ছবি : সংগৃহীত

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য যে বাড়বে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই বিষয়ে সবার দৃষ্টি মূল জায়গায় নেই। আশেপাশে ঘুরছে। সমস্যাটা কেউ ধরতে পারেননি বলেই গাছের সারফেসে থাকা পাতার সমস্যা নিয়ে সবাই উঠে পড়ে লেগেছেন।

সমস্যা তো গাছের মূলে যা মাটির নিচে। নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা অনেক গভীরে। একটি দেশে শিক্ষার একটি মূলধারা থাকে। সেই মূলধারা খুব চ্যালেঞ্জিং হতে হয়। তাই জার্মানির মূলধারাকে জিমনেসিয়াম বলে। এই ধারায় সবাই পড়বে না।

শিক্ষার্থীরা যত উপরের ক্লাসে উঠবে তত অনেকেই ঝরে যাবে। এই ঝরে যাওয়াদের কারিগরি ধারায় নিয়ে যেতে হবে যাতে কেউ যদি নাপিতও হতে চায় সেও একটা কারিগরি ধারায় পড়ে প্রপার সাইন্টিফিক নাপিত হতে পারে, প্রপার সাইন্টিফিক প্লাম্বার বা ইলেক্ট্রিশিয়ান হতে পারে।

এই কারগরি শিক্ষায় শিক্ষিতদের যখন মধ্যপ্রাচ্যে বা মালয়েশিয়াতে কর্মী হিসেবে পাঠাবেন এরা আমাদের বর্তমান বিশজন কর্মীর বেতন একজনই আয় করবে।

একটা দেশে সবাই খ্যাতিমান চিকিৎসক, দার্শনিক, লেখক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি, চিত্রশিল্পী হয় না। একটা দেশে আইনস্টাইন, অমর্ত্য সেন, নোয়াম চোমস্কি এইরকম মানুষের সংখ্যা খুব বেশি থাকেও না, লাগেও না।

আমাদের ব্রেইনের বিলিয়ন বিলিয়ন নিউরন আছে। সব নিউরনের গুরুত্ব সমান না। হাজার হাজার নিউরন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আমাদের ব্রেইনের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নিউরন দুয়েকটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেই ব্রেইন তার পূর্ণ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে।

তাই মূলধারার শিক্ষার লক্ষ্যই থাকে উচ্চমানের বিজ্ঞানী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি তৈরি করা। বাংলাদেশি স্থপতি ফজলুর রহমান খান বা এফ আর খানকে বলা হয় স্থপতিদের আইনস্টাইন। এইরকম মানুষ কি খুব বেশি লাগে বা থাকে?

একটা দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ কারিগরি ধারায় নিতে হবে। আবার ওটাও সর্বশেষ পথ না। কেউ ওখানে ভালো করলে তাকে আবার মূলধারায় ফিরিয়ে নিতে হবে। মূলধারা থেকে যারা ঝরে যাবে তাদের কারিগরি ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।

কয়েকদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে কেউ স্কুল-কলেজ থেকে ঝরে গেলেও কিছু করে খেতে পারে। অর্থাৎ এক অর্থে তিনি বলেই দিয়েছেন নতুন শিক্ষাক্রমকে কারিগরি ধারায় নামিয়ে এনেছেন। সেই লক্ষ্যেই তথ্যপ্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা ইত্যাদি বিষয় ঢুকিয়েছেন।

পৃথিবীর কোনো দেশের শিক্ষার মূলধারায় এই ধরনের বিষয় আছে? কোথাও যদি থেকে থাকেও তা অনৈচ্ছিক হিসেবে থাকে। ছোট বয়সেই শিক্ষার্থীদের গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ভালোবাসা জন্মায়।

আমার বড় কন্যার পদার্থবিজ্ঞান ও সাহিত্যে ভালোবাসা জন্মেছিল। পরে শেষ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই পড়েছে। আমার ছোট কন্যা জীববিজ্ঞানের প্রেমে পড়েছে। এখন সে বলছে, পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে সে পড়বে। আপনারা নতুন যে শিক্ষাক্রম চালু করেছেন এতে শিক্ষার্থীরা কি প্রেমে পড়ার মতো যথেষ্ট কনটেন্ট পাবে?

যেই শিক্ষাবিদরা আজকে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা ঢাকঢোল পেটাচ্ছেন, তাদের সন্তানরা কোথায় পড়ে আমি তার বিশদ তথ্য চাই। বিশেষ করে অধ্যাপক মশিউজ্জামান, অধ্যাপক তারিক আহসান, বর্তমান ও ভূতপূর্ব শিক্ষামন্ত্রী, সচিব, এমপিদের সন্তানরা কোন মাধ্যমে পড়ে? নিজেদের সন্তানরা যদি এই মাধ্যমে না পড়ে থাকে তাহলে এই শিক্ষাক্রমের গুণগান গাওয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই।

ইংল্যান্ড কি বোকার দেশ? ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাক্রম যারা বানিয়েছে তারা কি আপনাদের চেয়ে বোকা? পৃথিবীর ১৪০টিরও বেশি দেশে ইংরেজি শিক্ষাক্রম এত জনপ্রিয় কেন? নিজেদের সন্তানের কথা যখন আসে তখন ইংরেজি মাধ্যমই সবার পছন্দ কেন? সর্বজনীন বাংলা মাধ্যমকে ধ্বংস করবেন না।

যারা নতুন শিক্ষাক্রমের কারিগর তারা কি শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি কখনো করেছেন? তারা কি শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি কখনো করেছেন? শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি কি কখনো করেছেন? পাঠ্যবইয়ের ছাপার মানের বৃদ্ধির দাবি কি কখনো করেছেন? করেননি, কেন?

চীনের প্রকৌশলীরা আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দিলো, জাপানের প্রকৌশলীরা মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণ করে দিলো, রাশিয়ার বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীরা আমাদের আরেক স্বপ্নের মেগা প্রজেক্ট রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করছে, কোরিয়ান প্রকৌশলীরা পার্বতীপুর খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে দিচ্ছে, ফ্রান্সের কোম্পানি আর তাদের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা আমাদের টাকায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বানালো এবং তারাই আমাদের হয়ে উড্ডয়ন করে দিলো।

এত বছরেও আমরা বিজ্ঞানী কিংবা প্রকৌশলী বানাতে পারলাম না যারা একটা বড় সেতু বানাতে পারে, যারা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানো থেকে শুরু করে সব ধরনের তদারকি করতে পারে। আমরা কি স্যাটেলাইট বানাতে পারি? না পারলে এইসবের পেছনে যেই অর্থ ব্যয় করেছি সেই অর্থ ব্যয় করে যদি আমরা বড় বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলী বানানোর জন্য কয়েকটি বিশ্বমানের ইন্সটিটিউট তৈরি করতে পারতাম তাহলে দেশে উচ্চমানের মানুষের সংখ্যা বাড়তো, যার ফলে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্র বিশেষ করে সুশাসনেও প্রতিফলন ঘটতো।

আমরা আগে মানুষ তৈরির কারখানা না তৈরি করে অন্য দেশের মানুষ দিয়ে সব নির্মাণ করছি। ভারত কি তা করেছে? তারা আগে মানুষ বানিয়েছে আর নিজেদের মানুষ দিয়ে অবকাঠামো তৈরি করছে এবং করেছে। তারা নিজেদের মানুষ দিয়ে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ও বোমা বানিয়েছে, মেট্রোরেল ও বড় বড় সেতু বানিয়েছে। এতে অর্থ সাশ্রয় হয়েছে, আরও বেশি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে।

কেন এখনো পর্যন্ত একটা ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সাইন্সের মতো প্রতিষ্ঠান বানাতে পারলাম না? ভারত চব্বিশটার মতো আইআইটি বানিয়েছে আমরা কেন আইআইটির মতো একটা প্রতিষ্ঠানও বানাতে পারলাম না? কেন আমাদের ধনীরা টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের মতো একটা প্রতিষ্ঠান বানাতে পারলো না? কেন?

এইসব প্রশ্নের উত্তর আর মেলে না। কারণ যেখানে শিক্ষাক্রম নিয়ে অসংখ্য এক্সপেরিমেন্ট সেই জায়গায় শিক্ষা নিয়ে অনেক বড় কিছু কি আশা করা যায়?

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়