ছবি : সংগৃহীত

চিত্রনায়ক আরিফিন শুভ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছে বলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মাধ্যমে জানা গেছে। এই সংবাদ চাউর হতেই অনলাইনে যেন আরিফিন শুভর ওপর হামলে পড়েছে এক শ্রেণির নেটিজেনরা।

আরিফিন শুভ প্লট বরাদ্দ পাওয়ায় কেন এই ক্ষোভ কিংবা এই ঘৃণার উদ্গিরণ তা অবশ্য ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে শুরু করেছে। যারা এই ঘৃণার বিষবাষ্পের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন তাদের চূড়ান্ত রাগ গিয়ে ঠেকেছে আরিফিন শুভ’র অভিনীত বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত ‘মুজিব’ চলচ্চিত্রের ওপর।

ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বায়োপিক ঘরানার চলচ্চিত্রটি ১৩ অক্টোবর ২০২৩ সারাদেশে মুক্তি পায় যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই চিত্রনায়ক।

আরিফিন শুভ এই চলচ্চিত্রটি করার জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে ১ টাকা নিয়েছিল যেখানে তার যুক্তি ছিল একজন প্রফেশনাল অভিনেতা হিসেবে তিনি প্রতীকী অর্থ নিয়েছে তবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয়ের পর তার অভিনয় জীবনের পূর্ণতা পাওয়া হয়ে গেছে। এই চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকা অভিনয়ের জন্য তখন থেকেই তিনি দেশবিরোধী একটি অংশের চক্ষুশূল হয়ে পড়েছিল।

বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী ও অগ্নিসন্ত্রাসীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাক্ষাৎ শত্রু। একজন অভিনেতা তার অভিনয়ের জন্য শত্রুতে পরিণত হতে পারেন এটি কেবল বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতেই সম্ভব।

সেই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বিভিন্ন শাখায় আরিফিন শুভ’র এক টাকা পারিশ্রমিকে অভিনয় করা নিয়ে এই উল্লেখিত শ্রেণির ব্যক্তিরাই অনলাইনে ট্রল করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘মুজিব’ নিয়ে নানাবিধ সমালোচনায় মেতে উঠেছিল। এই সমালোচনার মধ্যে চলচ্চিত্রের খরচ থেকে শুরু করে এর ট্রেইলার, সবকিছুই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

আরিফিন শুভ পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে যে প্লট পেয়েছে এটি কি একজন শিল্পী হিসেবে প্রথম? না।

মুজিব চলচ্চিত্রের পোস্টার; ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ কমাতে এবং নাগরিক আবাসন সমস্যা দূর করতেই সরকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। নতুন ওই শহরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের বাসস্থানের সংস্থান হবে।

১৯৯৫ সালে ওই প্রকল্প শুরু হয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

অন্য সব ক্যাটাগরির প্লট বরাদ্দের হিসাব বাদ দিয়ে যদি শুধু শিল্পীরা কত প্লট বরাদ্দ পেল সেই হিসাবের দিকে যদি তাকাই তাহলেও দেখা যায় আরিফিন শুভ’র আগে বাংলাদেশের অনেক পরিচিত শিল্পীরা এখানকার প্লট বরাদ্দ পেয়েছে যারা মুজিব চলচ্চিত্রে অভিনয় করেনি।

তথ্য বলছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, সাংবাদিক, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারী, প্রবাসী, মুক্তিযোদ্ধা এমন ১৬টি ক্যাটাগরি ছাড়াও শিল্পীদের জন্যও প্লট বরাদ্দের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা রয়েছে যার সংখ্যা ১৫১। তবে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে সর্বোচ্চ ১৬৩২টি প্লট।

আরিফিন শুভ’র এই প্লট বরাদ্দের আগে শুধু ২০২২ সালে এই একই প্রকল্পের ২৯নং সেক্টরে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩১৩টি যেটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাইটে পরিষ্কার তথ্য দেওয়া রয়েছে। শুধু তাই নয় এখানে সবগুলো সেক্টরে সর্বমোট এই পর্যন্ত কতগুলো প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার হিসাবও আছে।

অন্য সব ক্যাটাগরির প্লট বরাদ্দের হিসাব বাদ দিয়ে যদি শুধু শিল্পীরা কত প্লট বরাদ্দ পেল সেই হিসাবের দিকে যদি তাকাই তাহলেও দেখা যায় আরিফিন শুভ’র আগে বাংলাদেশের অনেক পরিচিত শিল্পীরা এখানকার প্লট বরাদ্দ পেয়েছে যারা মুজিব চলচ্চিত্রে অভিনয় করেনি।

এখানেই প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, যদি রাজউকের এই আলোচ্য প্রকল্পে শিল্পীদের দেওয়ার জন্য প্লট বরাদ্দের অনুমতি থাকে এবং একজন শিল্পীর আবেদনের প্রেক্ষিতে সেই প্লট সব নিয়মনীতি-আইন-কানুন মেনে বরাদ্দ দেওয়া হয় তাহলে আরিফিন শুভ’র বেলাতেই ভিন্ন ফল কেন? কারণটা কি এই যে তিনি জাতির জনকের বায়োপিকে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছিল?

কারণটা কি এই যে তিনি তার অভিনয় সক্ষমতার সব চেষ্টা এই চরিত্রের জন্য করেছিল? কারণটা কি এই যে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিজের ভেতর ধারণ করতে চেয়েছিল? কারণটা কি এই যে তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান?

মুজিব চলচ্চিত্রে আরিফিন শুভ; ছবি : সংগৃহীত

এই প্রসঙ্গে আমি ফোন করেছিলাম চিত্রনায়ক আরিফিন শুভকে। অত্যন্ত অমায়িক শুভ হাসলেন কেবল। টেলিফোনের এইপাড় থেকে এই হাসির ভেতরে প্রবল বেদনা আমি অন্তত অনুভব করেছি। তাকে নিয়ে, তার প্লট বরাদ্দ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। তিনি মনে করেন, এগুলো নিয়ে কথা বলার কিছু নেই এবং কারণও নেই।

শিল্পী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসী থেকে শুরু করে যারা পূর্বাচল প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ পায়, তারা কীভাবে পায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানে প্লট বরাদ্দের জন্য যথোপযুক্ত ফরমে আবেদন করতে হয়। সেই আবেদন যাচাই বাছাই হয়।

পরবর্তীতে ব্যক্তিকে নানাবিধ নথিপত্র সরবরাহ করে এবং উক্ত বরাদ্দকৃত জমির সরকারি ধার্যকৃত অর্থ মূল্য পরিশোধ করে সেই জমি হস্তান্তর করা হয়। উল্লেখ্য যে এই ধার্যকৃত অর্থ বিভিন্ন কিস্তিতে পরিশোধের ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু আরিফিন শুভ’র ব্যাপারে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া গুজব অংশে এইসব পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার কোনোরকমের বালাই নেই। এখানে গুজবের প্রান্তিক স্তরের আলোচনাই হচ্ছে আরিফিন শুভ এই প্লট বিনামূল্যে পেয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে অভিনয় করার জন্য সরকার তাকে ‘খুশি হয়ে’ এই প্লট বরাদ্দ দিয়েছে।

গুজবকারীরা কখনোই এই প্রশ্ন তুলবে না কিংবা তোলেনি যে, শুভর আগে যারা এমন প্লট বরাদ্দ পেয়েছে এবং যারা এই চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত ছিল না কিংবা এত শত শত প্লট বিভিন্ন ক্যাটাগরির ব্যক্তিদের যে দেওয়া হচ্ছে বা হয়েছে তা ঠিক কার ‘খুশি’র কারণে? এই প্রশ্নের যেমন জবাব নেই তেমনি এই বাংলাদেশে এমন অসুস্থ মানুষেরা ঠিক কী কারণে এমন বিকারগ্রস্ত গুজবে যোগ দেয় তার উত্তরও নেই।

মুজিব চলচ্চিত্রে আরিফিন শুভ'র সম্মানী এক টাকার চেক; ছবি : সংগৃহীত

শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা নানাবিধ অনলাইন প্ল্যাটফর্মই কেবল নয় দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম এমন গুজবে ঘি ঢেলেছে। গণমাধ্যমের শিরোনামগুলোর ইঙ্গিত ছিল এমন, ‘মুজিব’ চলচ্চিত্র করেই এই প্লট বরাদ্দ পেয়েছে।

...গুজবের প্রান্তিক স্তরের আলোচনাই হচ্ছে আরিফিন শুভ এই প্লট বিনামূল্যে পেয়েছে এবং বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে অভিনয় করার জন্য সরকার তাকে ‘খুশি হয়ে’ এই প্লট বরাদ্দ দিয়েছে।

এমনকি এই সংবাদ প্রকাশে যে ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে তাও আরিফিন শুভ’র ‘বঙ্গবন্ধু’ নামাঙ্কিত একটি টুপি পরিহিত ছবি, যা ছবির প্রচারণার সময় পরেছিল শুভ। অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমগুলো এই অসুস্থ প্রোপাগান্ডায় অংশ নেওয়া নেটিজেনদের আরও উসকে দিচ্ছে তাদের সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে।

এইসব সংবাদ পড়লে মনে হতে পারে রাজউক পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে আগে কখনো কোনো শিল্পী প্লট বরাদ্দ পানি কিংবা এই অঞ্চলে শুধু ‘মুজিব’ চলচ্চিত্রে অংশ নেওয়া কলাকুশলীদের-ই কেবল বরাদ্দ দেওয়া হয় কিংবা আরিফিন শুভ তার জীবনে এই একটি ‘মুজিব’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেই মূলত শিল্পী হয়েছে।

স্বাধীনতাবিরোধী এই নেটিজেন অংশ এবং অগ্নিসন্ত্রাসীদের পুরো অংশটি যখন ‘মুজিব’ এলার্জিতে ভুগতে থাকে এবং এদের যখন পরিচিত সংবাদ মাধ্যম আরও উসকে দেয় তখন একই সাথে বেদনাসিক্ত ও বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না।

শুভ ‘মুজিব’ চলচ্চিত্রে অভিনয় না করলে কি সংবাদমাধ্যম এবং নেটিজেনরা এই নোংরামিতে নেমে পড়তে? সহজেই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। না। কারণ সমস্যা তো আসলে মুজিবে। অন্য কোথাও নয়।  

ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার ।। আইনজীবী ও সলিসিটর