সরকার যদি চাইত তাহলে তারা শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানিত ও আকর্ষণীয় করতো। তা তো করেই না উল্টো প্রাথমিক শিক্ষকদের রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী বানিয়ে রেখেছে।

শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হয় তা এত সামান্য যে তারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে ভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ে যার একটি হলো ক্লাসে কম পড়িয়ে বা ইচ্ছে করে খারাপ পড়িয়ে, বেশি নম্বর দেওয়ার লোভ দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট কিংবা কোচিং-এ পড়তে বাধ্য করা। এর মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটার সাথে অর্থ জড়িয়ে যায়।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে আর সম্মানের উঁচু স্থানে রাখে না। শিক্ষকদের এইসব কর্মকাণ্ডের জন্য অনৈতিকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে আজ মহামারি আকার ধারণ করেছে।

সরকার চাইলেই শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বছর বছর না কমিয়ে বাড়াতে পারতো। ইউনেসকোর তথ্যমতে, একটি দেশের জিডিপির কম পক্ষে ৫.৫ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া উচিত সেইখানে আমরা দিয়েছি ১.৭৬ শতাংশ।

শিক্ষকরা শিক্ষকতার চেয়ে রাজনীতি বেশি করে। এর ফলে শিক্ষক নিয়োগও হয় রাজনৈতিকভাবে....

এতে কি মনে হয় সরকার শিক্ষার উন্নতিতে আগ্রহী? প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে, নতুন স্কুল-কলেজ হচ্ছে আর এর ফলে খরচ বাড়ছে কিন্তু শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে।

সরকার যদি চাইত তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি ঢুকাতো না। শিক্ষকরা শিক্ষকতার চেয়ে রাজনীতি বেশি করে। এর ফলে শিক্ষক নিয়োগও হয় রাজনৈতিকভাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন আর প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে চলে না। সেই নেতৃত্ব চলে গেছে স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাছে।

স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি নির্বাচিত হয় রাজনৈতিকভাবে। ফলে পুরো সিস্টেমটাই পচে গলে নষ্ট হয়ে গেছে। এই শিক্ষকদের দিয়ে কীভাবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন সম্ভব?

সরকার চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষকদের সেবক হিসেবে কাজ করতো কর্মকর্তা হিসেবে না। মন্ত্রণালয়ে কোনো শিক্ষক যদি যায় দেখবেন কীভাবে তার প্রতি ব্যবহার করা হয়। যতভাবে অসম্মান করা যায় ঠিক ততভাবেই করা হয়। কারও সাথে দেখা করতে চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে।

শিক্ষকদের বদলি ও প্রমোশন ওখানে। তাদের পেনশনের জন্য যেতে হয়। আর ওখানে গিয়ে অসম্মানের সীমা থাকে না। শিক্ষকরা কতটা নিগৃহীত হয় তা দেখার জন্য একদিন বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এ গিয়ে সারাটা দিন কাটালেই বুঝতে পারবেন।

সরকার যদি চাইত তাহলে বইয়ের কাগজের মান, ছাপার মান, ছবির মান, বিষয়বস্তুর মান এত নিম্নমানের হতো না। বিনামূল্যে বই এত নিম্নমানের বই আমাদের ছোট ছোট সোনামণিদের হাতে দেয় কীভাবে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন আর প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে চলে না। সেই নেতৃত্ব চলে গেছে স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাছে....

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য কয়েকটা পাঠ্যবই হাতে নিয়ে একটু দেখলাম। হাতে নেওয়া মাত্রই টের পাওয়া যায় কত অবহেলা, কত অযত্নের ছাপ বইগুলোয়। কাগজের মান, ছাপার মান, ছবির মান, প্রচ্ছদের মান দেখলেই মনে হয় এইসব বিনামূল্যে বিতরণের জন্য গরিব মানুষের লেখাপড়ার জিনিস। ফ্রি বই দেওয়া হবে বলেই এত অবহেলা? বিষয়টা এমন, তোদের এত ভালো লেখাপড়া করার দরকার কী? এমন পড়া পড় যেন এসএসসি এইচএসসি পড়েই কিছু করে খেতে পারিস।

ভালো লেখাপড়ার জন্য ভালো মানের কাগজ, ভালো বিষয়বস্তু, ভালো মানের ছাপা, ভালো মানের প্রচ্ছদ গুরুত্বপূর্ণ।

সরকার চাইলে শিক্ষকদের এমন বেতন দিত যাতে প্রত্যেক শিক্ষক তাদের সর্বোচ্চটা শ্রেণিকক্ষে দিত, কাউকে প্রাইভেট বা কোচিং পড়তে হতো না। তাতে শিক্ষার্থীরা কোচিং ও প্রাইভেটে পড়ার সময়টা খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কিংবা অন্য কিছু শেখার জন্য ব্যয় করতে পারত।

আকর্ষণীয় করার জন্য প্রথম যেই কাজটি করতে হতো তা হলো শিক্ষকদের উন্নতমানের বেতন দেওয়া। রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বা পদমর্যাদা অনুযায়ী শিক্ষকদের উচ্চতর গ্রেড দেওয়া, যাতে সমাজে সম্মানিত হয়। তারা যেন এমন বেতন পায় যাতে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ব্যতীত অন্য কোথাও অর্থের বিনিময়ে না পড়াতে হয়।

সরকার চাইলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় খুঁজে খুঁজে অযোগ্যদের ভিসিসহ অন্যান্য প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিত না। একটি উদাহরণের মাধ্যমে সবচেয়ে ভালো বোঝা যাবে বিষয়টি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারের কথা হঠাৎ আলোচনায় আসে। তিনি এক বক্তব্যে বলেন, ‘আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা, বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। যে মানুষ সরাসরি যুদ্ধ করেছে, তার স্ত্রী আমি। তাই আমি মাঠ ছাড়ার ভয় পাই না। আমার ওপরে আল্লাহ আছে, নিচে আছে শেখ হাসিনা। আমার আছে সাহিত্যপ্রেম। আল্লাহর প্রতি ভক্তি। আমি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়লে সবকিছু ভুলে যাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন চাচ্ছেন না, আপনারা আরও কিছুদিন আমাকে সহ্য করুন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তো পরের কথা—এটা কোনো শিক্ষিত মানুষের বক্তব্য হতে পারে? তার ওপর তিনি বাংলাদেশের যে ৪টি পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩ এর অধ্যাদেশ দ্বারা চালিত সেই ৪টির অন্যতম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।

তিনি কার কন্যা, কার স্ত্রী, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন কি না এইসব কি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে বা একজন ভিসির বক্তব্যে মানায়? তাহলে আমাদের সরকার কোন লেভেলের, কেমন যোগ্যতার মানুষকে ভিসি বানায় দেখুন। ভিসি নিয়োগ দেখলে কি মনে হয় শিক্ষার উন্নতির প্রতি সরকারের বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আছে?

শিক্ষায় এত এত সমস্যার মধ্যে কারিকুলাম সমস্যা সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার মানকে উন্নত করতে কারিকুলামে হাত দেওয়ার আগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে যা করা অতি জরুরি।

সেইসব জরুরি কাজ বাদ দিয়ে দুইদিন পরপর কারিকুলাম পরিবর্তন, পরিবর্ধন ইত্যাদি করার পেছনে আসল উদ্দেশ্য আসলে শিক্ষার উন্নয়ন না। সেইখান থেকে দুর্নীতি করে নিজেদের উন্নয়নই আসল উদ্দেশ্য।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়