ছবি : সংগৃহীত

ছাত্রলীগ সম্পর্কিত খবরগুলো আপনারা দেখেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা হলে স্বামীকে আটকে রেখে একজন গৃহবধূকে ধর্ষণ করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে তথাপি আবাসিক হলে দিব্যি বসবাস করে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতারা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয় ছাত্রলীগের আশ্রয়ে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রকে গণরুমে ডেকে নিয়ে জোর করে রাতভর নির্যাতন করেছে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা। প্রতিবেদনগুলোর কথা জেনেছি দেশের প্রভাবশালী গণমাধ্যম থেকে।

সবই সাম্প্রতিক, ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা নয়। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধের খবর প্রায় নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে। সংবাদ প্রকাশের পর আমরা প্রতিবাদ করি। প্রতিবাদের ফলে ঘটনার সাথে জড়িত নেতাকর্মীদের বরখাস্ত করা হয় ছাত্রলীগ থেকে এবং ধীরে ধীরে খবরটি আড়ালে চলে যায়, আমরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ি নতুন খবর নিয়ে।

ব্যতিক্রমী দুই-একটা ঘটনা ছাড়া ছাত্রলীগের যেসব নেতাকর্মী এইসব অপরাধের সাথে জড়িত থাকে তাদের সাধারণত কোনো আদালতে শাস্তি হয় না। ব্যতিক্রমের মধ্যে আছে আবরার হত্যা এবং বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনাটি, দুটি ঘটনার বিচার হয়েছে। কয়েকজন দণ্ড প্রাপ্ত হয়েছে।

সাধারণ মানুষ এত ক্ষুব্ধ হয়েছিল আর ঘটনা দুটি এত প্রচারিত ও আলোচিত হয়েছিল যে হত্যাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার না করে কোনো উপায়ও ছিল না সরকারের হাতে। কিন্তু প্রতিদিনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সাধারণত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় না, কোনো বিচার হয় না, কারও সাজা পর্যন্ত হয় না।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রলীগ যখন অন্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় সেইসব হামলার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সাধারণত কোনো ব্যবস্থা নেয় না। উল্টো ছাত্রলীগ নেতাদের দেখা যায় গণমাধ্যমে এসে অন্য সংগঠনের ওপর হামলা করার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে।

ছাত্রলীগ অনেক বড় সংগঠন। বিপুল সদস্য সংখ্যা তাদের। এত ছেলেমেয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে দুই একজন তস্কর তো বের হতেই পারে। সেই কথা কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে যে এই সংগঠনটির অসংখ্য নেতাকর্মী কোনো না কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত এবং প্রায় প্রতিটা ক্যাম্পাসেই ওরা প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা করে এবং তার পক্ষে যুক্তি দেয় তখন আমাদের ভাবতেই হবে, সমস্যাটা কেবল গুটিকয় ছাত্রের তস্কর স্বভাবের কাজ নয়। এইসব অপরাধমূলক কাজ সংগঠনটির চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।

ছাত্রলীগের মধ্যে আদর্শহীনতা এমন পর্যায়ে গেছে যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি যেটা—ধর্মনিরপেক্ষতা তা থেকেও সরে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিটা আনুষ্ঠানিকভাবে ওরা সরিয়ে দেয়নি বটে, কিন্তু সংগঠনটির নেতাকর্মীদের চেতনার মধ্যে এবং ওদের নিজেদের দৈনন্দিন চর্চার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন আর অবশিষ্ট নেই।

এখন প্রয়োজন হয়ে গেছে ভেবে দেখার, একটি গণতন্ত্রমনা ধর্মনিরপেক্ষ ছাত্র সংগঠন, এই দেশের ইতিহাসের প্রায় প্রতিটা পর্যায়েই যাদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সেই সংগঠনটি কেমন করে সংগঠিত অপরাধীদের মতো একটি ভীতিকর গ্যাং-এ পরিণত হয়েছে? ভেবে দেখা দরকার, কীভাবে এইরকম ভীতিকর একটি সংগঠনের হাত থেকে ক্যাম্পাসগুলো এবং গোটা দেশের ছাত্র সমাজ রক্ষা করা যায়।

প্রথমেই দেখুন, ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনগুলোর কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া, অন্য সংগঠনগুলোর ওপর আক্রমণ করা, মারধোর করা বা কোনো কোনো সময় অন্য ছাত্রদের মারধোর করার পর ছাত্রলীগের নেতারা গণমাধ্যমের সামনে এসে কী যুক্তি দেয়।

ছাত্রদলের ওপর হামলা করার পর তারা বলল যে, ছাত্রদল ১৫ আগস্টের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার বলে শ্লোগান দিয়েছে, এটা অন্যায়, সেই জন্য সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে আমরা প্রতিরোধ করেছি। আবরার নামে যে ছেলেটাকে বুয়েটে হত্যা করা হয়েছিল, সেই ঘটনার পক্ষেও প্রথমে ওরা একটা যুক্তি দিতে চেষ্টা করেছিল, সেই ছেলেটা শিবির করতো ইত্যাদি।

এইসব কথা শুনলে প্রথমেই আপনার মাথায় যে প্রশ্নটা আসবে তা হচ্ছে, মানলাম ওরা অন্যায় শ্লোগান দিয়েছে বা শিবির করছে। কিন্তু তুমি কে হে বাপু? আইন করে কি ছাত্রলীগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যে, যারা অন্যায় শ্লোগান দিচ্ছে ওদের ধরে মারতে হবে? তা তো হয়নি। তাহলে? এটা ওরা নিজেরাই নিজেদের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে যে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ক্যাম্পাসগুলোয় আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যেইই কথা বলবে তাকেই পেটাতে হবে।

