ছবি : সংগৃহীত

আভিধানিক দৃষ্টিকোণে উৎসব বলতে আনন্দপূর্ণ এবং জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান বোঝায়। এই বাংলাদেশে ধর্মীয়, সামাজিক, জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়। বাঙালি উৎসব প্রিয়। শ্রেণি, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে কমবেশি সবাই উৎসবে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিপুল অর্থ ব্যয় করে থাকেন। আর এই উৎসব প্রবণতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বৃহৎ অর্থনীতি। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ছোট বড় সব পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু লাভবান হোন। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

২০২৪ সালের ১২ মার্চ থেকে রমজান শুরু। সেই হিসাবে ত্রিশটা রোজা সম্পন্ন করে ১১ এপ্রিল ২০২৪ ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। এইদেশে ঈদুল ফিতর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়।

এই বছর ঈদের এর ঠিক দুইদিন পর ১৪ এপ্রিল ২০২৪ পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। এটি বাংলাদেশের প্রধান সর্বজনীন উৎসব। বিরাট দুটি উৎসব একসাথে হাত ধরে এসেছে। প্রতিবছরই বাংলাদেশে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে বর্ণাঢ্যভাবে ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়।

পুরো রমজান মাসব্যাপী কেনাকাটা করার মাধ্যমে ঈদের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। চাঁদরাতে ঈদের শপিং আরও যেন জমজমাট হয়ে ওঠে। ঈদের দিনে নতুন জামাকাপড় পরা, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, উপহার এবং সালামি আদান-প্রদান, সেমাইসহ বিশেষ বিশেষ খাবার তৈরি করা, এইসব রীতি বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই পরিলক্ষিত হয়।

পোশাক, উপহার, খাবার, সাজসজ্জার মতো আইটেমগুলোয় ভোক্তার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। ঈদকে সামনে রেখে জামাকাপড়, গয়না, জুতা, প্রসাধনী ও ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটের বাজারে হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হয়।

ব্যবসায়ীদের মতে, পোশাকশিল্পের বার্ষিক বিক্রির প্রায় ২০ শতাংশই হয় পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। অন্যদিকে দুই ঈদে মিলে হয় মোট বিক্রির প্রায় ৬০ শতাংশ। পূজার সময় আরও ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বিক্রি বাড়ে। আর হালখাতা অনুষ্ঠানের জন্য যে পরিমাণ মিষ্টির ব্যবসা হয় তাও সারা বছরের বিক্রির চার ভাগের এক ভাগ।

বাঙালি উৎসব প্রিয়। শ্রেণি, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে কমবেশি সবাই উৎসবে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিপুল অর্থ ব্যয় করে থাকেন। আর এই উৎসব প্রবণতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বৃহৎ অর্থনীতি।

প্রতিবারের মতো এবারও রমজানের শুরু থেকেই ঈদকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের মানুষ মেতে উঠেছে যথাসাধ্য কেনাকাটায়—যা রাজধানীর মার্কেট, শপিংসেন্টার ও ফ্যাশন হাউসগুলো থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রসারিত।

শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় চলছে কেনাবেচার মহোৎসব। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার কারণে আলো ঝলমল শপিংমল থেকে শুরু করে ফুটপাতে বাহারি পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। সব জায়গায় রয়েছে ক্রেতা সমাগম। এইবার অবশ্য ঈদ বোনাস এবং বৈশাখীভাতা কাছাকাছি সময়ের মধ্যে পেয়েছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। অর্থনীতিতে অর্থের গতি বেশি হওয়ারই কথা।

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে বরণ করার লক্ষ্যেও চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। রমনার বটমূলে চলছে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন।

ক্রেতারা তাদের পোশাকে ঈদের সঙ্গে বৈশাখের রঙ ও নকশার ছোঁয়াও চাইছে। মৃৎশিল্পের চাহিদাও এখন বিপুল। মার্কেটগুলোর পাশাপাশি অনলাইন বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ই-কমার্স বাজারে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।

দর্জির দোকান, সেলুন ও বিউটি পার্লারগুলোয়ও ভিড় বেড়েছে। খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক ক্রেতাকে আকর্ষিত করতে দিচ্ছে বিশেষ ছাড়। ব্যাংকগুলোর ক্রেডিট কার্ডেও চলছে আকর্ষণীয় অফার। এভাবেই উৎসব দুটি ঢেউ তুলেছে বাংলার অর্থনীতিতে।

দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার কারণে আলো ঝলমল শপিংমল থেকে শুরু করে ফুটপাতে বাহারি পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। সব জায়গায় রয়েছে ক্রেতা সমাগম।

প্রতি বছরই ঈদ উৎসবকে ঘিরে দেশের অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ে। ঈদ উৎসব সামনে রেখে বরাবরই প্রবাসীদের বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ বাড়ে। কারণ এই সময়টাতে প্রবাসীরা দেশে স্বজনদের জন্য বাড়তি অর্থ পাঠানোর চেষ্টা করেন যা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

ঈদ উদযাপনে শহরের অধিকাংশ মানুষ বাড়ি যায়। এই সময় পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহনের উপর অতিমাত্রায় চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে পরিবহন খাতও হয় সমৃদ্ধ। গ্রামীণ অর্থনীতিও হয় গতিশীল। এই বছর ঈদের ছুটির সাথে পহেলা বৈশাখের ছুটিও যুক্ত হওয়ায় আশা করা যাচ্ছে ঈদকে কেন্দ্র করে বিনোদনের জন্য পর্যটন খাতেও যুক্ত হবে বাড়তি টাকার প্রবাহ।

ঈদ উপলক্ষে ব্যাংকিং খাতে এবং মোবাইল ব্যাংকিং খাতে লেনদেন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। লেনদেনের এই উচ্চহার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় তারল্যের ঘাটতি সৃষ্টি করে। এই বছর মানুষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ৩১ মার্চ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে অতিরিক্ত নতুন নোট ছেড়েছে।

উৎসবের দিনে বাসায় বিশেষ খাবারের আয়োজন করা বাঙালির দীর্ঘদিনের প্রথা। খাবারের আয়োজন বাহারি ও বৈচিত্র্যময় করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে। রমজান মাসের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। বিশেষ করে ভোজ্য তেল, ছোলা, মাংস, চিনি, মসলা, সুগন্ধি চাল, সেমাই এবং পেঁয়াজের চাহিদা অধিকাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ বৃদ্ধি পায় আমদানি। ব্যবসায়ীরা নিজস্ব টাকার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এসব পণ্য আমদানিতে করেন।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, রমজানে সারা দেশে ইফতারকেন্দ্রিক কয়েক লাখ মানুষ মৌসুমি ব্যবসা করে। যদিও সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি দ্রব্যমূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। পোশাক ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্য স্বল্প ও স্থির আয়ের মানুষের জন্য উৎসব উদযাপন কঠিন করে তোলে।

ঈদ উৎসবে সম্পদের ভারসাম্য রক্ষায় ফিতরা ও জাকাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণা বলছে, দেশে ৮৬ হাজার কোটি টাকা জাকাত আদায় সম্ভব। ফিতরা ও জাকাত সম্পদের প্রবাহ তৈরি করে, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দারিদ্র্য বিমোচনে  সাহায্য করে।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎসব এখন পুরোদস্তুর পণ্য, এটা আমরা স্বীকার করি বা নাই করি। উৎসব উপলক্ষে হাজার হাজার টাকা হাত বদল হয়ে মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টের মাধ্যমে অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রতিদিনই চাঙা হয়ে উঠছে বাজার। দুই উৎসবে দারুণ মেতেছে বাঙালি। এই আনন্দ উদযাপন অমলিন থাকুক। আরও বর্ণিল ও আনন্দময় হোক আমাদের সব উৎসব।

দীপিকা মজুমদার ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়