ছবি : সংগৃহীত

লেখাটা লিখতে গিয়ে দেখলাম, এই দেশে বহু নারীই পুরুষের টাকায় চলে। আবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী নিজের টাকায় চলে। আবার এমনও হয়, নারী ও পুরুষের টাকায় যৌথভাবে চলে সংসার, সন্তান লালনপালন হয়, পরিবারের দেখাশোনার কাজ হয়। তাহলে ‘নারী শুধু পুরুষের টাকায় চলে’—এই বিতর্কের উদ্ভব কেন?

একই রকম আরও কিছু বিতর্ক হয়—নারী অঙ্ক পারে না, বিজ্ঞান বোঝে না, প্রযুক্তিতে গাধা। নারীর গাড়ি চালানোর হাত ভালো না। নারী খেলা বোঝে না, খেলতে পারে না। এই সব বিবৃতি—এগুলো নির্দিষ্ট সংখ্যক পুরুষেরা বলে মজা পায়।

এখন যদি ভেবে দেখেন, দেখবেন—অঙ্ক, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির শাখায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে কম। কিন্তু বহু নারী আছে যারা বিজ্ঞানের বিশাল শাখায় জটিল গবেষণায় নিযুক্ত, বড় বড় আবিষ্কার করছে। প্রযুক্তি উদ্ভাবনও করছে। আবার বড় বড় প্রজেক্টে নারী বিজ্ঞানী নেতৃত্ব দিচ্ছে। এখন সেই ক্লিশে স্টেরিওটাইপকে তাহলে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? ভাঙবেনইবা কীভাবে?

কিছু পুরুষের মধ্যে একধরনের আদিম হীনমন্যতা আছে। সেই হীনমন্যতার উৎস নারীর শক্তিমত্তার প্রতি ঈর্ষা থেকে। নারী চিরকালই পুরুষের চেয়ে শক্তিশালী, কারণ নারীই বহন করে মানব প্রজাতির ধারা। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় একজন নারীর পাশে যদি কোনো পুরুষ নাও থাকে তবুও তিনি পৃথিবীকে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে পারবে।

লিঙ্গ সমতা ও নারীবাদ পুরুষের হীনমন্যতার বোধকে বারবার উসকে দেয়, কারণ পুরুষের ভেতরে সমতার প্রতি কোনো সমর্থন বা সম্মান নেই। পুরুষ চায় আগ্রাসী ক্ষমতা, উচ্চ অবস্থান, যা এতদিন পেয়ে এসেছে। কিন্তু সময়ের দাবিতে আজকে সমতার যে আন্দোলন তা তার এই অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ফলে পুরুষ এখন ভুগছে হীনমন্যতায়।

পৃথিবীর বহু স্থানে নারী একই কাজ করেও পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পায়। নারীর পদোন্নতি হয় ধীরে। কর্মক্ষেত্রের বাস্তবতা আজও নারীর জন্য যুদ্ধক্ষেত্র।

পৃথিবীর সব পুরুষ যে হীনমন্যতায় ভুগছে তা নয়, যে বিশেষ গোষ্ঠীর কথা আমরা বলছি বা আমরা যে বিশেষ গোষ্ঠীর বিষয়ে দৃষ্টি দিচ্ছি তারা আজীবনই হীনমন্যতা নামক শব্দের মধ্যে আটকে থাকে। সেই হীনমন্যতার বোধ থেকেই তারা এইসব অদ্ভুত স্টেরিওটাইপ বক্তব্যকে বারবার সামনে নিয়ে আসে। যেমন—নারী কীসে আটকায়? পুরুষের টাকায় নারীর ঈদ শপিং? ঘরের কাজ কি কেবল নারীর?

শতাব্দীর পর শতাব্দী নারীকে ওই ঘরেই রাখা হয়েছে। পুরুষের মতো সমানভাবে তারা শিক্ষার সুযোগ পায়নি, বিজ্ঞান চর্চা করতে পারেনি, চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে পারেনি। নারী পুরুষের মতো করে উপার্জন করতে পারেনি। নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করতে পারেনি। নারী শুধু ঘর করেছে। থালাবাসন ধুয়েছে, সংসার গুছিয়েছে, সন্তানের লালনপালন করেছে। একজন নারী পুরুষের অফিস যাওয়া থেকে শুরু করে ঘরে ফেরা পর্যন্ত সবধরনের উপাদান সরবরাহ করেছে।

আর পুরুষ অফিস গিয়েছে এবং অর্থ উপার্জন করেছে। নারী ঘরে থেকে দিনরাত একা করে সংসার সামলেছে। এই শ্রমের জন্য কোনো অর্থ পায়নি। ফলে নারীর হাতে অর্থ আসেনি। দরিদ্রের চেয়ে বড় দরিদ্র একজন নারী। পুরুষের আয়-রোজগারে নারীর জীবন চলে। নারীর শিক্ষার, উপার্জনের পথ রুদ্ধ করে রেখে সেইসব গোষ্ঠীবদ্ধ পুরুষরা গলা ছেড়েছে—আমার বউ আমার টাকায় চলে।