ছাত্রলীগ নিজে থেকেই লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর ছাত্র সংগঠন যখন লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয় তখন এই লাঠিয়ালরা কেবল রাজনৈতিক প্রয়োজনে অন্যের মাথায় আঘাত করবে না, যেকোনো প্রয়োজনেই অন্যের মাথায় লাঠি মারবে এবং এই শক্তিটা সে নিজের লাভের জন্যেও ব্যবহার করবে।

এই কারণেই দেখবেন ছাত্রলীগের কর্মীদের নাম আসে ছিনতাইয়ের ঘটনায়, চাঁদাবাজির ঘটনায় এবং জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায়। আর যেহেতু ওদের হাতে লাঠি আছে, যারা ক্যাম্পাসে নিশ্চিন্তে মাদক ব্যবসা করতে চায় ওরাও ছাত্রলীগের কাছেই যায়—ভাই তোমাদের আমরা টাকা দিচ্ছি, তোমার আমাদের দিকটা একটু দেখবে।

ওরা তো নিজেদের এমনিতেই গুণ্ডামিতে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে, ওরা যখন কারও মাথায় হাত রাখে তখন তার আর মাদক কেনাবেচায় কোনো অসুবিধা হয় না। আর দেশের পুলিশও তাদের কিছু বলে না। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর কর্তৃপক্ষ ওদের কিছু বলে না—এরা একরকম একটা দায়মুক্তি পেয়ে যায়, যে আমাদের তো কিছু হবে না।

ছাত্রলীগের এখন আর কোনো নীতি আদর্শ নেই, রাজনৈতিক কোনো মতামত নেই। একধরনের দায়মুক্তি উপভোগ করে ওরা—পুলিশ ধরবে না, কোনো বিচার হবে না।

এর সাথে যোগ হয়েছে দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, প্রায় বিনা নির্বাচনেই একটি দলের বারবার ক্ষমতায় আসা এবং স্বৈরাচারী স্টাইলে সরকার পরিচালনা করা। তখন কী হয়? তখন সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের জন্য কোনোপ্রকার নীতি আদর্শ অবশিষ্ট থাকে না। ওরা তো বলতে পারবে না—দেশে গণতন্ত্র চাই। তা বললেই তো ওদের দলের বিপক্ষে যায়। ওদের জন্য শ্লোগান অবশিষ্ট থাকে মাত্র একটাই—কোন সে নেত্রী, বিকল্প নাই ইত্যাদি। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বহুত্বের বিপরীতে একজন ব্যক্তির নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব মেনে নেওয়া এবং সেই নেত্রীকে একপ্রকার দেবত্ব আরোপ করে তাকে ক্ষমতায় বজায় রাখার জন্যে যা কিছু করার তা করা হয়।

তাহলে এই সংগঠনটির কি আর গণতন্ত্রের আলাপ দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে? ছাত্রলীগের এখন আর কোনো নীতি আদর্শ নেই, রাজনৈতিক কোনো মতামত নেই। একধরনের দায়মুক্তি উপভোগ করে ওরা—পুলিশ ধরবে না, কোনো বিচার হবে না। এবং হাতে আছে লাঠি। তাহলে এইসব ছেলেমেয়ে কি রাজনীতি করবে নাকি গুণ্ডামি করবে?

ছাত্রলীগের মধ্যে আদর্শহীনতা এমন পর্যায়ে গেছে যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি যেটা—ধর্মনিরপেক্ষতা তা থেকেও সরে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিটা আনুষ্ঠানিকভাবে ওরা সরিয়ে দেয়নি বটে, কিন্তু সংগঠনটির নেতাকর্মীদের চেতনার মধ্যে এবং ওদের নিজেদের দৈনন্দিন চর্চার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা এখন আর অবশিষ্ট নেই।

এটা একটা বহিঃপ্রকাশ ছিল ক’বছর আগে ওরা ১৫ আগস্ট উপলক্ষে ইসলামী জলসার আয়োজন করেছিল আর সেইখানে অতিথি হিসবে রেখেছিল দেশে পরিচিত সবচেয়ে মৌলবাদী কিছু মৌলানা। পরে সেই কর্মসূচি সমালোচনার মুখে পড়ে এবং আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের হস্তক্ষেপে বাতিল হয় বটে, কিন্তু যে রাজনৈতিক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ সেই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল, তা তো আর মুছে যাবে না চট করে।

একটি সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে যদি রাজনৈতিক আদর্শ না থাকে, সেই সাথে যদি ওদের থাকে বিচার ও শাস্তি থেকে দায়মুক্তি, সেই সাথে যখন যুক্ত হয় সীমাহীন ক্ষমতা, তাহলে সেই সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে না?

ধর্ষণ হচ্ছে এই রকম অমিত ক্ষমতা প্রকাশের একটা মাধ্যম। এমনিতেই ধর্ষণ তো মানুষ নিতান্ত যৌন চাহিদা পূরণের জন্য করে না। ধর্ষণ হচ্ছে নারী পুরুষের ক্ষমতার রাজনীতিতে একটা রাজনৈতিক ঘটনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের যে দলবদ্ধ ধর্ষণের খবর আমরা পড়েছি, তাও নিতান্ত একদল নীতি আদর্শহীন ছাত্রকর্মীর ঐরকম ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। জড়িতদের আইনগতভাবে সাজা দিতে হবে, তা তো অবশ্যই। কিন্তু ছাত্রলীগের যে চারিত্রিক প্রকাশ এখন আমরা দেখছি এটা কীভাবে ঠিক হবে?

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট