সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২০ সালে সারা বিশ্বে যখন করোনাভাইরাস ত্রাসের রাজত্ব করছে তখন বাংলাদেশে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। ২০২১ সালের প্রথমার্ধে অনেকটা স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখন নতুন শক্তির করোনাভাইরাস সব হিসাব-নিকাশকে ভুল প্রমাণিত করে বাংলাদেশকে আক্রমণ করা শুরু করেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে আবার শতাধিক মানুষ মারাও যাচ্ছে। যা চিন্তার কারণ হয়ে পড়েছে।

সরকার দ্বৈত নীতি অবলম্বন করে সারা বিশ্বের মহামারির মধ্যেও অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত বছর করোনা আবির্ভাবের সময় থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার সাথে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনাও বন্ধ করেছিল। পরবর্তীতে ১ জুন থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে নানা স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক নির্দেশনা পরিপালনের মাধ্যমে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। যার ফলস্বরূপ এয়ারলাইন্সগুলো সব ধরনের নির্দেশনা মেনে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। ধারাবাহিকভাবে যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এয়ারলাইন্সগুলো ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে আবার একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে বাংলাদেশ এভিয়েশনকে।

গত ৫ এপ্রিল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ রেখেছিল সরকার। ১৬ দিন বন্ধ থাকার পর সীমিত পরিসরে ২১ এপ্রিল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু হয়েছে। বর্তমানে তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের মধ্যে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার চলমান। করোনার প্রাদুর্ভাবে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ সাময়িকভাবে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ রেখেছে। যার ফলে সহস্রাধিক কর্মচারী চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

উড়োজাহাজগুলোর পেছনে নানাবিধ খরচ বহাল আছে। এয়ারলাইন্সকে টিকিয়ে রাখতে হলে, দেশের আকাশপথকে সচল রাখতে হলে, স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক বিষয়গুলো পালনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিপূর্ণ সুযোগ দিয়ে দেশের এভিয়েশন শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত প্রদান করা উচিৎ।

পরিস্থিতির কারণে ফ্লাইট পরিচালনা যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্বাভাবিক না হয় তাহলে অবশিষ্ট দু’টি বেসরকারি এয়ারলাইন্সও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু ইউএস-বাংলা কিংবা নভোএয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যাপারটা এমন নয়, ব্যবসার এই অনিশ্চয়তায় রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

বাংলাদেশ বিমানের ২১টি, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ১৪টি আর নভোএয়ারের ৭টি উড়োজাহাজ অনেকটা অথর্ব হয়ে পড়ে আছে। উড়োজাহাজগুলোর পেছনে নানাবিধ খরচ বহাল আছে। এয়ারলাইন্সকে টিকিয়ে রাখতে হলে, দেশের আকাশপথকে সচল রাখতে হলে, স্বাস্থ্য সতর্কতামূলক বিষয়গুলো পালনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিপূর্ণ সুযোগ দিয়ে দেশের এভিয়েশন শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত প্রদান করা উচিৎ।

একটি রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পূর্বে যে সকল স্বাস্থ্য সতর্কতার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হয় তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো—প্রত্যেক যাত্রীর মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক, হ্যান্ড স্যানিটাইজিং, ফেসশিল্ড ব্যবহার, ককপিট ও কেবিন ক্রু’র পিপিই পরিধান, সামাজিক দূরত্ব মানা, তিন ধাপে শরীরের তাপমাত্রা মাপা, আসন সংখ্যা সীমিতকরণ, প্রত্যেকটি ফ্লাইট শুরুর পূর্বে এয়ারক্রাফটকে ডিসইনফেক্টেড করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রত্যায়ন পত্র নেওয়া, পানি ব্যতীত অন্যান্য খাবার সরবরাহ না করা, র‌্যাম্প কোচে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনটেইন করা ইত্যাদি বিষয় পালনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রুটসহ আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা স্বাভাবিক করা যেতে পারে। এই ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখা এখন সময়ের দাবি।

সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে অভ্যন্তরীণ রুটে স্বাভাবিক ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ দিলে এভিয়েশন শিল্প রক্ষা পাবে। গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে ৭টি বেসরকারি বিমান সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে টিকে আছে মাত্র ২টি সংস্থা। সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আকাশপথকে সুগম করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও নভোএয়ার।

একটি দেশের এয়ারপোর্ট হচ্ছে ড্রইং রুমের মতো। আর তার সৌন্দর্য হচ্ছে এয়ারলাইন্সগুলোর সরব উপস্থিতি। এয়ারলাইন্স টিকে থাকলে পর্যটন টিকে থাকবে আর পর্যটন টিকে থাকলে হোটেল ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকবে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে হলে দেশের এভিয়েশনকে টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি।

গত ৬-৭ বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ। এর মূল কৃতিত্বই বেসরকারি বিমান সংস্থার। আজ যদি করোনার করালগ্রাসে দেশীয় বিমান সংস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়, অদূর ভবিষ্যতে এভিয়েশন খাতে কোনো বেসরকারি বিনিয়োগ না আসার সম্ভাবনা দেখা দিবে। যার ফলে দেশের আকাশপথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। পর্যটন খাত ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে যাবে। শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণের পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে।

রাজধানী ঢাকার বাইরে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার যে প্রতিযোগিতা দেখছি তা সংকুচিত হয়ে যাবে। এভিয়েশনকে অন্যান্য শিল্পের সাথে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

একটি দেশের এয়ারপোর্ট হচ্ছে ড্রইং রুমের মতো। আর তার সৌন্দর্য হচ্ছে এয়ারলাইন্সগুলোর সরব উপস্থিতি। এয়ারলাইন্স টিকে থাকলে পর্যটন টিকে থাকবে আর পর্যটন টিকে থাকলে হোটেল ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকবে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে হলে দেশের এভিয়েশনকে টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি।

আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে দেশীয় এয়ারলাইন্স দেশের জিডিপিতে সহযোগিতা করছে। দেশীয় এয়ারলাইন্স টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলে দেশ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়াও খুবই জরুরি, একটি এয়ারলাইন্সের পরিচালন ব্যয়ের ৪০% হচ্ছে জ্বালানি খরচ। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধি কিংবা কমানো জরুরি। করোনা মহামারিকালীন সময়ে গত বছর আগস্ট থেকে চলতি বছর মার্চ মাস পর্যন্ত চার বার জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এসময়ে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম লিটার প্রতি ১৪ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে মহামারির সময় টিকে থাকাই দুষ্কর সেখানে অযৌক্তিহারে জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধি এভিয়েশন ব্যবসায় টিকে থাকা এয়ারলাইন্সগুলোকে ভয়ানক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর পরিচালন ব্যয়ের এ বৃদ্ধিকে সামঞ্জস্য করার জন্য যাত্রীদের ভাড়ার উপর সরাসরি প্রভাব পড়ে। ফলে যাত্রী সংকটের সৃষ্টি হয়।

এভিয়েশনের ক্ষেত্রে সকল সিদ্ধান্তই হোক সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত। দেশের ড্রইং রুমের সৌন্দর্য রক্ষা করার জন্য দেশীয় এয়ারলাইন্সকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে।

মো. কামরুল ইসলাম ।। মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স