নারীর বিজ্ঞান শিক্ষাই ছিল অধরা। সেইখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে নানা বিপ্লব বিদ্রোহ আর চাপের মুখে ক্রমে নারী পেল শিক্ষার অধিকার, বিজ্ঞান চর্চার অধিকার, খেলাধুলা করার অধিকার, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার। অবশেষে নারীর হাতে টাকা এলো। তবু সেই টাকা আসলে পুরুষের চেয়ে কম।

পৃথিবীর বহু স্থানে নারী একই কাজ করেও পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পায়। নারীর পদোন্নতি হয় ধীরে। কর্মক্ষেত্রের বাস্তবতা আজও নারীর জন্য যুদ্ধক্ষেত্র। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও নারী বিজ্ঞানীদের গবেষণার জন্য যা অর্থ বরাদ্দ রাখা হয় তা পুরুষ বিজ্ঞানীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের চেয়ে অনেক কম।

দেশের নারী ক্রিকেটার-ফুটবলাররা পুরুষদের চেয়ে কম উপার্জন করে, যদিও সাফল্যের অঙ্কে পুরুষের চেয়ে নারীরই এগিয়ে। আজও নারীর ক্যারিয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে, কারণ যেকোনো সময় পারিবারিক চাপে তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। নারী নিরাপত্তহীনতায় ভোগে বলে কাজে যেতে পারে না। সন্তান জন্ম দিলে কর্মক্ষেত্রে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়, কিন্তু ওই সন্তানের বাবার কিছুই হয় না। তার কাজ আগের মতোই চলে।

...নারী নিরাপত্তহীনতায় ভোগে বলে কাজে যেতে পারে না। সন্তান জন্ম দিলে কর্মক্ষেত্রে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়, কিন্তু ওই সন্তানের বাবার কিছুই হয় না। তার কাজ আগের মতোই চলে।

এতকিছুর পরও আমরা কেউই সেইসব পুরুষদের বোঝাতে পারব না—নারী কেন পুরুষের টাকায় চলতে বাধ্য হয়। কিংবা নারী নিজের টাকায় চললেও কেন অন্ধ সমাজের চোখে তা ধরা পড়ে না। যখন বহু নারীর কষ্টে সঞ্চিত অর্থ আপনজন সেজে থাকা পুরুষ উধাও করে দেয়, যখন নারীর নামে ঋণ নিয়ে পুরুষ সদস্যরা নয়-ছয় করে, তখন নারীর সেই অর্থের হিসাব কষতে কেউ বসে না।

নারীর অর্থ, যা সংসার সামলে বাইরে গিয়ে উপার্জন করে, সেই অর্থের মূল্য সমাজের কাছে এখনো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ আজ কোটি কোটি মেয়ে উপার্জন করছে। মা, বাবা, ভাই, বোন, সন্তান, সংসার নারীর টাকায় চলছে। স্বামীকেও দিচ্ছে। সেই টাকার কোনো গল্প নেই। কারণ তাতে মজা করা যায় না। সত্য খুব রসকষহীন।

পুরুষের অনেক হাস্যরসের দরকার। কারণ নারীর অর্ধেক কাজ করেও প্রচুর উপার্জনের সুযোগ সমাজ পুরুষকে দিয়েছে। আর নারীর উপরে ঘরে বাইরে দ্বিগুণ বোঝা চাপিয়ে তার হাতে তুলে দিচ্ছে সামান্য অর্থ। তাই সেইসব পুরুষের বিনোদনের খোরাক জোগাতে নানা বক্তব্য বিবৃতির ছড়াছড়ি।

এইসব বিবৃতি, টিপ্পনী ছাড়িয়ে যে অজানা গল্প সবাইকে চমকে দেয়, তা হলো, গ্রামীণ নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার শহরের নারীর তুলনায় বেশি। এখন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, যোগাযোগ খাত, রিয়েল স্টেট সেবা, টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকিং, ইনস্যুরেন্স খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।

দেশের মোট পোশাক শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। পোশাক খাতের পরই প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই নারীরাই অর্থনীতি সমৃদ্ধ করছে তথা ভারি করছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। হয়তো সেইদিন খুব দূরে নয়, যখন নারীরা ফতোয়া, ধারা, টিপ্পনী ভেঙে রাজপথে প্রতিবাদে নামবে। মজা নেওয়া সেইসব গোষ্ঠীবদ্ধ পুরুষদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে।

শারমিন শামস্ ।। সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর