ছবি : সংগৃহীত

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চারবার সরকার গঠন করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সব মিলিয়ে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তবে ২০০৯ সাল থেকে টানা সরকার পরিচালনায় থাকা আওয়ামী লীগকে নিয়ে আলোচনা অনেক।

খুব বেশি পেছনে না গিয়ে ৭ জানুয়ারি ২০২৪ হয়ে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নতুন সরকার নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। এখন পর্যন্ত মন্ত্রিসভার কলেবর ৩৬ জনের। ২৫ জন পূর্ণমন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী। এর বাইরে মন্ত্রীর মর্যাদায় ৬ জন উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের কয়েকটি দেশ ছাড়া অনেকেই বলেছেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভালো হয়েছে। ৮ জানুয়ারি ২০২৪ ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা সশরীরে গণভবনে হাজির হয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন শেখ হাসিনাকে। এছাড়া শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন অনেক সরকার প্রধান ও রাষ্ট্র প্রধান।

তবে এসবের পরেও নতুন মেয়াদের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেইগুলো আওয়ামী লীগ, তথা শেখ হাসিনার সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে, কিংবা কতটা গুরুত্ব দেবে, সেইটাই দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র ১৪ দলীয় জোটের জন্য এবার ছয় আসনে ছাড় দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। জিতেছেন মাত্র দুজন। অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে প্রার্থী দিয়ে তারপর আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার জন্য দেন দরবারে বসেছিল প্রেডিক্টেবলি আনপ্রেডিক্টেবল জাতীয় পার্টি

কয়েক দফা আলোচনার পর শেষমেশ তাদের ভাগ্যে ছাড় জুটেছিল ২৬ আসনে। জিতেছে মাত্র ১১টিতে। এই ১১টি আবার আওয়ামী লীগের ছাড় দেওয়া ২৬টির মধ্যেই। অর্থাৎ নৌকার সঙ্গে লড়ে কোথাও জিততে পারেনি লাঙল। আর বিএনপি তো নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন করে, না পেরেছে আন্দোলন জমাতে, না পেরেছে ভোট ঠেকাতে।

গেল মেয়াদে মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যের পারফরমেন্স নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন ছিল। সোজা ভাষায় বললে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। বিগত মেয়াদের ব্যর্থ মন্ত্রীদের এবার আওয়ামী লীগ, সরকারে রাখেনি।

আগামী পাঁচ বছরে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা কী দাঁড়ায় তা তোলা থাকল সময়ের হাতে। আপাতত যা দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের সামনে রাজনীতির মাঠে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। তাই বলে বর্তমান সরকার একেবারে নির্ভারভাবে এই মেয়াদ কাটিয়ে দেবে তেমনটা ভাবারও কিছু নেই।

গেল মেয়াদে মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যের পারফরমেন্স নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন ছিল। সোজা ভাষায় বললে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। বিগত মেয়াদের ব্যর্থ মন্ত্রীদের এবার আওয়ামী লীগ, সরকারে রাখেনি। এটা একটা ভালো দিক। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়।

দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে অনেক দেশ অভিনন্দন জানালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের কিছু দেশ কিন্তু অতটা গদগদ নয়। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তারা অব্যাহত রাখতে চায় এবং এগিয়ে নিতে চায় মূলত নিজেদের স্বার্থে। পশ্চিমাদের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এটাই অভ্যাসগত বৈশিষ্ট্য।

এখন কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকার অনমনীয় দৃঢ়তা দেখিয়ে মার্কিনদের নানা চাপ উপেক্ষা করেই একটি নির্বাচন করে ফেলেছে। নতুন সরকারও এরই মধ্যে শপথ নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আগামী পাঁচ বছর আমেরিকা এবং ইউরোপ কীভাবে সামলাবে, সেই চ্যালেঞ্জও আছে সামনে। ভালোভাবেই আছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আগের দুজনকেই বাদ দিয়ে ড. হাছান মাহমুদকে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তিনি কতটুকু, কী করতে পারেন, তা সময় বলে দেবে।

অনেক ঘটা করে ২০১৯ সালে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু মাঝারি মানের কিছু নেতাকে গ্রেফতারের পরই থেমে গেছে সব তোড়জোড়। এরই মধ্যে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সেই টাকার কোনো সন্ধান মেলেনি।

দুই একজন বাদে অন্য রাঘব বোয়ালদের খবর মেলেনি, মেলেনি হাজার হাজার কোটি টাকার খবরও। শুধু টাকা পাচার কেন? প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গেলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ খরচ করা যাবে।

একটি সরকারের দুটি অংশ থাকে। একটি রাজনৈতিক অংশ, অপরটি প্রশাসনিক অংশ। ওই যে বলছিলাম দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের কথা। তা লোক দেখানো হোক, আর মাঝপথে থেমে যাওয়াই হোক—পরিচালিত হয়েছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু একশো ভাগের বেশি বেতন বৃদ্ধি পাওয়া আমাদের আমলারা যে দেশটাকে ফোকলা করে দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে সেই জায়গায় আলো ফেলেছে কি সরকার?

এই যে নানান আলোচনায় বেগম পাড়াসহ অন্যান্য পাড়া নিয়ে নানা কিছু শোনা যায়, এগুলো সবই নাকি আমলাদের কারবার। কিন্তু তাদের নিয়ে কোনো ভাবনা আছে কী?

গেল কয়েক বছর ধরেই নিত্যপণ্যের অতিমূল্য ভোগাচ্ছে দেশের মানুষকে। এক্ষেত্রে বরাবরই দোহাই আসছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। কিন্তু এই যুক্তি কি সবক্ষেত্রে খাটে? দেশে উৎপাদিত হয়, দেশেই বিক্রি হয়—এমন অনেক পণ্যের দামও তো আকাশ ছোঁয়া।

অনেক ঘটা করে ২০১৯ সালে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু মাঝারি মানের কিছু নেতাকে গ্রেফতারের পরই থেমে গেছে সব তোড়জোড়। এরই মধ্যে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। সেই টাকার কোনো সন্ধান মেলেনি।

আবার উৎপাদনকারী কৃষকও ন্যায্য দাম পান না বলে হাহাকার চলে। ক্রেতার অবস্থা যে কতটা নাজেহাল তা তো বলে শেষ করার নয়। সব মিলিয়ে নতুন সরকার কীভাবে ছোটাবে এই জট সেইটাই চ্যালেঞ্জ। তবে পারতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

আগের বাণিজ্যমন্ত্রী বাদ দিয়ে এই মন্ত্রণালয়ে নতুন প্রতিমন্ত্রী এসেছে। যিনি এসেছেন তাকে মানুষ সৎ বলেই জানে। এখন চ্যালেঞ্জ সততার সঙ্গে দক্ষতারও প্রমাণ দেওয়ার।

আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদগুলোয় শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক শোরগোল চলেছে। শিক্ষায় হেফাজতিদের চাহিদা ২০১৩ সালে কানে তোলেনি আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৭ সালে ঠিকই শিক্ষায় হেফাজতিদের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হতে দেখা গেছে। আর এই করতে গিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে আপস করা হয়েছে, নাকি দূরে সরে যাওয়া হয়েছে সেই বিতর্ক মাথায় রেখেই বলছি, শিক্ষায়ও নতুন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে অনেক।

গেল মেয়াদের শিক্ষামন্ত্রী এবার গেছেন সমাজকল্যাণে। আর উপমন্ত্রী একলাফে পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন। সুতরাং শিক্ষায় মানোন্নয়ন এবং কারিকুলাম উন্নয়নেও একই রকম ইতিবাচক উল্লম্ফন দেখতে চায় দেশের মানুষ।

আরেকেটা বিষয়, বলতে খুব খারাপ লাগছে। তবুও বলতেই হবে। এদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা সবচেয়ে বেশি করে আওয়ামী লীগ। দেশের সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষের আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশাও বেশি। শুধু সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষ না, বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা করেন এমন মানুষেরাও আস্থা রাখেন আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর। কিন্তু এই জায়গায় মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে কি? এই বিষয়টাও নতুন সরকার মাথায় রাখবে, আশা করি।

নানা ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর অপরিণামদর্শী এবং জনসম্পৃক্ততাহীন রাজনীতির কারণে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে বিএনপিসহ বাকি রাজনৈতিক দলগুলো। সুতরাং দেশের মানুষের আশা ভরসাস্থল এখন একমাত্র আওয়ামী লীগ। সেই প্রতিদান আওয়ামী লীগ দেবে, এই আশায় থাকলাম।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী