ছবি : সংগৃহীত

বিএনপি অনেক বছর ধরেই নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে তারা সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করে। ফলে তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। একদফা আন্দোলনের শুরুতে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ থাকলেও ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংসতার পর পাল্টে যায় পরিস্থিতি।

প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হাসপাতালে হামলার পর পণ্ড হয়ে যায় বিএনপির মহাসমাবেশ। সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির সক্রিয় প্রায় সব নেতা এবং বিপুল সংখ্যক কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

যারা গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছিলেন, তারা সবাই গা ঢাকা দেন। ফলে সাময়িকভাবে হলেও বিএনপি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে পরিণত হয়। ২৮ অক্টোবর ২০২৩-এর পর থেকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ গোপন জায়গা থেকে রুটিন মেনে হরতাল বা অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করতেন।

ঘোষিত কর্মসূচির আগের দিন সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তরা কয়েকটি যানবাহনে আগুন দিত। ব্যস, এইটুকুতেই শেষ তাদের দায়িত্ব। হরতাল বা অবরোধ সফল করার জন্য ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে কিছু ঝটিকা মিছিলও হতো। জনগণ তাদের এই কর্মসূচিতে সাড়া দেয়নি।

দেড়মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা হরতাল-অবরোধ মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। বিএনপির ডাকা হরতাল-অবরোধ এখন আর জনজীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। তাই বিএনপি সহিংসতার মাত্রা আরেক দফা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাসে আগুন দিয়ে তাদের পোষাচ্ছিল না তাই এখন তারা ট্রেনে আগুন দেওয়ার কৌশল বেছে নিয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ভোরে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দেওয়া আগুনে মারা গেছেন চারজন।

সহিংসতায়ও তাদের পোষাচ্ছে না তাই এখন বিএনপি অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি আসলে একটি রিমোট নিয়ন্ত্রিত আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। লন্ডন থেকে কর্মসূচি আসে এবং ঢাকার গোপন জায়গা থেকে তা ঘোষণা করা হয়।

ধরুন, তারেক রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারি কর্মচারীরা যদি সরকারের নির্দেশ না মানে এবং সরকার যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তারেক রহমান কি তাদের পাশে দাঁড়াবেন? কীভাবে দাঁড়াবেন? তিনি তো দেশেই নেই...

তবে অসহযোগ যেহেতু বড় কর্মসূচি তাই, লন্ডন থেকেই আসে প্রথমে এর ঘোষণা। পরে ঢাকার গোপন জায়গা থেকে রুহুল কবির রিজভী তার পুনরাবৃত্তি করেন। বিএনপির লন্ডন কানেকশনটা আপনাদের সবারই জানা নিশ্চয়ই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জীবনে কখনো রাজনীতি করবেন না, এই মুচলেকা দিয়ে লন্ডন চলে গিয়েছিলেন। তারপর বুড়িগঙ্গা ও টেমসে অনেক জল গড়িয়েছে। কিন্তু তারেক রহমান আর দেশে ফেরেননি।

এরমধ্যে অন্তত তিনটি মামলায় কারাদণ্ড হয়েছে তার। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন। তারেক রহমান এখন পলাতক আসামি। তিনি লন্ডনে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপির রাজনীতি।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মেয়াদের ক্ষমতায় দল ও সরকারের মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল বেগম খালেদা জিয়ার হাতে। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত মেয়াদে মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল তার ছেলে তারেক রহমানের হাতে।

হাওয়া ভবন ছিল ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র। যে কেউই মানবেন প্রথম মেয়াদের তুলনায় দ্বিতীয় মেয়াদ ছিল অনেক খারাপ। এখন বিএনপির রাজনীতির একক নিয়ন্ত্রণ তারেক রহমানের হাতে। মানতেই হবে বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে।

২৮ অক্টোবর ২০২৩-এর পর থেকে হরতাল-অবরোধের মাধ্যমেই আন্দোলন চলছিল। কিন্তু ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ দুপুর ১২টার দিকে ফেসবুক লাইভে তারেক রহমান ‘এই মুহূর্ত থেকে সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ’-এর ডাক দেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের সরকারের নির্দেশ না মানা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন না করা, ভোটারদের কেন্দ্রে না যাওয়া, খাজনা-ট্যাক্স-ইউটিলিটি বিল না দেওয়া, ব্যাংকে টাকা না রাখা ও লেনদেন না করার নির্দেশ দিয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ যাতে আদালতে কোনো মামলায় হাজিরা না দেন।

এই নির্দেশ মানতে গিয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া সাংগঠনিক ও সরকারিভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হবে। তারেক রহমানের অসহযোগ ঘোষণার কিছুক্ষণ পর রুহুল কবির রিজভীও অসহযোগের ডাক দেন।

সরকার পতনের একদফা দাবি আদায়ে বিএনপি নানা কর্মসূচি ঘোষণা করতেই পারে। কিন্তু সেই কর্মসূচি হতে হবে বাস্তবতার নিরিখে এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে। এখনকার বাংলাদেশের যে বাস্তবতা, তাতে বিএনপি একটা হরতাল সফল করতে পারে না, তাদের ডাকে মানুষ অসহযোগ করবে কোন ভরসায়?

লন্ডনের নিরাপদ আশ্রয় থেকে তারেক রহমানের এই অসহযোগের ডাক বাংলাদেশের মানুষ, এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেও হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।

ধরুন, তারেক রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারি কর্মচারীরা যদি সরকারের নির্দেশ না মানে এবং সরকার যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তারেক রহমান কি তাদের পাশে দাঁড়াবেন? কীভাবে দাঁড়াবেন? তিনি তো দেশেই নেই। এটা না হয় অনেক দূরের কথা। আমি যদি এখন তারেক রহমানের নির্দেশ মেনে পানি-বিদ্যুৎ, গ্যাসের বিল না দেই; সরকার যদি আমার লাইন কেটে দেয়; তাহলে আমি কীভাবে চলবো?

ব্যাংকে টাকা না রাখলে আমার টাকার নিরাপত্তা কে দেবে? বিএনপি ক্ষমতায় এলে আমি ক্ষতিপূরণ পাবো? কিন্তু ততদিন আমি কীভাবে চলবো? বিএনপি কবে ক্ষমতায় আসবে, তা কি তারেক রহমান জানেন?

লন্ডনের নিরাপদ আশ্রয় থেকে তারেক রহমানের এই অসহযোগের ডাক বাংলাদেশের মানুষ, এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেও হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। দেশের একজন মানুষও এই ডাকে সাড়া দেবে, এমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

শুধু অসহযোগ নয়, তারেক রহমান লন্ডনে বসে প্রায়ই নেতাকর্মীদের নানা ঝুঁকির মুখে ফেলেন। তার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে অনেককে জেলে যেতে হয়। কিন্তু তিনি থাকেন দূরে, নিরাপদে।

বিএনপির নেতাকর্মীদের চাওয়া হলো, তাদের নেতা দেশে আসুক। সাজার বিরুদ্ধে আপিল করুক। প্রয়োজনে কারাগারে যাক। রাজনীতি করতে হলে জেল-জুলুমের ভয় পেলে চলে না।

তারেক রহমানের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে মির্জা ফখরুলের মতো প্রবীণ নেতা দিনের পর দিন কারাভোগ করছেন আর তারেক রহমান লন্ডনে বসে দল চালাচ্ছেন; এটা শোভন নয়।

তারেক রহমান দেশে ফিরে অসহযোগের ডাক দিক, তখন দেশের মানুষ বিবেচনা করে দেখবে। নইলে জনগণ বিপদে ফেলার জন্য জনগণের বিরুদ্ধে ডাকা এই অসহযোগ কেউ মানবে না। বিএনপির হরতাল-অবরোধের মতো অসহযোগও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