নির্বাচন যায় নির্বাচন আসে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে কথা শেষ হয় না। নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, নির্বাচন বর্জন করা, এসব তো আছেই। নির্বাচনের পর এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথার পিঠে কথা চলতেই থাকে।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেও নির্বাচনী মাঠে প্রতিশ্রুতি, সংঘাত, সংঘর্ষ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে আমাদের দেশে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দেশে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা প্রকারান্তরে একদলীয় একতরফা নির্বাচন।

নির্বাচনী আমেজ নেই। ফলাফল মানুষ জানে। তারপরও সংঘাত, সংঘর্ষ থেমে নেই। চলছে দখলদারিত্বের লড়াই। সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন এই নির্বাচনে মানুষ দেখতে পাবে।

তারপরও যে যার মতো যতটুকু পারে নির্বাচনের মাঠে 'আমি', 'ডামি', 'স্বতন্ত্র আমি' সরকারি আনুকূল্য পাওয়া বিভিন্ন দলের প্রার্থীরাও প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি শোনাচ্ছে বলে জানা যায়।

প্রশ্ন হলো, এটা কীসের নির্বাচন? এখানে কি প্রতিশ্রুতি যুক্তিসঙ্গত? এসব কথা কি প্রার্থী ও ভোটাররা জানেন? বোঝেন? জাতীয় সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখবেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে দায়িত্বশীল হবেন।

রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হলে, তিনি তার দলের ইশতেহার তুলে ধরবেন। এসব বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও স্থানীয় সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে, স্থানীয় হিস্যা আদায়ে ভূমিকা পালনের কথা বলবেন।

বিগত দিনে এসব বিষয়ে তার বা তার দলের ওই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মকাণ্ড কী ছিল সেইসব কথা বলবেন। অন্যদের সাথে পার্থক্য তুলে ধরবেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও আইন প্রণয়নসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তিনি কী ভূমিকা নেবেন তা তুলে ধরবেন। কিন্তু দেখা যায়, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলা, ব্যক্তি আক্রমণ, কোথাও কোথাও হুমকি-ধামকি এবং স্থানীয় উন্নয়নের ভূমিকার কথাই ফুলঝুরি এসব প্রার্থীদের আলোচনায় প্রধান হয়ে ওঠে। এ তো গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেও নির্বাচনী মাঠে প্রতিশ্রুতি, সংঘাত, সংঘর্ষ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে আমাদের দেশে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দেশে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা প্রকারান্তরে একদলীয় একতরফা নির্বাচন।

আমাদের সংবিধানে স্থানীয় সরকারের কথা বলা আছে। স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমে তাদেরই ভূমিকা রাখার কথা। অর্থাৎ স্থানীয় উন্নয়নে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ প্রধান ভূমিকা রাখবে। এজন্য এসব প্রতিষ্ঠান সংসদের আদলে গড়ে তুলতে হবে।

আইন অনুযায়ী স্থানীয় উন্নয়নে জাতীয় সংসদ সদস্যদের সরাসরি নাক গলানোর সুযোগ থাকার কথা নেই। আমাদের দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে না দেওয়ার জন্য এসব সংস্থা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

স্থানীয় সরকারের কার্যকর ভূমিকায় সরাসরি স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। এভাবে দেশের জনগণকে স্থানীয় কাজে সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়। তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে দেশের উন্নয়নসহ অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা যায়।

দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নির্বাচনে যেসব কথার প্রতিফলন ঘটে তা যার যার কথা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারে না। সংবিধান অনুযায়ী প্রকৃত ভূমিকা রাখতে পারে না।

এর অন্যতম কারণ হলো—জাতীয় সংসদ সদস্যরা সংবিধান অনুযায়ী প্রধানত তাদের দায়িত্ব পালন না করে স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ সব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার সংগঠনগুলো তার কার্যক্রম যথাযথভাবে করতে পারে না। এসব প্রতিষ্ঠান দক্ষ ও শক্তিশালী হয়েও গড়ে ওঠে না।

স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে না। স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা ও নিশ্চিত করা যায় না। তাই নির্বাচনে প্রতিনিধি নির্বাচন ও ওইসব প্রতিনিধিদের স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যার যার দায়িত্ব তাদেরই পালন নিশ্চিত করা জরুরি।

এসব কথা বা সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গেলে প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা। প্রয়োজন সংবিধান অনুযায়ী জনগণের স্বার্থে কাজ করবে এমন সরকার প্রতিষ্ঠা করা। যারা প্রয়োজনের সংবিধানকে আরও উন্নত করে সর্বত্র জনগণের অংশগ্রহণ স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।

কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত এটি করা সম্ভব হয়নি। বরং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিরাই নিজের স্বার্থ, গোষ্ঠী স্বার্থ, দলীয় স্বার্থকেই প্রধান করে তুলেছে।

এসব জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব জনপ্রতিনিধিরা নিজের স্বার্থ, নিজের অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ব্যস্ত হয়ে ওঠেন নিজের স্বার্থ রক্ষায় নিজের গোষ্ঠী ক্ষমতায় রাখতে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের হলফনামায় দেওয়া তথ্যে অর্থ সম্পদের যে চিত্র দেখা গেল তাতে এসব বিষয় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

যারা একবার ক্ষমতার সাধ পেয়ে গেছে তারা কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। নিজেদের গোছানো অর্থ-সম্পদ রক্ষা এবং আগামীতে আরও অর্থ সম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্য এরা সামনে চলে আসে। তার জন্য পুনরায় ক্ষমতা চায়।

আর ক্ষমতার বাইরে থাকা এসব স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তারাও ক্ষমতার ভাগ চায়। এসব দ্বন্দ্বই এখন নির্বাচনে প্রধান হয়ে উঠছে। যার কারণে নীতি নৈতিকতা, যোগ্যতা নয়—সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অযোগ্যতার মাপকাঠি দলীয় স্বার্থ রক্ষাকারী বা নিজের বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী কি না এটাই প্রধান হয়ে উঠেছে।

দেশের শাসকদের রাজনীতি এখন দুর্বৃত্তদের কাছে বন্দি হয়ে গেছে। সাধারণভাবে বললে বলা যায় ‘অসৎ আমলা অসৎ ব্যবসায়ী আর অসৎ রাজনীতিবিদদের চক্র’ই এসব রাজনৈতিক দলের স্টিয়ারিংয়ে বসে আছে।

যারা একবার ক্ষমতার সাধ পেয়ে গেছে তারা কোনোভাবেই ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। নিজেদের গোছানো অর্থ-সম্পদ রক্ষা এবং আগামীতে আরও অর্থ সম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্য এরা সামনে চলে আসে। তার জন্য পুনরায় ক্ষমতা চায়।

তাই নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে শুরু করে সর্বত্রই এদের প্রাধান্য রয়েছে। এই অবস্থায় নির্বাচনে কে কী প্রতিশ্রুতি দিলো আর দিলো না এটা প্রধান আলোচ্য হিসেবে আর থাকছে না।

নানাভাবে টাকার মালিক হওয়া কেউ কেউ স্থানীয় কিছু ভূমিকা রাখছে দেখতে পেলেও তাকে পুঁজি করে নিজের বা নিজেদের সম্পদ গোছানোই যে প্রধান হয়ে উঠছে সেইসব তথ্য সবাই দেখতে পাচ্ছে।

ভোটের ক্ষেত্রে যদি ভোটে দাঁড়ানো ও ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সম-সুযোগ প্রতিষ্ঠা করা যেত তাহলে জনগণ তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতো। জনগণ সচেতন হয়ে জবাবদিহিতা চাইতে পারতো। এর মধ্য দিয়ে পুরো ভোট ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থাকে উন্নত করা যেত। কিন্তু আমাদের শাসকরা সেই পথে হাঁটছে না।

তাই নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ও এই জনপ্রতিনিধিরা যার যার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে কি না তাও যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না।

এজন্য পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সাথে রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলাও জরুরি হয়ে পড়েছে।

একটা শক্তিশালী নীতি-নিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তি বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে উঠলে তারা সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারত। এর মধ্য দিয়ে পুরো রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত করা এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হতো।

প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল রেখে এবং চলতি হওয়ার দ্বি-দলীয় ধারার রাজনীতি বহাল রেখে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার উন্নততর অবস্থান গড়ে তোলা মোটেই সম্ভব নয়। এবারের নির্বাচন এবং অতীতের নির্বাচন এই তথ্যই দেশবাসীর সামনে তুলে ধরছে।

দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে নির্বাচনের প্রার্থীরা নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য সঠিকভাবে তুলে না ধরে যেসব অঙ্গীকার করছে তার মধ্য দিয়ে মানুষের সামনে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য ফুটে ওঠে না। এর মধ্য দিয়ে জনগণ বিভ্রান্ত হয়, মানুষ নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

এই অবস্থা পরিবর্তনে নীতি-নিষ্ঠ মহলের দায়িত্বশীল আচরণ সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে।

রুহিন হোসেন প্রিন্স।। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
hossainprince@yahoo.com