সন্ত্রাসীরা সাংবাদিকদের খুন করে। রাজনীতিবিদ,আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুযোগ পেলে সাংবাদিকদের নামে মামলা দেয়। আবার কথায় কথায় রাজপথে সাংবাদিক পেটায়। এদেশে বরাবরই নানাভাবে হামলা মামলার শিকার হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। সন্ত্রাসী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এমনকি রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত সুযোগ পেলে সাংবাদিকদের ওপর ঝাল মেটায়। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কাউকে ছাড় না দিয়ে একজন সাংবাদিককে ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখতে হয়। আর তাতেই ক্ষেপে যান সংশ্লিষ্টরা। কখনো জীবন কেড়ে নেওয়া, কখনো শরীরে হামলা, আবার প্রায়শই মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে সাংবাদিকদের। সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, নির্যাতন, নিপীড়ন এখন শুধু রাজধানী ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কারণে-অকারণে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করা হচ্ছে, সাংবাদিক খুন হচ্ছে।

গত ১৬ এপ্রিল সর্বশেষ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে লালমনিরহাটে। একে-৪৭ টাইপের ভারী মেশিনগান তাক করে তিন বিজিবির জওয়ান দাঁড়ানো। তাদের সামনে কোমরে দড়ি ও হাতে হাতকড়া দেওয়া একজন বিজ্ঞ সাংবাদিক। সামনে এক বোতল ফেনসিডিল রাখা। এভাবেই দৈনিক জনকণ্ঠের লালমনিরহাট ও বাসস প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম শাহীনকে গ্রেফতার দেখিয়ে ছবি তুলে তা ভাইরাল করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দেশব্যাপী সাংবাদিকরা সোচ্চার হলে ঐদিনই আদালত থেকে মুক্তি পেতেন সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলম। বিজিবির হাতে গ্রেফতার হওয়া ঐ সাংবাদিক দাবি করেন, বিজিবির সদস্যদের সঙ্গে তার তর্ক হয়। এর জের ধরে তাকে কুলাঘাট ক্যাম্পের টহল দলের সদস্যরা বেধড়ক মারধোর করে আহত করে। পরে তাকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে সদর থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। লালমনিরহাট জেলার বেশকিছু গণমাধ্যমকর্মী জানান, সীমান্ত পাহারাদাররা এখন সাংবাদিকদের টার্গেট করেছে। শাহীনের মতো করে সাংবাদিকদের একে একে ফাঁসিয়ে দিতে পারলে ভারত সীমান্ত দিয়ে দেশে মাদক প্রবেশ সহজ হয়ে যাবে। সাংবাদিকরা আর সীমান্তে মাদক আসার খবর সংগ্রহে ভয়ে আসবে না। এতে পাহারাদারদের টেনশন লাঘব হবে।

বিজিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, লালমনিরহাটের কুলাঘাটে এক বোতল ফেনসিডিলসহ জাহাঙ্গীর আলম শাহীনকে আটক করা হয়। এমন সংবাদ ১৭ এপ্রিল জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলমকে চিনি, জানি। বয়সও কম নয়।

অতীতে নারায়ণগঞ্জে এবং রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে সাংবাদিকরা হামলার শিকার হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের সহিংস কর্মসূচি ঘিরে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত ২০ জন গণমাধ্যমকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশে সাংবাদিকদের এরকম নির্যাতনের শিকার হওয়া কোনো বিরল ঘটনা নয়, বরং এ প্রবণতা বাড়ছে।

বছর দশেক আগে লালমনিরহাটে বেড়াতে গিয়ে পরিচয়। এর আগে টেলিফোনে দু’একবার কথাও হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জনকণ্ঠ এবং বাসসের সাথে আছেন। সাংবাদিকতা ছাড়াও শাহীন আদিতমারী মহিষখোচা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের প্রভাষক। তার এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হলে সুশীল সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাংবাদিক শাহীন দীর্ঘদিন ধরে লালমনিরহাটে চোরাচালান, মাদক কারবার, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গি, জামায়াত-শিবির চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এসব বিষয়ে তার অনুসন্ধানী ও ক্ষুরধার লেখনীর দরুণ বিজিবিসহ স্থানীয় প্রশাসন ক্ষুব্ধ ছিল। বিশেষ করে বিজিবির স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিউজ সংক্রান্ত কারণে তীব্র বিরোধ ছিল এমন বিষয়টি পত্রিকার খবরে প্রকাশিত হয়। তারই প্রতিশোধ হিসেবে তাকে শুধু কোমরে রশি বেঁধে নির্যাতনই নয়, বেধড়ক মারধরও করা হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, এভাবে সাংবাদিকরা আর কত নির্যাতনের স্বীকার হবেন? হালে দেখছি মাওলানারাও সাংবাদিকদের পিছু নিয়েছে। তারা সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে কতল (জবাই) করার ঘোষণা দিয়েছে। অবশ্য ঐ ইসলামী বক্তা এরই মধ্যে গ্রেফতারও হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগ, বিএনপির সভা-সমাবেশ সংঘর্ষে যেমন টার্গেট সাংবাদিক, আজকাল হেফাজতের টার্গেটেও সাংবাদিক। সম্প্রতি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির নিহত হন। তাকে টার্গেট করেই গুলি করা হয়েছে বলে দাবি অনেকের।

অতীতে নারায়ণগঞ্জে এবং রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে সাংবাদিকরা হামলার শিকার হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের সহিংস কর্মসূচি ঘিরে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত ২০ জন গণমাধ্যমকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশে সাংবাদিকদের এরকম নির্যাতনের শিকার হওয়া কোনো বিরল ঘটনা নয়, বরং এ প্রবণতা বাড়ছে।

বিশ্বের যেসব দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না, সে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সাংবাদিক খুন হয় আর তার বিচার হবে না তা কী করে হয়? রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারকে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারে অবশ্যই আন্তরিক ও কঠোর হতে হবে।

১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। বাকি আড়াই বছরে আরও অন্তত ১০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। কয়টা ঘটনার বিচার হয়েছে? একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও নানা রকম ভয়ভীতি-হুমকির কারণে সাংবাদিকতার পরিসর সংকুচিত হয়ে উঠছে, অন্যদিকে শারীরিকভাবে হামলা ও হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের।

এতো বছরেও প্রণীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। প্রকাশ্যে সিরাজগঞ্জে মেয়রের গুলিতে সাংবাদিক হাকিম খুন হন। যশোরে দায়িত্বপালন কালে নিজ অফিসে সাংবাদিক হত্যাসহ অসংখ্য সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতন মামলার ক’টির বিচার হয়েছে এ পর্যন্ত?

বিশ্বের যেসব দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না, সে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সাংবাদিক খুন হয় আর তার বিচার হবে না তা কী করে হয়? রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হলে সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারকে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারে অবশ্যই আন্তরিক ও কঠোর হতে হবে।

দেশে গণমাধ্যমের ভূমিকায় সারা দেশের হাজার হাজার সাংবাদিকের ঘাম-শ্রম ও জীবন ঝুঁকি জড়িত। কিন্তু সাংবাদিকদের নিয়ে রাষ্ট্র ভাবছে কম! গভীর রাত পর্যন্ত ঘুমহীন কাজ করতে হয় অনেক সংবাদকর্মীর। অনেকটা নিশাচরের ভূমিকা তাদের। সাংবাদিকদের পারিবারিক জীবন বলতে কিছু নেই। কিন্তু সাংবাদিকদের মূল্যায়ন সমাজে নেই বললেই চলে। পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতো রয়েছেই।

সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের বাংলাদেশে আজও পর্যন্ত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, কোনো সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। পথে ঘাটে যদি পুলিশ সাংবাদিকদের পেটায়, সাংবাদিক যদি জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসীর রোষানলে পরে, আর বিজিবি যদি একটি ফেনসিডিলসহ খ্যাতিমান কোন সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করে জেলে পাঠায় তাহলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বলে আর কিছু থাকে না। বিষয়টি সরকারকে এখনই ভাবতে হবে। আমলে নিতে হবে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিও।

মীর আব্দুল আলীম ।। সাংবাদিক ও কলামিস্ট