ছবি : সংগৃহীত

সাধারণ অর্থে দেশ বা অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রণীত আইনের পরিপন্থী কার্যকলাপই অপরাধ হিসেবে গণ্য। বাংলাদেশে মোটামুটি সব ধরনের অপরাধই কম-বেশি সংঘটিত হচ্ছে—তার মধ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, অপহরণ, মাদকাসক্তি, মাদক চোরাচালান এবং রাজনৈতিক সহিংসতাও রয়েছে।

ডিএমপির ২০২৩ সালের অপরাধ বিষয়ক মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ডিএমপির আটটি ক্রাইম বিভাগের প্রতিটি থানা এলাকায় অপহরণের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে রমনা বিভাগে তিনটি, ওয়ারী বিভাগে পাঁচটি, লালবাগে আটটি, মতিঝিলে সাতটি, মিরপুরে ছয়টি, গুলশানে ১০টি, উত্তরায় ১২টি এবং তেজগাঁওয়ে ১৪টি মামলা করা হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, প্রতিবছরই বিপুলসংখ্যক মানুষ অপহরণের শিকার হয়। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৭৪০ জন নারী ও শিশুকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ২০২১ সালে ১৮০ জন, ২০২০ সালে ১২৫ জন, ২০১৯ সালে ১৪৭ জন, ২০১৮ সালে ১৪৫ জন, ২০১৭ সালে ১৪৩ জন এবং ২০১৬ সালে ১৩২ জন ছিল।

পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে ঢাকায় ৬৩টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়। পরের বছর ২০২২ সালে সেই মামলার সংখ্যা বেড়ে ১০৩তে পৌঁছায়। পরের বছরও ছিনতাইয়ের ১০৩টি মামলা হয়। গত বছর সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অপরাধীদের তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলে ডিএমপি। তাতে রাজধানীতে ছিনতাইয়ে ১ হাজার ৭৩৭ জন যুক্ত থাকার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী, ডাকাত ও অপহরণকারী পুলিশের তেজগাঁও বিভাগে।

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অপরাধের হার একটি বহুমুখী ইস্যু যার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। কেন এই ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কেন অপরাধীরা প্রায়শই ধরা পড়ে না তা বোঝার জন্য অপরাধের মূলধারার তত্ত্বগত ধারণার পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক দিকগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা

বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য কারণ হলো অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। সমাজের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বৈষম্যের উপস্থিতি এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে যা ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে অপরাধমূলক কার্যকলাপের অবলম্বন করতে পরিচালিত করে।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং অপরাধের মধ্যে সম্পর্ক বহুমুখী। অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বিভিন্ন কারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের অবদান রাখতে পারে। উচ্চমাত্রার বেকারত্ব এবং আর্থিক চাপ হতাশার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যে ব্যক্তিরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সংগ্রাম করছে তারা বেঁচে থাকার বা আর্থিক চাপ কমানোর উপায় হিসেবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে যেতে পারে।

বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য কারণ হলো অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা। সমাজের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বৈষম্যের উপস্থিতি এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে যা ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে অপরাধমূলক কার্যকলাপের অবলম্বন করতে পরিচালিত করে।

বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবে কিছু ব্যক্তি নিজেদের এবং তাদের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য অবৈধ উপায়ে জড়িত হতে পারে। সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অন্যায় এবং অপরাধমূলক বোধ তৈরি করতে পারে। যারা নিজেদের অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন তারা সিস্টেমের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে, যা প্রতিবাদ বা প্রতিশোধের একটি রূপ হিসেবে অপরাধমূলক আচরণের দিকে পরিচালিত করে।

যখন জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হয় এবং মৌলিক প্রয়োজনীয়তাগুলো ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তখন ব্যক্তিরা তাদের আয় এবং প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবার মূল্যের মধ্যে ব্যবধান কমাতে অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত হতে পারে। যেকোনো সমাজে অপরাধ, শ্রেণিসংঘাতের কারণে ঘটে এবং মার্কসবাদী অপরাধবিদ্যা (সামাজিক দ্বন্দ্ব) পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিযোগিতামূলক প্রকৃতিকে অপরাধের প্রধান কারণ হিসেবে দেখে।

কতিপয় ব্যক্তি তাদের হতাশা, ক্রোধ, চাপ (general strain) এবং প্রয়োজনের কারণে অপরাধ করে, যখন ধনীরা অবৈধ কাজ করে কারণ তারা প্রতিযোগিতায় অভ্যস্ত এবং সমাজে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে তাদের অবশ্যই তা করতে হবে। যদিও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ব্যক্তিদের অপরাধের দিকে চালিত করতে পারে, তবে এটা মানতে হবে গুরুত্বপূর্ণ যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সবাই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় না। অর্থনৈতিক কারণ এবং অপরাধের মধ্যে সম্পর্ক মূলত ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিভিন্ন নিয়ামকের প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়।

অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করা এবং সহায়তা ব্যবস্থা প্রদান করা ব্যক্তিদের অপরাধমূলক আচরণ থেকে বিরত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

পারিবারিক কলহ

নেতিবাচক পারিবারিক পরিবেশ, যেমন পারিবারিক সহিংসতা বা ভঙ্গুর পরিবারগুলোর (social disorganization) মতো সমস্যা দ্বারা চিহ্নিত, ব্যক্তিদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা তৈরিতে এবং বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। একটা স্থিতিশীল পারিবারিক কাঠামোর অভাব অপরাধ সংঘটনের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে।

পদ্ধতিগত অদক্ষতার মতো বিষয়গুলো ফৌজদারি বিচার পদ্ধতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে যা অপরাধীদের অপরাধ করার প্রবণতা আরও বাড়াতে পারে।

পরিবারের মধ্যে অপরাধমূলক আচরণের উপস্থিতি, বিশেষ করে বাবা-মা বা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে, একজন ব্যক্তির অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে। অপরাধী রোল মডেলের এক্সপোজার এই ধরনের আচরণকে স্বাভাবিক করতে পারে।

এছাড়া যে শিশুরা শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতন বা অবহেলার শিকার হয় তাদের পরবর্তী জীবনে অপরাধমূলক আচরণে জড়িত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে (victim to offender)। পিতামাতার অপর্যাপ্ত তত্ত্বাবধান এবং সন্তানের জীবনে জড়িত থাকার অভাব অপরাধে অবদান রাখতে পারে।

ফৌজদারি বিচার সম্পর্কিত প্রতিবন্ধকতা

অপরাধ প্রমাণ করার জটিল পদ্ধতি, কেস ব্যাকলগ এবং কার্যকর কেস ম্যানেজমেন্টের অভাব বাংলাদেশের আদালত ব্যবস্থার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। জটিল মামলা পদ্ধতি, প্রসিকিউশনের গাফিলতি, লোকবল ও আদালতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাব এবং পদ্ধতিগত অদক্ষতার মতো বিষয়গুলো ফৌজদারি বিচার পদ্ধতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে যা অপরাধীদের অপরাধ করার প্রবণতা আরও বাড়াতে পারে।

পুলিশের সক্ষমতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এটি স্বীকার করা অপরিহার্য যে পুলিশের অপরাধ দমন ও অনুসন্ধানে অদক্ষতার কিছু উদাহরণ নিকট অতীতে দেখা গিয়েছে। তবে সমগ্র বাহিনী কম সক্ষম বলে চিত্রিত করা একটি অতি সরলীকরণ সমীকরণ হবে বলে আমি মনে করি।

অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সীমিত সংস্থান এবং পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জের মতো কারণগুলো অপরাধমূলক কার্যকলাপের জটিল ওয়েবকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে পুলিশের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং পারিবারিক কলহসহ অপরাধের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিত। সামাজিক কারণগুলো ছাড়াও অপরাধের মাত্রা ও ধরন কমিয়ে আনতে পুলিশ সময় দিতে পারে না।

জনসংখ্যার অনুপাতে দক্ষ পুলিশের সংখ্যা বাংলাদেশে অপ্রতুল থাকায় অপরাধের ধরন ও সংখ্যা দুটিই সার্বিকভাবে বেড়ে যায়। একইসঙ্গে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অপরাধের হারের বিরুদ্ধে আরও কার্যকর এবং ন্যায়সঙ্গত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কৌশলগত পদক্ষেপ, বিচার ব্যবস্থায় সংস্কারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অপরাধের হার মোকাবিলায় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলো মোকাবিলা করার জন্য একটি ব্যাপক পদ্ধতির প্রয়োজন। সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতার   মাধ্যমে নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই।

তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশে অপরাধ প্রতিরোধের কৌশল বাস্তবে খুবই সীমিত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে অপরাধ প্রতিরোধের বিভিন্ন কৌশল থাকতে হবে, তার মধ্যে কমিউনিটি-ভিত্তিক পুলিশিং এবং সমাজভিত্তিক বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। শুধুমাত্র অপরাধ প্রতিরোধে বিনিয়োগ প্রচলিত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার উপর চাপ এবং পুনরায় অপরাধের হার কমাতে পারে।

খন্দকার ফারজানা রহমান ।। সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, ক্রিমিনোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)