ছবি : সংগৃহীত

যারা প্রতিনিয়ত উত্তরা থেকে মতিঝিল বা মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত যাতায়াত করেন জীবন ও জীবিকার কারণে, তাদের জীবনে ৫ নভেম্বর ২০২৩ থেকে প্রতিদিন অন্তত পক্ষে ৪ ঘণ্টা নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। প্রশ্ন আসতে পারে কীভাবে?

এটা সম্ভব হচ্ছে মেট্রোরেলের কল্যাণে, কারণ এতদিন আংশিক চলাচলের (উত্তরা থেকে আগারগাঁও) মাধ্যমে মেট্রোরেল তার সক্ষমতা ও সুবিধার আংশিক প্রমাণ করতে পারলেও এখন সুযোগ এসেছে যানজটপূর্ণ এই মহানগরীর একটি প্রধান করিডর, উত্তরা থেকে মতিঝিলের যাত্রীদের এতদিনের দুর্দশা, ক্লান্তিকর ও সময় সাপেক্ষ যাত্রার অবসান ঘটাতে।

উত্তরা থেকে মতিঝিল বা মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত যাদের যাতায়াত করতে হয়, তারা গন্তব্যে পৌঁছনোর নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে অন্তত আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা আগে ঘর থেকে বের হতে হন আর কাজ শেষ করে পুনরায় ফিরে আসতে আরও ন্যূনতম আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগে তাদের। অর্থাৎ যাতায়াতের রাস্তায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় চলে যেত। কিন্তু মেট্রোরেল চালু হওয়ার ফলে একই দূরত্বে যেতে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট (প্রাথমিকভাবে এই রুটে ৭টি স্টেশনের তিনটি চালু হবে এবং সময় লাগবে ৩১ মিনিট, আর কিছুদিন পরে ৭টি স্টেশন চালু হলে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট)।

এখন একজন যাত্রীর এই পথে যাতায়াতে যে সময় লাগত তার থেকে তিনি একবার যাতায়াতে অন্তত ২ ঘণ্টা করে আসা ও যাওয়ার মোট ৪ ঘণ্টা সময় বাঁচাতে পারবেন। শুধু এই পথে যারা নিয়মিত চলাচল করেন তারাই যে মেট্রোরেলের মাধ্যমে লাভবান হবেন তা কিন্তু নয়, বরং এই করিডরের আশেপাশে অন্তত ৫ কিমি থেকে ১৫ কিমি এর মধ্যে বসবাসকারী প্রত্যেক যাত্রী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের দৈনিক যাতায়াতের জন্য যে সময় এতদিন অপচয় করতেন তার উল্লেখযোগ্য অংশ কমাতে পারবেন।

ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডর (উত্তরা থেকে মতিঝিল)-এ মেট্রোরেলের যাত্রীদের যে শুধু সময় বা কর্মঘণ্টা বাঁচাবে তাই নয়, বরং এই সুফল নিচের সড়কে চলাচলকারী অর্থাৎ যারা মেট্রো সরাসরি ব্যবহার করছেন না তারাও পাবেন।

এতদিন পর্যন্ত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচলের সময়ে অনেক ব্যক্তিগত গাড়ি বা মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী মেট্রোতে উঠতো না কারণ কানেক্টিভিটি সম্পূর্ণ ছিল না। কিন্তু উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশে মেট্রোরেল চলাচলের কারণে অনেক ছোট বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী তার প্রাইভেট কার ত্যাগ করে মেট্রোরেল ব্যবহার করবে।

মেট্রোরেলের আরেকটি সুবিধা হলো এটা যাতায়াতের খরচ কমাতে সাহায্য করে, কারণ যানজটে যে পরিমাণ জ্বালানির অপচয় হতো তা এক্ষেত্রে হবে না। যাতায়াতের খরচ ও সময় কমে যাওয়ার কারণে পণ্য ও সেবার উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে...

এর ফলে, নিচের সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির বা মোটরসাইকেলের চাপ কমে যাবে, যা যানজট কমাতে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করবে। এছাড়া এতদিন পর্যন্ত ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে একটা বড় বাধা ছিল ভালো বিকল্প ব্যবস্থার অভাব। কিন্তু এখন ব্যস্ত ও যানজটপূর্ণ এই করিডরে মেট্রোরেল (মেট্রো-৬) এর সূচনা ও ধারাবাহিকতায় অন্যান্য মেট্রো লাইনগুলোর নির্মাণ মানসম্মত বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভূমিকা রাখবে যা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা গ্রহণে সরকারকে সাহায্য করবে। এর ফলে নিচের রাস্তায় গাড়ির চাপ কমানো সম্ভব হবে।

গাড়ির চাপ কমানো গেলে পথচারীদের হাঁটার জন্য বাড়তি জায়গা পাওয়া যাবে যা পথচারীবান্ধব শহরের জন্য প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই পূর্বক মেট্রোস্টেশনকেন্দ্রিক নিচের সংযোগ সড়ক বরাবর বাইসাইকেল লেন করে ও আধুনিক বাইসাইকেল স্ট্যান্ড নির্মাণ করে মানুষের রিকশা নির্ভরতা কমিয়া আনা সম্ভব।

