বাংলা নববর্ষ এদেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের যে গণভিত্তি তার শিকড় সুদূর অতীতে প্রোথিত। এই উৎসবের সংযোগ আমাদের অস্তিত্ব আর অনুভূতির সঙ্গে জড়িত এবং এটি আমাদের সাংস্কৃতিক মিলন ক্ষেত্র।

বাংলা নববর্ষ উৎসব বাঙালির মানস চেতনার দিগ্বলয়। বাঙালির মানস ভুবনে বাংলা নববর্ষ দীপ্ত চেতনায় শাণিত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই উৎসব বাঙালিকে ঐক্যসূত্রে গেঁথে রাখে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলা নববর্ষে ভারত-বাংলাদেশের দুই সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে-ওপারে দুই দেশের বাঙালি এক হয়ে মিলন মেলার আয়োজন করে।

দেশভাগ হয়েছে সাতচল্লিশে। একাত্তরে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, বাংলাদেশ নামে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দুই দেশের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া বিভক্ত করতে পারেনি মিলন মেলার ভালোবাসার টান। এভাবে এ সময়ের বাংলা নববর্ষ উৎসব বাঙালির দিনযাপনকে আত্মিক সূত্রে গেঁথেছে। স্বজনহারা মানুষ মিলিত হয় স্বজনকে দেখার টানে। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের এটি একটি দিক।

বাংলা নববর্ষ উৎসব বাঙালির মানস চেতনার দিগ্বলয়। বাঙালির মানস ভুবনে বাংলা নববর্ষ দীপ্ত চেতনায় শাণিত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই উৎসব বাঙালিকে ঐক্যসূত্রে গেঁথে রাখে।

এই উৎসব এখন শুধু উৎসবের আনন্দ মাত্র নয়। দূরে চলে যাওয়া স্বজনকে দেখার টান একদিকে যেমন প্রবল, অন্যদিকে চোখের জলও এই টানকে বেদনাঘন করে। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসে অনেক সময় দেখা পাওয়া যায় না সেই মানুষটির, যার জন্য সারা বছরের অপেক্ষা ছিল। হয়তো অসুস্থতার কারণে আসা হয় না, কিংবা কোনো জরুরি কাজে আটকে যেতে হয়। কান্না-হাসিতে মিলন মেলা আবেগঘন হয়ে ওঠে। আমরা এই আবেগে এই আয়োজনকে গৌরবের জায়গায় দেখতে চাই। মানুষের আবেগের জায়গা থেকে মানুষকে দিনযাপনের পূর্ণতায় ধরে রাখতে দেখতে চাই। সেজন্য আয়োজকদের অভিনন্দন জানাই।

আমরা নববর্ষের উৎসব ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার উৎসব হিসেবে দেখতে চাই। কয়েক শতাব্দী ধরে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ আয়োজিত রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনা মানুষ ভুলে যায়নি। পরের বছরই বিপুল জনস্রোতে ভরে গেছে শহরের রাস্তা। মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্ণিল করেছে উৎসবের আয়োজন। এই উৎসব থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। ক্রমাগত এর সমৃদ্ধি ঘটিয়ে নিজের বিকাশকে উজ্জ্বল করবে।

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সামাজিক বন্ধন এই উৎসবকে প্রবল নিবিড়তায় ভরিয়ে তোলে। সেজন্য বাংলা নববর্ষ বাঙালির জীবন সত্য অনুভবের উৎসব।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘উৎসব’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সংসারে প্রতিদিন আমরা যে সত্যকে স্বার্থের বিক্ষিপ্ততায় ভুলিয়া থাকি উৎসবের বিশেষ দিনে সেই অখণ্ড সত্যকে স্বীকার করিবার দিন-এই জন্য উৎসবের মধ্যে মিলন চাই। একলার উৎসব হইলে চলে না। বস্তুত বিশ্বের সকল জিনিসকেই আমরা যখন বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখি, তখনই এই সত্যকে আমরা দেখিতে পাই না—তখনই প্রত্যেক খণ্ডপদার্থ প্রত্যেক খণ্ডঘটনা আমাদের মনোযোগকে স্বতন্ত্ররূপে আঘাত করিতে থাকে। ইহাতে পদে পদে আমাদের চেষ্টা বাড়িয়া উঠে, কষ্ট বাড়িয়া যায়, তাহাতে আমাদের আনন্দ থাকে না। এই জন্য আমাদের প্রতিদিনের স্বার্থের মধ্যে, স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে পূর্ণতা নাই, পরিতৃপ্তি নাই, তাহার সম্পূর্ণ তাৎপর্য পাই না, তাহার রাগিণী হারাইয়া ফেলি—তাহার চরম সত্য আমাদের অগোচরে থাকে। কিন্তু যে মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা খণ্ডকে মিলিত করিয়া দেখি, সেই ক্ষণেই সেই মিলনেই আমরা সত্যকে উপলব্ধি করি এবং এই অনুভূতিতেই আমাদের আনন্দ।’

এই বছরে করোনার কারণে বাংলা নববর্ষ উৎসবমুখর থাকবে না এটা একটি দিক। তারপরও প্রত্যেকের রঙিন বলয় মনুষ্যত্বের সাধনায় থাকবে।

সেলিনা হোসেন ।। কথাসাহিত্যিক, বঙ্গবন্ধু চেয়ার, বিপিএটিসি, সাভার