ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলার কথা। ভোটের সময় এলেই আমি অপার হয়ে থাকতাম মিছিল দেখার জন্য। কোন দলের মিছিল, প্রার্থী কে তা প্রধান বিষয় ছিল না আমার কাছে। আমার ভালো লাগতো মিছিলের গগনবিদারী স্লোগান। ভালো লাগতো বাহারি রঙের পোস্টার।

হ্যাঁ, এখন নির্বাচনের সময় সাদা কালো রঙের পোস্টার করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় দেখতাম বাহারি সব চার রঙের পোস্টার! মিছিলে কিছু মানুষ থাকতেন—যারা প্রিয় নেতার নামে স্লোগান দেওয়ার সময় এই জগৎ সংসার, আশপাশের পরিবেশ প্রতিবেশ সবকিছু ভুলে যেতেন। নেতার নামে, আদর্শের নামে—এই মানুষগুলো একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেতেন। যতদিন নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা চলতো ততদিন সেই অপার্থিব ঘোর থেকে তাদের কিছুতেই বের করা যেত না।

তারা যেকোনো রাজনৈতিক দলের নেতা কিংবা কর্মী তা নয়। এরা ছিলেন নিতান্তই সমর্থক। প্রিয় নেতার নামে জীবন উৎসর্গ ছিল তাদের। টাকা পয়সা কিংবা ব্যক্তিগত কোনো সুযোগ সুবিধার আশায় তারা মিছিলে আসতেন না, জনসভায় অংশ নিতেন না। শুধুমাত্র ভালোবাসা থেকে প্রিয় নেতা, প্রিয় দলের জন্য পাগল হয়ে কাজ করতেন তারা।

আবার ভোট শেষ হয়ে গেলে, তারা হয়তো নেতার কাছেও যেতেন না। রাজনীতির আলাপেও এদের দেখা যেত না। নিত্যদিনের খুব স্বাভাবিক আটপৌরে জীবনে ফিরে যেতেন। ছোটবেলায় দেখা এই রকম বেশ কয়েকজন মানুষকে এখনো আমি সময় পেলেই খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি। কথা বলি তাদের সঙ্গে।

এরা এখনো আগের মতোই সহজ সরল আছেন। যেমনটা আমি দেখেছিলাম ছোটবেলায়। অথচ এই দুই আড়াই দশকে রাজনীতি পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেকটাই। শুধু রাজনীতি কেন পরিবর্তন তো এসেছে গোটা সমাজেই।

পাঁচ বছর পর নিময়মাফিক আবারও এসেছে ভোটের মৌসুম। শহর থেকে নগর, মফস্বল থেকে গ্রাম—ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রান্তর জুড়ে বাজছে ভোটের দামামা। আসছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কার গলায় পড়ছে বিজয় মালা। কোথায়, কার সঙ্গে হবে কার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, চলছে চায়ের কাপে ঝড়।

পাঁচ বছর পর নিময়মাফিক আবারও এসেছে ভোটের মৌসুম। শহর থেকে নগর, মফস্বল থেকে গ্রাম—ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রান্তর জুড়ে বাজছে ভোটের দামামা। আসছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে কার গলায় পড়ছে বিজয় মালা....

ভোট মানেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক সর্বজনীন উৎসব। বাংলাদেশের বলছি, কারণ জনগণ দেশের মালিক। প্রজাতন্ত্রের মালিকদের সত্যিকারের মালিকানা উপভোগের দিন—ভোট। দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে শুরু করে একেবেরে প্রান্তের মানুষ—সবারই আছে ভোটের অধিকার।

শুরুতে বলছিলাম, একটা সময় ছিল ভোট মানেই চায়ের দোকানে তুমুল আড্ডা। প্রিয় প্রার্থী কিংবা দলের পক্ষে যুক্তি পাল্টা যুক্তির তুবড়ি ছোটানো। কথার তোড়ে উজাড় হতো কাপের পর কাপ চা। আবার কথার উত্তাপে তাপ হারিয়ে শীতল হয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিতেও ভুলে যেতেন মানুষ।

এখনো আশেপাশে খেয়াল করলে চোখে পড়ে সেই চিত্র। শহর গ্রাম সবখানেই। তবে সেই চিরাচরিত ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাল আমলের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মানুষের নিত্যদিনের উৎসব, আনন্দ, বেদনা, মিলন, বিরহ সঙ্কট—সবই উঠে আসে এখন অন্তর্জাল দুনিয়ায়।

অনেকগুলো প্ল্যাটফর্মকে এক সঙ্গে আমরা বলি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ভোটের উৎসব, ভোটের প্রচারণা কিংবা ভোটের খবর সবই জায়গা করে নিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। ফেসবুক, এক্স কিংবা ইনস্টাগ্রামের পাতায় নজর রাখলে চোখে ভাসে প্রিয় নেতা কিংবা দলের জন্য শুভকামনা অথবা ভোট প্রার্থনা।