অনেক ক্ষেত্রেই মেট্রোরেল স্টেশন ও তার পার্শ্ববর্তী সড়কগুলোয় রিকশার জটলার কারণে যানজট তৈরি হয়। এছাড়া রিকশাকে ক্রমান্বয়ে ঢাকার মূল সড়কগুলো থেকে তুলে ফেলা প্রয়োজন। আমরা চাইলে মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে একটি সুন্দর বাইসাইকেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে রিকশাকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করতে পারি।

মেট্রোরেলের আরেকটি সুবিধা হলো এটা যাতায়াতের খরচ কমাতে সাহায্য করে, কারণ যানজটে যে পরিমাণ জ্বালানির অপচয় হতো তা এক্ষেত্রে হবে না। যাতায়াতের খরচ ও সময় কমে যাওয়ার কারণে পণ্য ও সেবার উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে, যা একটি প্রতিযোগিতামূলক নগরায়নের জন্য প্রয়োজনীয়।

মেট্রোরেলের অন্যতম সুবিধা হলো, পরিবেশ দূষণ কমানো। পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব হলে মানুষের স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকবে তেমনি জীবনের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাবে।

মনে রাখতে হবে, মেট্রোরেল শুধুমাত্র একটা এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য রেল যোগাযোগ নয় বরং এটা একটা সিস্টেম। অর্থাৎ এই যে প্রতি ঘণ্টায় দুইদিকে লক্ষাধিক মানুষ যাতায়াত করবে মেট্রোরেল দিয়ে, তারা কীভাবে আসবে, কীভাবে তাদের গাড়ি পার্কিং করবে, কীভাবে তারা গন্তব্যে যাবে সেই বিষয়টিও মাথায় রাখা জরুরি।

মেট্রোস্টেশনকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় স্ট্রাটেজিক ক্যাচমেন্ট এরিয়া হিসেবে নির্ধারণ করে, সেই এরিয়া থেকে স্টেশনমুখী সড়ক ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে, বিশেষ করে ঐ সড়কে যানজটমুক্ত করা, ঐ এলাকার জন্য পার্কিং ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি।

একজন যাত্রী তার ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল বা সাইকেল নির্দিষ্ট জায়গায় নিরাপদে রেখে মেট্রোতে করে কর্মস্থলে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে না পারলে আমরা দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল ধরে রাখতে পারবো না।

মেট্রোস্টেশনের আশেপাশে যাতে কোনো অবৈধ দোকান, পার্কিং, রিকশার জটলা বা অন্যকোনো সমস্যা না থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন যাত্রী তার ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল বা সাইকেল নির্দিষ্ট জায়গায় নিরাপদে রেখে মেট্রোতে করে কর্মস্থলে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে না পারলে আমরা দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল ধরে রাখতে পারবো না।

মেট্রোরেলের আরামদায়ক পরিবেশ একজন যাত্রীকে ক্লান্ত করবে না এতে করে মানুষের প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে। এতদিন পর্যন্ত  মানুষগুলো যানজটে আটকা পড়ে থাকত এবং অফিসে বা কোনো মিটিং-এ কখন পৌঁছাবে তা ছিল অনিশ্চিত।

দিনের পর দিন ট্রাফিক জ্যাম, রাস্তায় শব্দ দূষণ, ধোঁয়া আর অফিসে সময়মতো না পৌঁছানোর দুশ্চিন্তায় থাকতে থাকতে নীরবে একজন মানুষ যে কখন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় তার জীবন আর জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলছিল তা তারা নিজেরাও জানতেন না।

যানজটের কারণে উচ্চ রক্তচাপ ও হার্টের অসুখের বিষয়ে অনেক গবেষণা প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (University of California)-এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা লস অ্যাঞ্জেলেসের ট্রাফিক জ্যামে দৈনিক যাতায়াত করে তাদের উচ্চ রক্তচাপের হার বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের National Institute of Health (NIH) কর্তৃক প্রকাশিত The Journal of Clinical Hypertension-এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে ৩১০ জন চালকের ওপর স্টাডি করে দেখা যায় যে, যানজট প্রবণ রাস্তায় যারা বেশি গাড়ি চালান তাদের উচ্চ রক্তচাপের হার অন্যদের চেয়ে বেশি। আরও অনেক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।

তাই আমরা এখন বলতেই পারি যে, মেট্রোরেলের কল্যাণে এই পথে যাত্রীরা যখন সময়ের হিসাবে নিশ্চিতে গন্তব্যে যাবেন তখন তাকে হয়তো আর উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কিনতে হবে না। তাই আমরা বলতেই পারি যে, মেট্রোরেল শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয়, মেট্রোরেল আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো রক্ষা করবে, স্বাস্থ্যকর জীবন উপহার দেবে।

শুরুতেই বলেছি যে, উত্তরা থেকে মতিঝিলগামী প্রত্যেক ব্যবহারকারীদের জীবনে এতদিন যে ৪ ঘণ্টা সময় শুধু রাস্তায় অপচয় হতো, সেই সময়টা এখন তারা পরিবারকে দিতে পারবেন।

মেট্রোরেলের অন্য লাইনগুলো দ্রুত চালু হোক, ঢাকায় ফিরে আসুক গতি আর আমরা ফিরে পাই যানজটের কারণে প্রায় হারাতে বসা আমাদের পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সম্পর্ক আর সুস্থ জীবন।

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক (অন-লিভ), এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট; সার্ভিলেন্স কো-অর্ডিনেটর, বিআইজিআরএস