বেশকিছু দিন যাবৎ অনেকেরই ব্যক্তিগত ফোনালাপের অডিও রেকর্ড ফাঁস করছে আমাদের দেশের কিছু সংবাদমাধ্যম। কারো ব্যক্তিগত ফোনালাপ বা তথ্য তার অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করার অধিকার সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের অধিকার কতটুকু আছে তা নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন আছে। সেই সাথে প্রশ্ন উঠছে এই সকল ব্যক্তিগত ফোনালাপসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য সংবাদকর্মীদের কে বা কারা সরবরাহ করছে?

আমাদের দেশের স্বার্থান্বেষী কিছু সংবাদমাধ্যম তাদের ব্যক্তি হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য বিনা দ্বিধায় দেশের অনেক মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে ঐ সকল সম্মানিত ব্যক্তিদের সমাজ তথা রাষ্ট্রের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার কু-মতলবে লিপ্ত। সাংবাদিকতার নীতিতে যা কখনোই সমর্থন যোগ্য নয়।

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তা অনেকেই মানতে চায়নি। এমনকি তার রাজনৈতিক দল বিএনপি ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিল। প্রথমে তারা স্বীকারই করতে চাননি যে, বেগম খালেদা জিয়ার কোভিড টেস্ট করা হয়েছে। পরে অবশ্য তাদের দলের পক্ষ থেকে বেগম জিয়ার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করা হয়। তার আগেই বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে বেগম খালেদা জিয়ার আইসিডিডিআর,বি-এর করোনা পরীক্ষার ফলাফলের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় যা মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই এটা নিয়ে আবার নানান মন্তব্যও করছেন। তবে দলমত নির্বিশেষে বেশিরভাগই তার দ্রুত রোগ মুক্তির কামনা করেছেন।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যক্তির গোপনীয়তার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন নেই।

২০১২ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নিজামুল হক এবং ব্রাসেলসে অবস্থিত একজন বাংলাদেশি আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের মধ্যে স্কাইপ কথোপকথন এবং ই-মেইল ফাঁস করে বিচারের কাজে বিঘ্নিত করতে চেয়েছিল তৎকালীন কিছু সংবাদমাধ্যম। এখনো এর ধারাবাহিকতা চলছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যক্তির গোপনীয়তার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো আইন নেই। বর্তমানে যেসব আইন রয়েছে এর মধ্যেই গোপনীয়তা সম্পর্কিত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে বাংলাদেশে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অ্যাক্ট’ ২০০৬-এর অধীনে যে সাইবার আইন রয়েছে সেখানে উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ইলেকট্রনিক রেকর্ড, যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া তথ্য অধিকার আইনে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বিষয়ে কয়েকটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা-অধিকারের মধ্যে রয়েছে আয়-ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য, অসুস্থতাজনিত তথ্য, যোগাযোগ তথ্য (যেমন: ফোন, মোবাইল নম্বর, পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র) ইত্যাদি।

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য যেমন: জিনগত পরীক্ষা এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্যও গোপনীয়তা অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যোগাযোগের গোপনীয়তার মধ্যে রয়েছে চিঠি, টেলিফোন, ই-মেইলসহ যোগাযোগের সব ধরনের মাধ্যমের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা। ব্যক্তির গোপনীয়তার ক্ষেত্রে বাসস্থান, কর্মক্ষেত্র বা জনসমাগম স্থান প্রভৃতি জায়গায় অন্যের অবৈধ অনুপ্রবেশকে সীমাবদ্ধ করাও ব্যক্তির গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত। যেমন তল্লাশি, ভিডিও নজরদারি,পরিচয়পত্র যাচাই ইত্যাদি।

বর্তমান এই ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন কারণে আমাদের বায়োমেট্রিক তথ্য সহ বিভিন্ন তথ্য অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আসছি তবে আমাদের সেই সব তথ্য তাদের কাছে কতটুকু নিরাপদে সংরক্ষিত আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি কখনোই অন্য এক ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। এরকম হস্তক্ষেপ বা আক্রমণের বিরুদ্ধে আইন সুরক্ষিত করতে প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারস’র ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা সনদের ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

বর্তমান এই ডিজিটাল যুগে বিভিন্ন কারণে আমাদের বায়োমেট্রিক তথ্য সহ বিভিন্ন তথ্য অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আসছি তবে আমাদের সেই সব তথ্য তাদের কাছে কতটুকু নিরাপদে সংরক্ষিত আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যও বিভিন্ন সময় অপব্যবহার হয়েছে। যেহেতু আমাদের তথ্য অধিকার আইনে অসুস্থতাজনিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করা অপরাধ হিসেবে গণ্য, তাই যারা বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতাজনিত তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করছে তারা সেই অপরাধে অপরাধী।

সাংবিধানিক ভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদে রাখা। তবে রাষ্ট্র আজ আর সেই কাজটি সঠিক ভাবে পালন করতে পারছে না বিধায় বিভিন্ন মাধ্যমে তা চলে আসছে লোকালয়ে। যাতে একজন ব্যক্তির সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। রাষ্ট্রের উচিত প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা।

ওয়াসিম ফারুক ।। কলামিস্ট