ছবি : সংগৃহীত

প্রতিবছর বাংলাদেশে ঈদ এবং পশ্চিমবঙ্গে পূজাকে কেন্দ্র করে বিশেষ সাহিত্য সংখ্যা বের হয়। এইসব সংখ্যায় গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গদ্য, চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, রান্না, সাক্ষাৎকারসহ একাধিক বিষয়ে বিভিন্ন লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়। ২০২৪ সালেও বাংলাদেশে ত্রিশের অধিক ঈদ সংখ্যা বেরিয়েছে। এইসব ঈদ সংখ্যার সাহিত্যমান, লেখকদের পেশাদারি মনোভাব, সম্পাদনা এবং সাহিত্যের প্রভাবও আলোচনার দাবি রাখে।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে খুব কম লেখকই ‘পূর্ণ সময় লেখক’ হিসেবে জীবিকা সংস্থান করতে পারেন। এখন আপনার কর্মক্ষেত্র যদি খুব ভালো-উদার-সদাশয়-পরিচ্ছন্নও হয়, তারপরও আপনি যদি ‘কর্মনীতি’ অনুসরণ করতে চান, তবে আট ঘণ্টা সময় কর্মক্ষেত্রে দিনে চলে যায়। শিল্প-সাহিত্যের জগতে একেই বলে ‘ব্রেড ভার্সাস রোজেস’ বা ‘রুটি ও গোলাপের দ্বন্দ্ব।’ জীবিকা অর্জনে কাজ তো করতেই হয়। কিন্তু যার টাকা আয়ের পাশাপাশি দু’লাইন লিখতে, গাইতে, ছবি আঁকতে বা সুর সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করে? তার কী হবে?

তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মৃত্যুর আগে বলতে হয় যে, লেখার আগে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করে নেওয়া ভালো। পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহের শেষকৃত্যের জন্য নিষ্ঠুর প্রকাশক-মিউজিক ডিরেক্টরদের জন্য গান লিখে তবে কিছু টাকা পেয়ে সেই টাকায় নজরুলকে ছেলের শবদেহ সমাধিস্থ করতে হয় এবং এমনকি ‘জমিদার’ রবীন্দ্রনাথকেও শান্তি নিকেতন স্থাপনে সব ব্যক্তিগত বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ও স্বোপার্জিত যাবতীয় টাকা-পয়সা খরচ করে শেষ অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল তার হাতের তিনটি আংটি বিক্রি করে। কাজেই পূর্ণ সময় লেখা বা শিল্পের জীবন অনেকেই নিতে পারেন না। আর তখনি হয় কাজ বনাম শিল্পের দ্বন্দ্ব।

আজকের পৃথিবীতে পূর্ণ সময় শিল্পী বা লেখকের জীবন অনেকেই নিতে পারেননি। এখন আট ঘণ্টা কাজের পর যাতায়াতে ধরুন গেল আরও দুই ঘণ্টা। এমন এক রুটিনের পর প্রতি ফেব্রুয়ারির বইমেলা শেষ না হতেই গদ্য লেখক নামের হতভাগা জীবদের উপর কি অমানুষিক চাপ শুরু হয় তা সহজেই অনুমেয়।

এই যে ‘নির্মমতম ঋতু’ এপ্রিল চলছে, সেই নির্মমতম মাসের কথা লিখে যে কবি জগদ্বিখ্যাত হয়েছিলেন সেই টি.এস.এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ সম্পাদনায় এজরা পাউন্ড মূল কবিতার প্রায় পঞ্চাশ ভাগ ছেঁটে ফেলেছেন।

কবিতার তৃতীয় অধ্যায় থেকে জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ থেকে গৃহীত উদ্ধৃতি, আলেক্সান্ডার পোপের অনুকরণে দীর্ঘ কবিতাংশ এবং একটি জাহাজ বিনাশ প্রসঙ্গে দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি বাদ দিয়ে কবিতাটি আরও অনেক ঝরঝরে ও মনোজ্ঞ করে তোলেন যার জন্য পরে টি.এস.এলিয়টই সবিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

....মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মৃত্যুর আগে বলতে হয় যে, লেখার আগে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করে নেওয়া ভালো। এমনকি ‘জমিদার’ রবীন্দ্রনাথকেও শান্তি নিকেতন স্থাপনে সব ব্যক্তিগত বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ও স্বোপার্জিত যাবতীয় টাকা-পয়সা খরচ করে শেষ অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল তার হাতের তিনটি আংটি বিক্রি করে। কাজেই পূর্ণ সময় লেখা বা শিল্পের জীবন অনেকেই নিতে পারেন না।

