তা পূরণ করেছে। হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়া অন্য মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাবেক বনদস্যুরা এখন মামলা থেকে মুক্ত। দস্যুমুক্ত ঘোষণার পাঁচ বছরের মাথায় এসে তাই বলা যায়, উদ্যোগটি একটি পর্যায় পার করেছে।

পাঁচ বছরের মাথায় এসে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সুন্দরবন দস্যুমুক্ত আছে। দস্যুতার চেষ্টা থাকবে, কিন্তু আগের সেই বিভীষিকাময় সময়ে আর ফিরবে না। বন-উপকূলের জেলেদের নিত্যদিনের দুশ্চিন্তা কেটেছে। আশা করি সুন্দরবনের মানুষদের এই নির্ভয় সময় স্থায়ী হবে।

এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। সশস্ত্র দস্যুতা শূন্যে নামলেও সুন্দরবন কি নিরাপদ হলো? পাঁচ বছর আগেও অবৈধ অস্ত্রধারীদের জন্য সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীরা ছিল অনিরাপদ। অবৈধ চোরা শিকারিদের দমনে চেষ্টা থাকলেও দস্যুদের আশ্রয়ে চলতো শিকার। এছাড়া গাছ চুরি, অভয়াশ্রমে মাছ শিকার বন্ধ করা যায়নি দস্যুদের কারণেই।

পাঁচ বছরের মাথায় এসে নিশ্চিতভাবে বলা যায় সুন্দরবন দস্যুমুক্ত আছে। দস্যুতার চেষ্টা থাকবে, কিন্তু আগের সেই বিভীষিকাময় সময়ে আর ফিরবে না। বন-উপকূলের জেলেদের নিত্যদিনের দুশ্চিন্তা কেটেছে।

বনরক্ষীরা নিজেরাই যেখানে নিরাপদ ছিলেন না সেই জায়গায় অপরাধ দমনে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ কই? তাই অবাধে চলতো অপকর্ম। বিশেষ করে খালে খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারতো না বন বিভাগ। গহীন বনে সংঘবদ্ধ সশস্ত্র দস্যুদের মোকাবিলা করার সক্ষমতাও ছিল না তাদের। কিন্তু দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে অপরাধ দমনে বাধা কোথায়?

সুন্দরবনের গর্ব রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা সুন্দরবনের বাঘ। চলতি বছরে শিকার করা একটি বাঘের চামড়া ধরা পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের হাতে। বন বিভাগের চেষ্টা আছে। তবে এখনো পুরো সুন্দরবনকে সুরক্ষিত রাখার মতো সক্ষমতা অর্জন করেনি।

গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানোর জন্য বিশেষায়িত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি আছে। বন বিভাগকে সেই সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি জনবল ও সুন্দরবনের খাল নদীতে চলার উপযোগী জলযান না থাকলে অপরাধীদের তারা ধরবে কী করে? দস্যুবিহীন সুন্দরবনে এখন যে অপরাধগুলো চলে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধটি ঘটছে নীরবে।

বিষ দিয়ে মাছ শিকার বেড়েছে অনেকটা অপ্রতিরোধ্যভাবে। শুধু তাই না, বনের ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে শুঁটকির কারবারের মতো পরিবেশ বিধ্বংসী অপরাধ বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবন বন্ধ থাকে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই মাছ শিকার, অভয়াশ্রমে মাছ শিকার ও বনের ভেতরে শুঁটকির কারবার চলেছে।

বন বিভাগের অভিযানে ধরাও পড়েছে বেশ কয়েকটি শুঁটকির ঘর। এর বাইরে কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশ ও পুলিশ কয়েক দফায় বিষ দেওয়া চিংড়ি আটক করেছে, গ্রেফতার করেছে অপরাধীদের। শুধু রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা সুন্দরবনের স্বাস্থ্যের নির্দেশক হতে পারে না। প্রতিনিয়ত বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে এই বনের প্রাণবৈচিত্র্যের নীরব মৃত্যুও ঠেকাতে হবে।

বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের জেলাগুলোয় ঝড় আর জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষা দেয় সুন্দরবন। প্রাণবৈচিত্র্যের বিবেচনায়ও সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু গুরুত্ব অনুযায়ী সুন্দরবনকে রক্ষার উদ্যোগ পর্যাপ্ত না। এই বিষয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।

আধুনিক প্রযুক্তিসহ প্রশিক্ষিত করতে হবে বনরক্ষীদের। একদম কিছুই হচ্ছে না তা না। তবে তা পর্যাপ্ত না। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ না করলে কয়েক বছরের মধ্যে সুন্দরবনের নদী-খালের জলজ প্রাণীগুলো হারিয়ে যাবে। বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য নষ্ট হলে সুন্দরবন বাঁচানো যাবে কি?

মোহসীন-উল হাকিম ।। বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন