ছবি : সংগৃহীত

৭ জানুয়ারির আগে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করছে অংশগ্রহণকারী দলগুলো। বিএনপি ও তার সাথের দলগুলো যেহেতু নির্বাচন বর্জন করছে তাই সবার আগ্রহ কেবল আওয়ামী লীগের ইশতেহার নিয়ে। কারণ নিশ্চিতভাবেই চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে এখনকার শাসক দল।

প্রস্তাবিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব যখন নির্বাচনী পোস্টারে লেখেন যে, জাতীয় পার্টি মনোনীত এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী, তখন সেই দল আর তার ইশতেহার নিয়ে কোনো আগ্রহ থাকে না।

ইশতেহার মানে প্রতিশ্রুতি। জনগণের রায় পেয়ে ক্ষমতায় গেলে যা যা করা হবে তার একটা তালিকা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ভোট বাড়ে কি না, বাড়লেও কীভাবে বাড়ে, তা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্ন। ভোট যদি ভোটের মতো হয় তাহলে ইশতেহার নিয়ে বড় আলোচনাই হয়।

ইশতেহার তথা প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতাও বড় প্রশ্ন। কিন্তু তবুও ইশতেহার আসে প্রতি নির্বাচনেই। এটা যেন অনেকটা নির্বাচকদের কাছে প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চিরাচরিত নির্বাচনী দায়। কতখানি সত্যি বা বাস্তবসম্মত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে সেইটাই শেষ কথা নয়।

এবারের নির্বাচনে একমাত্র দল আসলে আওয়ামী লীগ। তাই তার ইশতেহার নিয়েই কথা হবে সব জায়গায়। ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ঘোষিত ইশতেহারে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ একটি বহুল আলোচিত শ্লোগান। অনেক কাজও হয়েছে এই খাতে। কিন্তু মানুষের মাঝে ব্যাপক সমালোচনা আছে ইন্টারনেটের গতি নিয়ে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ইন্টারনেট গতি মাপার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলা (Speedtest by Ookla) জানায় বিশ্বের ১৪৩ দেশের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। মোবাইল ও ফিক্সড ব্রডব্যান্ড উভয় শ্রেণিতেই গতি নিচের দিকে। স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে এই বিষয়টির সমাধান কীভাবে করা হবে তা দেখার অপেক্ষায় থাকছি আমরা।

তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলো প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করছে। লিজিং ও ফিন্যান্স কোম্পানিগুলোয় লুটপাটের নানা কাহিনি সবার জানা। সরকারের চোখের সামনেই ঘটেছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কাহিনি।

ইশতেহারে বলা হয়েছে দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে। কয়েক বছরে সবচেয়ে বড় আলোচনা এই দ্রব্যমূল্য। শেখ হাসিনার সরকার অনেক উন্নয়ন করলেও নিত্যপণ্যের দামের অতি উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে রেখেছে।

গুটি কয়েক ব্যক্তিখাতের কোম্পানি তাদের ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে জনগণকে নিঃস্ব করছে। সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরাই বলেছেন, কিন্তু ব্যবস্থা সেইভাবে নেওয়া হয়নি। বলা যায় ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ ভয়ংকর কষ্টের ভেতর দিয়ে পার করেছেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আঘাতে। দেখা যাক নির্বাচনের পরে কী ব্যবস্থা হয় এর রাশ টেনে ধরতে।

আর্থিক খাতে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি আছে এবং সেইটি খুবই জরুরি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও অপরাধ দমনের কথা বলতে গিয়ে পুঁজি পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে শাসক দল কার্যত দেশে থেকে যে, পুঁজি পাচার হচ্ছে সেইটা স্বীকার করে নিলো।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে মালিক শ্রেণির দৌরাত্ম্য চলছে। একক ব্যক্তির হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে এই খাত এবং অবাধে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া ও পাচারের সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছে। ডলার–সংকটের পাশাপাশি দেশের ব্যাংকগুলো এখন টাকার সংকটেও ভুগছে (প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩)।

তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলো প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করছে। লিজিং ও ফিন্যান্স কোম্পানিগুলোয় লুটপাটের নানা কাহিনি সবার জানা। সরকারের চোখের সামনেই ঘটেছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কাহিনি। লুটে নেওয়া হয়েছে বেসিক ব্যাংক, শেষ করে দেওয়া হয়েছে ফার্মারস ব্যাংক। আরও অসংখ্য কাহিনি লোকের মুখে মুখে।

সম্প্রতি অনিয়ম আর দুর্নীতি ঠেকাতে ভেঙে দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রয়োগের কথা আছে ইশতেহারে। আমাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে যে, এটা কি আসলেই করা হবে, নাকি কেবলই কথার কথা হিসেবে থেকে যাবে?

দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, কর্মোপযোগী শিক্ষা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের প্রতিশ্রুতিগুলো তখনই আলোর মুখ দেখে যখন রাষ্ট্রীয় সুশাসন বজায় থাকে। শাসন ব্যবস্থায় মানুষের ভাবনা না থাকলে এগুলো সবই দিন শেষে গালভরা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়।

ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আছে। দেশে যে লাগামহীন দুর্নীতি চলছে সেইটার এক প্রকার স্বীকৃতি এই প্রতিশ্রুতি।  কিন্তু কীভাবে কমানো হবে? প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে যে দুর্নীতি হয় তার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আমলাতন্ত্রের যে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন তা কি করা যাবে? রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যে আমলাতন্ত্রের যোগসাজশ সেইটা বন্ধ করা সম্ভব হবে?

দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, কর্মোপযোগী শিক্ষা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের প্রতিশ্রুতিগুলো তখনই আলোর মুখ দেখে যখন রাষ্ট্রীয় সুশাসন বজায় থাকে। শাসন ব্যবস্থায় মানুষের ভাবনা না থাকলে এগুলো সবই দিন শেষে গালভরা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়। সংসদ যদি সব বিষয়ে জনগণের পক্ষে বিতর্কের কেন্দ্র না হয় তাহলে প্রতিশ্রুতি পূরণের দায়ও সেইভাবে থাকে না, এটাই বাস্তবতা।

এই ইশতেহারে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা আছে। কিন্তু দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে গেছে। কারণ, বিদেশিরা এ দেশে নতুন বিনিয়োগে তেমন আস্থা পাচ্ছেন না।

ব্যবসা সহজীকরণে পিছিয়ে থাকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, তথ্যের ঘাটতি, দক্ষ শ্রমিকের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশিরা এই দেশে মূলধনি বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।

স্বদেশি ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগও স্থবির বহু বছর ধরে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশে উন্নীত করার কোনো প্রচেষ্টাই সফল হয়নি।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় দলের প্রতিশ্রুতি আর মানুষের প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান সবসময়ই আকাশ-পাতাল। তবে একথা ঠিক যে, সরকার ভর্তুকি, জনমুখী আর্থিক সাহায্য অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চালিয়ে যাচ্ছে।

গড় মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সূচক দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও একই সঙ্গে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে সম্পদবৈষ্যম। এই ধারা অব্যাহত থাকায় ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। সম্পদ বৈষম্যের এই প্রবণতা রোধ করতে হলে যেসব রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কারণে এসব বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের নীতি-কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা জরুরি।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন