গত বছর মালয়েশিয়া লকডাউনের সময় কঠিন পরিস্থিতির কবলে পড়ে। জরুরি প্রয়োজনে যাতায়াত করতে পুলিশের অনুমতি লাগত। পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করতো, সবার গাড়ি চেক করতো। এমনকি মাহাথির মোহাম্মদ গাড়িও চেক করেছে। এ নিয়ে কোনো সমস্যা হোত না। রাষ্ট্রের পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে।

বাংলাদেশে কিছুদিন আগে ডাক্তার-ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশের ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সেই একই ঘটনার কোরিয়ান সংস্করণ আমি তুলে ধরলাম।

ম্যাজিস্ট্রেট: জিনসিমুরো সেসুনহামনিদা (আন্তরিকভাবে দুঃখিত) আপনার কি মুভমেন্ট পাস আছে?

ডাক্তার: জিনসিমুরো সেসুনহামনিদা (আন্তরিকভাবে দুঃখিত) আমি জেনেছি যে ডাক্তারদের মুভমেন্ট পাস লাগে না!

পুলিশ: দানসিনও সিনবুনজুংউল বুলসু ইসসুবনিদা (দয়া করে কিছু মনে করবেন না) আপনার আইডি কার্ডটা কি দেখতে পারি? অনেকে অনৈতিকভাবে সুযোগ নেয় তো তাই!

ডাক্তার: জিনসিমুরো সেসুনহামনিদা (আমাকে ক্ষমা করুন) তাড়াতাড়ি বের হতে গিয়ে বাসায় ফেলে এসেছি। আমি বিএসএমএমইউ’র (পিজি) একজন সহকারী অধ্যাপক।

ম্যাজিস্ট্রেট: সিনছা জিনসিমুরো সেসুনহামনিদা (সত্যিই আমরা দুঃখিত) আপনার সহযোগিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ! দয়া করে আইডি কার্ড সাথে রাখবেন, সবিনয় অনুরোধ করছি। সাবধানে যাবেন।

ডাক্তার: খোমাবসুমনিদা (আপনাদেরকেও ধন্যবাদ) আপনাদের দায়িত্ব দেখে আমি মুগ্ধ! করোনা মোকাবিলায় সবাই এক সাথে কাজ করবো। ভালো থাকবেন।

পুলিশ: দায়িত্বের খাতিরে আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য সেসুনহামনিদা (ক্ষমা প্রার্থী)। সাবধানে যাবেন।

কোরিয়া হলে ঘটনা এমন হতো নিশ্চিত। ডাক্তার-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যকার ঘটনার জাপানি সংস্করণ হলে কী হতো, সরকার জীবন নামের একজন প্রবাসী লিখেছেন,

ম্যাজিস্ট্রেট: সুমিমাসেন (আমাকে ক্ষমা করবেন) আপনার কি মুভমেন্ট পাস আছে?

ডাক্তার: সুমিমাসেন (আমাকে ক্ষমা করবেন) আমি জেনেছি যে ডাক্তারদের মুভমেন্ট পাস লাগে না!

পুলিশ: মোশি ওয়াকে গুজাইমাসেন (দয়া করে কিছু মনে করবেন না) আপনার আইডি কার্ডটা কি দেখতে পারি? অনেকে অনৈতিকভাবে সুযোগ নেয় তো তাই!

ডাক্তার: সুমিমাসেন (আমাকে ক্ষমা করুন) তাড়াতাড়ি বের হতে গিয়ে বাসায় ফেলে এসেছি। আমি বিএসএমএমইউ’র (পিজি) একজন সহকারী অধ্যাপক।

ম্যাজিস্ট্রেট: হনতোনি সুমিমাসেন (সত্যিই আমরা দুঃখিত) আপনার সহযোগিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ! দয়া করে আইডি কার্ড সাথে রাখবেন, সবিনয় অনুরোধ করছি। সাবধানে যাবেন।

ডাক্তার: ইইএ কচিরাকছো আরিগাতো গোজাইমাস (আপনাদেরকেও ধন্যবাদ) আপনাদের দায়িত্ব দেখে আমি মুগ্ধ! করোনা মোকাবিলায় সবাই এক সাথে কাজ করবো ভালো থাকবেন!

পুলিশ: দায়িত্বের খাতিরে আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য গোমেন নাসাই (ক্ষমা প্রার্থী)। সাবধানে যাবেন।

সত্যিকার অর্থে কোরিয়া-জাপান হলে ঘটনা এমনই হতো। আমরা উন্নয়নে জাপান হতে চাই, আচরণে কেন নই?

শিক্ষকদের সম্মান করা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, কঠিন বিপদে হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সম্মিলিতভাবে কাজ করা শৈশবে জাপানি শিশুদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়।

জাপান- প্রশান্ত মহাসাগরের একদম পূর্ব কোণে ৬৮০০টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটি দেশ; কিন্তু এই দেশটি নিয়ে মানুষের বিস্ময়ের সীমা নেই। প্রযুক্তির আশীর্বাদে গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছে জাপানিরা, কিন্তু তাদের সাফল্যের দৌড় কেবল কাঠখোট্টা প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, শিল্প-সাহিত্যে চিত্রকলা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের বিচরণ ঈর্ষণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ববাসী মনে করেছিল জাপান দাঁড়াতে পারবে না, কিন্তু সে জাপান বিশ্ব অর্থনীতির বর্ণিল মডেল।

জাপানের চলচ্চিত্র অস্কার পেয়েছে, কুস্তির জগতেও অনন্য। জাপানি শিশুদের স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি আচার-আচরণ, আদব-কায়দা শেখানোর বিষয়ে গভীর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে, সুন্দর ব্যবহারে ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। শিক্ষকদের সম্মান করা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, কঠিন বিপদে হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সম্মিলিতভাবে কাজ করা শৈশবে জাপানি শিশুদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়।

ক্লাসে ছাত্র-শিক্ষক নিজেরাই মিলেমিশে একসাথে ক্লাসরুম, ক্যাফেটেরিয়া পরিষ্কার করেন, জাপানি শিশুরা কোনো কাজকেই ছোট করে দেখে না। গত বিশ্বকাপে রাশিয়ার মাঠে জাপান ও কলম্বিয়ার ম্যাচের পর জাপান সমর্থকদের আনন্দ উল্লাস ছিল দেখার মতো। তারা সেই খেলায় ২-১ গোলে জিতেছে। দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দলের বিরুদ্ধে এটাই জাপানের প্রথম জয়।

বিশ্বজুড়ে পরিশ্রমী একটি জাতি হিসেবে জাপানিদের সুনাম রয়েছে। ঘরের কাজে, বাচ্চাদের যত্ন নেওয়ায়, বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ব্যস্ত সময় কেটে যায় জাপানিদের। পুরো জীবনটাই কাটে কাজের প্রতি বিপুল উদ্দীপনায়, পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে। তাদের সামাজিক বন্ধনগুলো অনেক সুদৃঢ়।

খেলার মাঠে কলম্বিয়াকে ধরাশায়ী করার পর জাপানি সমর্থকরা কিন্তু গ্যালারিতে শুধু আনন্দ উল্লাসেই মেতে থাকেননি, বরং তারা গ্যালারি পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে যান। ঘুরে ঘুরে তারা সব পরিষ্কার করে যান। জাপানি ফুটবল সমর্থকরা যে এধরনের কাজ প্রথম করেছেন তা নয়। এর আগেও বিভিন্ন খেলার পরে তারা দল বেঁধে স্টেডিয়াম পরিষ্কার করেছেন। এই রকম উপমা শত শত।

বিশ্বজুড়ে পরিশ্রমী একটি জাতি হিসেবে জাপানিদের সুনাম রয়েছে। ঘরের কাজে, বাচ্চাদের যত্ন নেওয়ায়, বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ব্যস্ত সময় কেটে যায় জাপানিদের। পুরো জীবনটাই কাটে কাজের প্রতি বিপুল উদ্দীপনায়, পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে। তাদের সামাজিক বন্ধনগুলো অনেক সুদৃঢ়।

বিভিন্ন সমস্যায় সবাই মিলে একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাধানে। জাপানের প্রতিটি মোবাইল ফোনে একটি ইমার্জেন্সি অ্যালার্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত করা থাকে। যেকোনো দুর্যোগ বিপর্যয়ে এই অ্যালার্মগুলো বেজে ওঠে সবার মোবাইলে (সাউন্ড অফ করা থাকলেও!) এবং মুহূর্তের মাঝে চলে যায় মেসেজ—এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তাদের সেটি জানিয়ে দেওয়া হয়।

একবার একটি মজার ঘটনা ঘটেছে। সুনামি আর ভূমিকম্পের আঘাতে বিপর্যস্ত পুরো জাপান, আক্রান্ত জনপদের কাছে খাদ্য, চিকিৎসা, সেবা ইত্যাদি পৌঁছে দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার, এমন সময় জনগণের সেবায় মাঠে নেমে এলো কুখ্যাত জাপানি মাফিয়া গোষ্ঠী- ইয়াকুজা! তাদের সংঘবদ্ধতা এবং পেশাদারিত্ব পুলিশের চেয়ে ঢের বেশি, দেখা গেল দুর্গম সব লোকালয়ে সরকারি সাহায্য পৌঁছানোর অনেক আগেই পৌঁছে গেছে তাদের ত্রাণ! এভাবেই দুর্যোগ আর বিপর্যয়ে গোটা জাতি যখন দুরবস্থায় পড়ে, ভালো খারাপের সীমানাটা তখন মুছে যায়, মুখ্য হয়ে উঠে একমাত্র পরিচয়-আমরা জাপানি।

এইভাবে জাপানকে অনুসরণ করে কোরিয়া তাদের সামাজিক ভিত দারুণ মজবুত করেছে, বিশ্ববাসীর কাছে জাপান এখন উদাহরণ। আমরা উন্নয়নে জাপান-কোরিয়া হতে চললেও আচরণে অমানবিক। করোনাকালে তাই প্রমাণ করলাম, অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি, কাড়ি কাড়ি সার্টিফিকেট অর্জনই সবকিছু নয়। দুর্যোগে বিনয়, ভদ্রতা, অন্যের সাথে সুন্দর আচরণ মুখ্য। দুর্যোগে পেশার পরিচয়, সীমানা মুছে দিয়ে, মুখ্য হয়ে উঠুক আমরা বাংলাদেশি।

ওমর ফারুক হিমেল ।। সাংবাদিক