ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশা কতটা অবহেলিত আর অধঃপতিত হয়েছে তার কিছু উদাহরণ দেব। ১৯২৩-২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বেতন ছিল ১৮০০ রুপি। বিশ্বাস হয়? সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বেতনের চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বেতন ৩০০ থেকে ৪০০ রুপি বেশি ছিল।

বর্তমানে ভারতে আমার মতো একজন অধ্যাপকের বেতন আমার ৩ গুণের চেয়েও বেশি। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষককে পার্ট টাইম পড়াতে হয় না। অর্থাৎ নিজের পড়া, পড়ানো ও গবেষণায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারেন তারা।

আজকে ভারতের একজন সহকারী অধ্যাপক যার পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক আছে তার বেতন প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার রুপি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপকের বেতন ৭০-৭৫ হাজার টাকা (ভারতীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার রুপি)। কারও পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক থাকলে তার অতিরিক্ত যোগ্যতার কারণে যে বেশি দিতে হয় সেই ন্যূনতম সৌজন্যবোধও এখানে দেখানো হয় না।

ভারতে একজন পোস্ট-ডক ফেলো হিসেবে একজন শিক্ষক মাসে পান প্রায় ১ লাখ রুপি যা আমাদের একজন সহকারী অধ্যাপকের বেতনের দ্বিগুণ। একজন পিএইচডি ছাত্র পান প্রায় ৬০ হাজার রুপি। এটাও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপকের বেতনের চেয়ে বেশি। এজন্যই ভারতের প্রতিটি ইন্সটিটিউটে প্রচুর ভারতীয় পিএইচডি করছে, পোস্ট-ডক করছে, গবেষণা করছে। সেখানে গবেষণার পরিবেশ আছে। আর আমাদের কথা কী বলব!

তবে এটিও বলতে হবে ভারত যা দিচ্ছে তাও যথেষ্ট নয়। প্রতিবেশী চীন এর চেয়েও বেশি বেতন ও সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। যার জন্য ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং-এ ১ থেকে ২০ এর মধ্যে চীনের বেশকটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

যারা প্রশ্ন তোলেন, বেতন বাড়ালেই কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান ভালো হয়ে যাবে? তাদের বলছি, হ্যাঁ ভালো হয়ে যাবে। সেই ১৯২১ সালের দিকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, রমেশচন্দ্র মজুমদারসহ অনেকেই কলকাতা থেকে ঢাকা এসেছিলেন বেতনের জন্যই। এখন অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছেন বেতনের জন্যই।

...সহকারী শিক্ষকের নিয়োগ দেখলাম। সর্বসাকুল্যে বেতন হলো ১২৫০০ টাকা। সেই চাকরির জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। অষ্টম শ্রেণি পাস কারও বেতনও তো এত কম হয় না বা হওয়া উচিত না।

শিক্ষকতা পেশায় তো আর ঘুষ-দুর্নীতির সুযোগ নেই, যদি না শিক্ষকের প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে। আর তা কখনোই কাঙ্ক্ষিতও নয়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষকদের আলাদা উচ্চমানের বেতন স্কেল না দিলে আমরা ভালো মানের মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আনতে পারব না।

অনেকের ধারণা শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর সাথে শিক্ষকতার মান বৃদ্ধির সম্পর্ক নেই। যারা খারাপ তাদের বেতন বাড়লে বরং আরও বেশি খারাপ হবে। এর সবচেয়ে ভালো উত্তর হলো সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে কয়েকজন বিশ্বমানের শিক্ষক পেয়েছিল সেইসময় তা বেতনের জন্যই পেয়েছিল।

তৎকালীন ভিসি ফিলিপ জোসেফ হার্টগ ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়াতে হলে ভালো শিক্ষক দরকার। আর ভালো শিক্ষক আনতে হলে বেশি বেতন দিতে হবে। তাই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে বেশি করেছিলেন। এর ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক বিখ্যাত শিক্ষক চলে এসেছিলেন। তাছাড়া সত্যেন্দ্রনাথ বসু বেতন নিয়ে ভিসি হার্টগের সাথে অনেক চিঠি চালাচালিও করেছিলেন। এখান থেকে বোঝা যায় বেতন আসলেই গুরুত্ব বহন করে।

.....বিসিএসেও যারা শিক্ষা ক্যাডার পাবে তাদের গল্প গণমাধ্যমে আসবে। এখন কে প্রশাসন পেল, কে বিসিএস পুলিশ পেল আর কে ট্যাক্সে গেল তাদের গল্পই গণমাধ্যম খুব আগ্রহ নিয়ে প্রচার করছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।

বেতন বেশি হলে মোটা দাগে মানুষের মধ্যে একটা আত্মসম্মানবোধ জাগে। চলার মতো আয় না থাকলে মানুষ নিচু কাজ করতেও কার্পণ্য করে না।

১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তার ১৮০০ রুপির বেতন দিয়ে ৪৬০ মন চাল কিনতে পারতেন। কারণ তখন ১ মন সরু চালের দাম ছিল চার টাকা। আজ একজন অধ্যাপক ১ লক্ষ টাকা বেতন দিয়ে ৪০ মন চালও কিনতে পারেন না। তাহলে মেধাবীরা কেন এই পেশায় আসবেন?

শুধুই কি বেতন? কেউ মানুক আর না মানুক বেতনের সাথে সম্মানও জড়িত। এটা আলট্রা পুঁজিবাদী সমাজ। যেই সমাজে বিত্তশালী চোর বাটপারকেও মানুষ মাথায় তুলে নাচে।

রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখলাম। সর্বসাকুল্যে বেতন হলো ১২৫০০ টাকা। সেই চাকরির জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর। অষ্টম শ্রেণি পাস কারও বেতনও তো এত কম হয় না বা হওয়া উচিত নয়। অথচ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনো কারণ দেখেন না।

আসলে শিক্ষকদের বেতন এক লাফে ৩ গুণ করে দেওয়া উচিত এবং এটা সম্ভব। ইউনেস্কোর নির্দেশ মেনে শিক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশের ওপরে বরাদ্দ দেওয়া উচিত। ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া যদি পারে আমরা কেন পারব না?

শিক্ষাক্রম বা কারিকুলাম পরিবর্তন না করেও আগের কারিকুলামেই বিশ্বমানের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে। কারিকুলামে আমাদের সমস্যা ছিল না। এমন বেতন দিতে হবে যে দেশের মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

বিসিএসে যারা শিক্ষা ক্যাডার পাবে তাদের গল্পও গণমাধ্যমে আসবে। এখন কে প্রশাসন পেল, কে বিসিএস পুলিশ পেল আর কে ট্যাক্সে গেল তাদের গল্প গণমাধ্যম খুব আগ্রহ নিয়ে প্রচার করছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।

যেদিন বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার কাঙ্ক্ষিত ক্যাডার হবে তখন থেকে দেশ বদলে যেতে শুরু করবে। ৫ থেকে ১০ বছর এই নিয়মে চললে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ মহাসড়কে উঠবে। ইট পাথরের উন্নয়ন আসল উন্নয়ন নয়। এমন জাতি তৈরি করলাম যে জাতি সত্যিকারের উন্নয়নের সংজ্ঞাই জানে না, তাহলে কী হলো!

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়