নির্বাচনে লড়ছেন যারা, সেই প্রার্থীরাও জমজমাট প্রচারণা করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সবই যুগের দাবি। সময়ের সঙ্গে সমাজ সংস্কৃতি মানুষের অভ্যাস এবং জীবনাচরণে পরিবর্তন অনিবার্যভাবেই আসে। পরিবর্তন এসেছে ভোট উৎসবের ধরণেও। কিন্তু আমেজটা, ভেতরগত তাগিদটা বরাবরের মতোই চিরন্তন। এখনো দেশের মানুষ ভোট এলে অপেক্ষার প্রহর গোনেন ভোটের দিনের জন্য। ধনী, গরিব, ধর্ম, শ্রেণি নির্বিশেষে সবার এক কাতারে হওয়ার দিন।

এই যে বললাম, সবার এক কাতারে হওয়ার দিন। আদতে কি তাই হতে পারছেন দেশের মানুষ। এই যে তফসিল ঘোষণার পর থেকে টানা হরতাল-অবরোধ করে যাচ্ছে একটি রাজনৈতিক মহল। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্নস্থানে পুড়ছে যানবাহন। পুড়ছেন মানুষ। পুড়ছে অনেক মানুষের স্বপ্ন।

নির্বাচনে লড়ছেন যারা, সেই প্রার্থীরাও জমজমাট প্রচারণা করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সবই যুগের দাবি। সময়ের সঙ্গে সমাজ সংস্কৃতি মানুষের অভ্যাস এবং জীবনাচরণে পরিবর্তন অনিবার্যভাবেই আসে। পরিবর্তন এসেছে ভোট উৎসবের ধরণেও।

এক ধরনের চাপা আতঙ্ক নিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন মানুষ। এসব কি কোনো রাজনৈতিক দলের কিংবা জোটের কাছ থেকে আশা করা যেতে পারে? আবার ভোট নিয়ে কিংবা ভোটের সময়ের সরকার নিয়ে এই যে আন্দোলন, এর পেছনেও কি একেবারেই যুক্তি নেই? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করেছে এখনকার আন্দোলনকারীরা। তাদের একগুঁয়েমি আচরণের কারণে গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেছে দুই বছর। সবই ঠিক। কিন্তু গেল দুটি নির্বাচন কি প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছি আমরা?

নির্বাচনকালে কোন সরকার থাকবে—তত্ত্বাবধায়ক নাকি দলীয় সেই বিতর্কে যেতে চাই না। তা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা ঠিক করুক। কিন্তু আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারবেন না। বাসে আগুন দেবেন না। দেশের সম্পদ নষ্ট করবেন না। এই আকুতি সবার কাছে।

দেশের মানুষ গণতন্ত্র ভালোবাসে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যও লড়াই করেছে দেশের মানুষ। রাজপথে প্রাণ দিয়েছে অকাতরে। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত দেশের ওপর চেপে বসেছিল দু’দুটো সামরিক শাসন। সামরিক সরকারের যাঁতাকল থেকে উদ্ধার করেছেন দেশের মানুষ। নেতৃত্ব দিয়েছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। ভোটের উৎসবে সেই রাজনৈতিক দলগুলোই সাধারণ মানুষকে শামিল করবে সেই প্রত্যাশা রাখি।

আজকের তরুণ প্রজন্ম রাজনীতি বিমুখ—এমন একটা কথা ইদানীং বাজারে খুব চলছে। আমি বলি তরুণ প্রজন্ম পুরোটাই রাজনীতি বিমুখ না। তরুণদের একটা অংশ রাজনীতি বিমুখ। কিন্তু তা কেন? সেই বিষয়ে অনুসন্ধানও জরুরি। দেশে এখন একটা শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা এই দেশে আয় উপার্জন করে, খরচ করে-বিনিয়োগ করে অন্যদেশে।

এই শ্রেণিটাই মূলত আমাদের তারুণ্যের একটা অংশকে রাজনীতি বিমুখ হতে প্রলুব্ধ করে। কারণ রাজনীতিহীনতা কিংবা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখলে এদের লাভ। তখন গাছেরও খাওয়া যায়, তলারও কুড়ানো যায়। তবে আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার অদম্য আকাঙ্ক্ষা ও প্রবল ইচ্ছার কাছে এরা টিকবে না। জয় হবে সম্মিলিত শুভবুদ্ধির। চিন্তার জাগরণে ঘুচে যাবে সুবিধাবাদের অন্ধকার।

৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। ভোট উৎসবে সবাইকে আমন্ত্রণ। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিন। স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রত্যাখ্যান করুন।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী