ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি)-এর বাংলা বিভাগ ২০০৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত ‘গ্রেটেস্ট বেঙ্গলিজ অফ অল টাইমস’ শিরোনামে এক জরিপ পরিচালনা করে। বিবিসি’র বাংলাভাষী শ্রোতারা যারা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে আছে, তারা এই জরিপে অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যাশিতভাবেই ২০ জন মহান বাঙালির তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রথম স্থানেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের জন্য পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় উৎসব। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণেই নববর্ষের ঐতিহ্য পেয়েছে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা। পৃথিবীর অনেক দেশেই বাঙালিদের বসবাস। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যতীত কোনো দেশেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করে। এরপর থেকেই নববর্ষ উদযাপনের মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর স্বাধীন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ জাতীয় উৎসব হিসেবে সবার মাঝে আত্মিক সংযোগ বহন করে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা কীভাবে এসেছে, তা ভুলে গেলে চলবে কেন? কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে পহেলা বৈশাখ আঞ্চলিক অনুষ্ঠান হিসেবে হয়তো পালিত হোত, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কখনো পেত না।

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করে। এরপর থেকেই নববর্ষ উদযাপনের মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর স্বাধীন বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ জাতীয় উৎসব হিসেবে সবার মাঝে আত্মিক সংযোগ বহন করে চলেছে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে যে দেশটি আজ প্রতিষ্ঠিত তার অবয়ব তৈরির কাজটি করেন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের প্রেক্ষিতে লাখ লাখ বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার প্রচেষ্টা চালায়। গোটা দেশ রণাঙ্গনে পরিণত হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ প্রাণ এবং ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি প্রতীক্ষিত সেই স্বাধীনতা।

বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ যার রূপকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা পরবর্তী বর্ষবরণ উৎসব জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। সেই সময় থেকেই দিনটি সরকারি ছুটির দিন। আজ বাংলাদেশ না থাকলে পহেলা বৈশাখ কোনোদিন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেত না।

নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গানের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের বকুল তলার প্রভাতী অনুষ্ঠানেও নববর্ষকে সম্ভাষণ জানানো হয়। এখানকার চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের আহ্বানকে করে তোলে নয়নাভিরাম এবং গভীর আবেদনময়। এ শোভাযাত্রা উপভোগ করে সব শ্রেণির মানুষ।

বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ যার রূপকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা পরবর্তী বর্ষবরণ উৎসব জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। সেই সময় থেকেই দিনটি সরকারি ছুটির দিন। আজ বাংলাদেশ না থাকলে পহেলা বৈশাখ কোনোদিন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেত না।

বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি, নজরুল ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, নজরুল একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটসহ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পহেলা বৈশাখের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। এছাড়া সংবাদপত্রগুলোতে বঙ্গাব্দ, নববর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধসহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে বৈশাখের দিন সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়।

১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এছাড়াও সকল জেলা শহরে এবং গ্রামে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে পশ্চিমের আকাশ যখন রক্তিম আলোয় সজ্জিত উৎসবে, যখন লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলো।

আজ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র আছে বলেই আমরা বলতে পারি নববর্ষ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। সারাদেশ এক হয়ে যায় নববর্ষের রং-এ। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা নববর্ষ উদযাপন করে। কিন্তু ভারতে বাংলা নববর্ষ রাষ্ট্রীয় কোনো দিবস নয়। সেখানে নববর্ষ বাঙালিদের ঐতিহ্য হতে পারে, সমগ্র ভারতীয়দের জন্য নয়। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাঙালিরা দিনের কাজের মধ্যে কিছু সময় হয়তো পালন করে নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতার জন্য। না পায় তারা কোনো ছুটি কিংবা না পায় অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্য আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। নববর্ষকে বলতে পারছি বাঙালিদের ঐতিহ্য কিংবা বাংলাদেশের অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর দেশে সবার জন্য শুভ হোক বাংলা নববর্ষ।

রিয়াজুল হক ।। যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক