ছবি : সংগৃহীত

নাটক বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সবটুকুর কৃতিত্ব যাকে দিতে হবে তিনি অধ্যাপক সেলিম আল দীন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য খোলা জানালা। গতানুগতিক পাঠদানে তিনি বিশ্বাস করতেন না; ফলে সবসময় তিনি শ্রেণিকক্ষে বসতেনও না।

আবার বসলেও কখনো কখনো প্রচলিত রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করতেন না। তার সবকিছু ছিল নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। এসব অনন্যতার কারণেই হয়তো তিনি রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাংলা নাটকে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একজন হতে পেরেছেন।

ফলে সেলিম আল দীনের ছাত্র হিসেবে আমার ভেতর ভাবগত, বোধগত, চেতনাগত একটি উচ্চতা তৈরি হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই। এই উচ্চতাটি সভ্যতার সঙ্গে অসভ্যতার, ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের, মানবিকতার সঙ্গে অমানবিকতার, সত্যের সঙ্গে অসত্যের, সুন্দরের সঙ্গে অসুন্দরের, শ্লীলতার সঙ্গে অশ্লীলতার একটি দেয়াল তৈরি করে দেয়।

এই দেয়াল তৈরি করতে আরও যারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে এসে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, হায়াৎ মামুদ, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কবি রফিক আজাদ, অমলেন্দু বিশ্বাস, ম হামিদ, আফজাল হোসেন, ড. রশীদ হারুন, ড. লুৎফুর রহমান, ড. আমিনুল ইসলাম দুর্জয়, অধ্যাপক খায়রুজ্জাহান যিতু, অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক অন্যতম। এদের প্রত্যেকেই আলোকিতজন। জ্ঞানে, মেধায় ও প্রজ্ঞায়।

ফলে চাইলেই আমি এখন আর মানহীন কোনো নাটক যেমন দেখতে পারি না, তেমনি সস্তা সারবস্তুহীন কোনো বই পড়তে চাইলেও পারি না। এমনকি গান, চলচ্চিত্র, চিত্রকলাও একই। দেখার একটা চোখ, শোনার একটা কান, বোঝার একটা মন আমার তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে যেকোনো বাজে বিষয় আমাকে তীব্র বিকর্ষণ করে। রুচিহীনতায় আমার বিবমিষা, যার কারণে আমি কোনো সাংস্কৃতিক অসভ্যতার কেবল নিন্দাই করি না, তীব্র প্রতিবাদও জানাই।

ইদানীং টেলিভিশন নাটক নিয়ে আমি বেশ কয়েক জায়গায় আলাপ করেছি। টেলিভিশন  নাটকে এখন রীতিমতো বাংলা চলচ্চিত্রের কাটপিস যুগ চলছে। অসভ্য সংলাপ, গালাগালি, খিস্তি খেউড়, যারপরনাই অশ্লীল।

এসব নাটকের যেমন মান, তেমন নির্মাণ। একটি নাটক নির্মাণে সকাল থেকে দুপুর এক বেলাই যথেষ্ট; দিনও নয়। নাম শুনলেই মান বোঝা যায়, রীতিমতো অশ্লীলতার চূড়ান্ত।

টেলিভিশন এখন আর ব্যবসা করতে পারছে না। ভালো কনটেন্ট না দিতে পারা তার মূল কারণ। ফলে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের ফেসবুক পেজে ‘কাটপিস’ আপ করছে। কোনো কোনো টেলিভিশন নাটকে ‘বিশেষ দৃশ্য’ ধারণ করছে শুধু ফেসবুক পেজে আপ করবে বলে। অশ্লীলতার একটা সীমা থাকে, মাত্রা থাকে, পরিমাপ থাকে সেই সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে আরও অনেক আগেই।

মনে রাখতে হবে, কাটপিস কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রকে বাঁচাতে পারেনি, উপরন্তু বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ফলে টেলিভিশনগুলো এই পদ্ধতি অবলম্বন করে বাণিজ্যিকভাবে টিকবে কিনা যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু কথায় বলে ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি’ কাটপিসেও যখন কাজ হচ্ছে না, টিআরপি যখন ক্রমাগত নামতে শুরু করেছে তখন বেশকিছু বেসরকারি টেলিভিশন ভাইরাল কনটেন্টের দিকে ছুটতে শুরু করেছে।

ফলে যত খারাপ, অসৎ ব্যক্তি, বস্তু বা বিষয় হোক টেলিভিশন পাগল হয়ে উঠেছে তা পর্দায় নিয়ে আসতে। টেলিভিশনের পাশাপাশি বেশকিছু দৈনিক পত্রিকার অনলাইন ভার্সনও এই দৌড়ে সামিল হয়েছে।

কিছুদিন সবাই মিলে হিরো আলমের পেছনে ছুটেছে। কোথায় এখন সেই মহানায়ক? গালাগালি করে কাপড় বিক্রি করা ফাতেমা তনিকেও এখন টেলিভিশনে নিয়ে আসে। খিস্তি খেউড় করে যে ভিউ টানে। শঙ্কা জাগে কবে না টেলিভিশনগুলো উন্মাদ সেফুদাকে লাইভে নিয়ে আসে।

এই মানহীনতা, অসুস্থ, বিকারগ্রস্ত প্রতিযোগিতার সর্বশেষ সংযোজন নাগরিক টেলিভিশন। টেলিভিশনটির জন্য আমার মায়া হয়, কষ্ট হয়, করুণা হয়; কী করে নাগরিক টেলিভিশন এত নিচে নেমে যেতে পারে?

যে টেলিভিশনটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। দেশের সেরা উপস্থাপকদের একজন। রুচিশীল পরিশীলিত মানুষদের একজন। যার মালিকানায় রুবানা হকের মতো একজন নারী উদ্যোক্তা রয়েছেন।

যিনি মানুষকে আশার বাণী, স্বপ্নের বাণী শোনান—তার টেলিভিশনে এমন হতাশাজনক কর্মকাণ্ড টেলিভিশনের টিআরপি বাড়াতে এত খাঁদে নামতে হবে? নর্দমায় নামবে? রুচির কী ভয়ংকর নিম্নগামিতা। তবে কি টাকা উপার্জনই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য?

মুনিয়া, যে মেয়ে মোবাইল চুরি করে বেড়াতো, বিভিন্ন হাসপাতালে ভুয়া ডাক্তার হিসেবে ঘুরতো, টিকটক করে বেড়াতো, যে জেলখাটা আসামি; যাকে নিয়ে ঢাকা পোস্ট ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে প্রতিবেদন ও ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাকে টেলিভিশনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সাক্ষাৎকার নেওয়ার কারণ কী? ভাইরাল হলে লাভ এই কারণে?

তাহলে আগামীতে কী চোর, বাটপার, ধর্ষক, কসাই, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হবে টেলিভিশন? বাটপার কী করে লোক ঠকায় সেই গল্প শোনাবে? ধর্ষক কী করে জোর করে টেনে হিঁচড়ে বা বেঁধে ধর্ষণ করে তার বর্ণনা দেবে। এতে ক্ষতি কী, টিআরপি তো বাড়বে। বাজারে তো এখনো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বইয়ের চেয়ে বাজে বইয়ের বিক্রি বেশি।

সমস্যা হলো, আমরা মুখে এক আর কাজে আরেক। স্বভাবে দ্বিচারী, কথায় সুফি সাধক। অর্থ গৃধ্নুতায় মরিয়া সবাই। যেকোনো মূল্যে টাকা উপার্জন করতে চাই। মূল্যবোধ বলে বুলি আওড়াই, কিন্তু নিজের মূল্যবোধের ন্যূনতম নেই।

গণমাধ্যমের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কতটা নিচে নামবে তারও কোনো পরিমাপ নেই। শুধু মিডিয়ার কারণেই ডা. সাবরিনা চৌধুরীর মতো অসৎ চিকিৎসক এবং খন্দকার মুশতাক আহমেদের মতো অসভ্য লোক আলোচনায় উঠে আসে। সবই টিআরপির স্রোত।

এই টিআরপির স্রোতে যে যা ইচ্ছা তাই করছে। কে, কখন, কী দেখাচ্ছে তা বলা মুশকিল। তাই নতুন করে একটি কার্যকর নীতিমালা প্রয়োজন, অন্তত অসভ্যতা ঠেকাতে, অশ্লীলতা ঠেকাতে, মিথ্যার বিরোধিতায়। সোজা কথা সংস্কৃতি বাঁচাতে। আর সংস্কৃতি না বাঁচলে এই ফাঁপা গণতন্ত্র দিয়ে কী হবে?

জব্বার হোসেন ।। সম্পাদক আজ সারাবেলা; সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম যুক্তরাষ্ট্র