ছবি : সংগৃহীত

তখন সন্ধ্যা সাতটা। সারা দিন কাজের ওপর গেল আজ। দশটা মিনিট সময় পেলাম না। তাড়াহুড়ো করে অফিস থেকে নেমেই গাড়িতে উঠলাম। যেতে হবে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে। ল্যাপটপ অন করতেই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) থেকে ই-মেল এলো।

বাউবি’র ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমার মতামত ও স্মৃতিচারণমূলক একটা লেখা চাওয়া হয়েছে। পুরোটাই পড়লাম। হাতে সময় মাত্র ৩/৪ দিন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ এলেই টেলিভিশন সাংবাদিকতার প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

আমি তখন গাড়িতে, একটা প্রোগ্রামে যাচ্ছি। ভাবছি, কীভাবে কী করবো? আবার, যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন; না করার সাধ্য নেই বাপু! কারণ, টেলিভিশন ক্যারিয়ারের কার্যকরী প্রশিক্ষণটা পেয়েছি বাউবি মিডিয়া সেন্টার থেকে।

গাড়ি যেতে যেতে পান্থপথের সিগন্যালে আটকে গেল। বিশাল এক জ্যাম। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ঝাপটা জানালার সামান্য ফাঁক দিয়েই মুখে এসে ঝাপটা দিচ্ছে। ডায়রির পাতা যেন আওড়াচ্ছি আমি। ভেসে আসছে প্রতিদিনের দিনলিপি।

হ্যাঁ, এমন একটা সময়েই তো আমরা দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে বনানী থেকে বাসে চেপে যেতাম গাজীপুর বোর্ড বাজারের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

দীর্ঘ পথের যাত্রা বেশ মজাই হতো! একই সাথে প্রশিক্ষণ এবং ভ্রমণ দুটোই দারুণ উপভোগ করতাম। আর বাউবি’র ক্যাম্পাসটা তখন থেকেই অসাধারণ। সবকিছু সাজানো, গোছানো। শান্ত পরিবেশ। যেন স্বর্গীয়!

সময়টা ১৯৯৯। বেশ ঘটা করে ‘একুশে টেলিভিশন’ নিউজের জন্য মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে। দেশবাসী ও দর্শকের দৃষ্টি তখন একুশের দিকে। সাংবাদিকতার নতুন, অভিনব একটি ধাপ বেসরকারি টেলিভিশন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াকালীন আমার সাংবাদিকতা শুরু। সময়ের পরিক্রমায় আজকের কাগজসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় কাজ করা। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের রমরমা অবস্থা। সেইখানে এতই কাজের চাপ যে, আমাদের প্রশিক্ষণের সুযোগ বা সময় কোনোটি বের করা সম্ভব হলো না।

রহমান ভাই তখন বললেন, ‘একই সেট-আপ আছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে। বাউবির মিডিয়া সেন্টারে যা আছে, আমাদের ২৪ ঘণ্টার স্টেশনেও এত আপডেট, দামি যন্ত্রপাতি কিংবা মেশিন নেই। আমেরিকা ইংল্যান্ডের বিবিসি, সিএনএন থেকে প্রশিক্ষিত আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক দক্ষ লোকবল রয়েছে বাউবির মিডিয়ায়।’

তখন প্রশিক্ষকরা ভাবলেন, বিটিভিতে যেহেতু হলো না তাই বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বাউবির বিকল্প আর নেই। চলো এবার অনুমতির জন্য বাউবিতে। যেই কথা সেই কাজ।

নগর জীবনের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এক গ্রামীণ পরিবেশ বাউবি। অসম্ভব সুন্দর ক্যাম্পাস! বিশাল এক মাঠ, গাছপালা আর সবুজে ভরপুর বাউবি। নির্দিষ্ট আদলে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পাসের দ্বিতল ভবনগুলো।

আমাদের চেয়ে সায়মন ড্রিং আরও বেশি বিস্মিত হলেন বাউবি মিডিয়া সেন্টারের যন্ত্রপাতি ও ভিজ্যুয়াল সেট-আপ দেখে। কী নেই এখানে! প্রফেশনাল ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, ট্রলি, এডিট প্যানেল, স্টুডিও, লাইটিং, প্রাইমারি কন্ট্রোল রুম পিসিআর, আর্কাইভ, এ্যান্টেনাসহ যাবতীয় সরঞ্জাম ও আধুনিক ডেকোরেশন সমৃদ্ধ সেন্টার।

দুই তলা বিশিষ্ট বিশাল একটি ভবন। ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে সরাসরি ট্রাক প্রবেশে বিশাল ব্যাক গেটও রয়েছে। আছে প্রশিক্ষিত দক্ষ সেট ডিজাইনার, আর্টিস্ট, ইঞ্জিনিয়ার… সব সব এখানে একসাথে।

আমরা অনেক নতুন নতুন যন্ত্রপাতি ও সরাসরি কাজের সুযোগ পাই বাউবিতেই। আমি এখনো অনুভব করি—প্রশিক্ষণ ও কাজ শেখার ক্ষেত্রে বিটিভির একমাত্র বিকল্প বাউবির মিডিয়া সেন্টার। আক্ষরিক অর্থেই যেন টেলিভিশন ভবন এমন হওয়া প্রয়োজন। 

সেই সময় এডিট প্যানেল ছিল দুইটি। ফুটেজ কেটে কেটে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভয়েজ দিয়ে কীভাবে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি হয় তা বাউবিতেই শিখি। সেইখানেই শুরু হয় আমাদের ড্রাই রান। অর্থাৎ, বাস্তব জীবনে রিপোর্টাররা কীভাবে সবকিছু হাতেকলমে শিক্ষা নেবে তারই একটি ছক বা ধাঁচ সেইখানে বাস্তবিকভাবে শেখানো হয়।

এছাড়া সংবাদ উপস্থাপনা কীভাবে করবো, কখন, কোন মুড, অঙ্গভঙ্গি সবকিছু সেইখানে দুই মাসে শিখি আমরা। এটা কিন্তু বাইরের কেউ দেখেনি। দেখেছি আমরা নিজেরা নিজেরাই। প্রশিক্ষণ শেষে ভিসি স্যারের উপস্থিতিতে আমাদের জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।

তখন একুশে টেলিভিশনের অস্থায়ী কার্যালয় বনানীর ইরেকটর হাউজের এগারো তলায়। কারওয়ান বাজারে একুশে টিভির ভবনটিতে যন্ত্রপাতি আনা হলেও সেট-আপ হয়নি তখন। তাই চলমান যন্ত্রপাতি ও মেশিন সম্পর্কে ধারণা নিতে বাউবির এই প্রশিক্ষণ যেন রক্ষাকবচ আমাদের।

একুশে টেলিভিশনে এই সময়টিতে কাজ করতে গিয়ে নানা রকম অভিজ্ঞতা হয় আমার। আমরা প্রায় ২৪ জন হই হই রই রই করতে করতে যেতাম বাউবির মিডিয়া সেন্টারে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক সায়মন ড্রিং বিবিসি থেকে নিয়ে এসেছেন বেন কোহেন, রাসেল ট্রট ও পিসগুড কে।

তবে, ক্লাসরুম বক্তৃতা শুধু নয় সাংবাদিকদের একদম হাতেকলমে শিক্ষা দিতেন তারা। প্রথম প্রথম আমাদের জন্য বিষয়গুলো বেশ কষ্টকর ছিল। তারাই শেখালেন, টিভি সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ভূমিকা প্রায় ৮৫ ভাগ।

সুতরাং, প্রযুক্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা চাই...  চাই। সাথে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের চব্বিশ ঘণ্টা সচলতা, শরীরে স্ট্যামিনা ও অসীম ধৈর্য থাকতে হবে। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই যুগ। কাজের তাগিদে পরিবর্তিত হয়েছে আমার একাধিক প্রতিষ্ঠান।

বাউবিও পার করেছে তিন দশক। ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জানাই অভিনন্দন। সোহেল, শরীফ ভাইসহ এখনো যারা ঐ মিডিয়া সেন্টারে আছেন সবাইকে শুভেচ্ছা।

একটা আফসোস এখনো কাজ করে। এত লোকবল, আধুনিক মানের ব্যয়বহুল সরঞ্জাম সমৃদ্ধ একটি মিডিয়া সেন্টার মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, এখনো প্রতিযোগিতায় কিংবা বলার মতো উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে পারেনি আজও—এটা ভাবলে কষ্ট হয়। অথচ দূরশিক্ষণসহ অসংখ্য সম্ভাবনার দুয়ার হতে পারতো মিডিয়া সেন্টারটি।

অনেক বেসরকারি টেলিভিশন প্রতিষ্ঠান এর অর্ধেকেরও কম ব্যয় করে ব্যবসা করছে। লক্ষ্য অর্জনে সফলও হচ্ছে তারা। যাক সেইসব! এর মধ্যে হারুন ভাই, কেরামত ভাইসহ অনেকেই অবসরে চলে গেছেন। নজরুল ভাই, বেলাল ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা শুনে খুব খারাপ লাগলো।

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা মাঠ, দীঘি, সারিবদ্ধ আম বাগান, ক্লান্ত দুপুরে ঘুঘু বা সন্ধ্যায় ঝিঁঝি পোকার ডাক প্রত্যেকটি বিষয়ই এখনো মনে দাগ কাটে। বাউবি ছাড়া অন্য কোথাও এত উচ্ছল, উন্মুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ আমরা পেতাম না। তখন আমরা বাউবি’র মিডিয়া সেন্টারের ঐশ্বর্য দেখেছি, স্পর্শ করেছি তার যৌবন।

সময়ের পরিক্রমায় একুশে টেলিভিশন থেকে এটিএন বাংলা এবং পরবর্তীতে এটিএন নিউজে চলে আসি। আমরা অনেক পরিবর্তিত হয়েছি। বেড়েছে বয়স, ভারিক্কি এসেছে। কিন্তু, প্রথম কোনোকিছুই ভুলবার নয়। বাউবি’র মিডিয়া সেন্টারেও আমার দিনগুলো সেই রকমই!

মুন্নী সাহা ।। গণমাধ্যমকর্মী