এই মাপের সম্পাদনা আমাদের এখানে কেন, আজও বাংলা সাহিত্যের (যত বিতর্ক থাকুক) মূল কেন্দ্র বা একদা অখণ্ড বঙ্গভূমির বর্তমান পশ্চিমাংশেও হয়তো নেই। সম্পাদনা তো নেইই, আমার লেখালিখি জীবনের শুরুতে প্রিন্ট বা মুদ্রিত পত্রিকাগুলোয় খানিকটা যদি সম্পাদনার আভাস পেতাম, সবিশেষ শ্রদ্ধা নিয়েই বলি যে হালের অসংখ্য অন্তর্জালে সম্পাদনার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না।

পেশাগত ব্যস্ততা বা জীবনের নানা সমস্যার ভেতর, ডেটলাইনের তাড়ায় আমরা একটি লেখা পাঠালে তাতে একটি বানান ভুল বা আচমকা একটি শব্দ দু’বার লিখে ফেললে তা কিন্তু পত্রিকার প্রুফ রিডিং থেকে সম্পাদনা বিভাগেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। যেমন গত বছর একটি অনলাইন দৈনিকের ঈদ সংখ্যায় এক কথাশিল্পী ‘নিশীথ’ বানানটি ‘নীশিথ’ লিখেছিলেন এবং তা সেই অনলাইন দৈনিক উপন্যাসের শিরোনাম হিসেবে ছাপিয়েছিল। আমি মনে মনে শুধু ভেবেছিলাম যে, ঐ লেখক কি জীবনে ‘নিশীথে কি কথা কয়ে গেলে’ গানটি দেবব্রতের গলায় শুনে তা ‘গীতবিতান’-এ মিলিয়ে পড়েননি?

তখন আমি কারও নামোল্লেখ না করে ফেসবুক পোস্ট লিখি। সতীর্থ কিছু লেখক আমাকে ‘ঈর্ষাকাতর, পরশ্রীকাতর, বিদ্বিষ্ট, নিন্দুক’ বলে বিচার সভা বসিয়েছিল। আর এইটাই আমাদের আত্মহনন প্রক্রিয়া।

আচ্ছা, বানান ভুল বা একটি শব্দ দু’বার লেখা তো বড় ভুল অবশ্যই। এবার আসা যাক বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং ঈদ সংখ্যার তথাকথিত তাড়া প্রসঙ্গে। এবারই যেমন দেশের খুব বড় একটি পত্রিকা থেকে একটি উপন্যাস লিখতে বলা হয়। শুরুতে একটি রাজনৈতিক উপন্যাস লেখার কথা মাথায় থাকলেও আমাদের দেশে যেহেতু ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে তেমন কিছু লেখা যায় না আর নারী লেখক হিসেবে যৌনতা আমি নিজেই এড়িয়ে যাই, কাজেই একটি ব্যক্তিগত বা অল্প বয়সের এক কঠিন সংগ্রামের সময় নিয়েই উপন্যাস লিখব ভেবেছিলাম।

পরে যে পত্রিকায় ঐ উপন্যাসটিরই খণ্ডাংশ দিই, তাও ব্যস্ততার কারণে, বইমেলার পরের ক্লান্তি ও অবসাদের কারণে আমি নিজেই বুঝি যে আমার মূল পরিকল্পনা থেকে এত দূরবর্তী হয়েছে যে তা বলার নয়। এবং আরও অবাক করার বিষয় হলো যে, ঈদের এই সময় কেউ কেউ তিন বা চারটি উপন্যাসও লেখেন। কীভাবে সম্ভব?

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাটি আমরা কেউ স্মরণে রাখছি না যে, ‘যশের জন্য লিখিও না। ভাল লিখিলে যশ আপনি আসিবে।’ অথবা ‘লিখিয়াই ছাপিতে দেবেনা।’ কিন্তু আমরা ‘লিখিয়াই ছাপিতে দিচ্ছি’।

পূর্ণ সময় লেখক হলে অন্য কথা। সেইক্ষেত্রেও সাংসারিক বা পারিবারিক ব্যস্ততা থাকে। আমাকে আরও তিনটি গল্প লিখতে হলো যার ভেতর দুটো গল্প আমার পছন্দ আর দুটো গল্প ক্রমাগত মানুষের মুখে আমি কেন চারপাশের নাগরিক জীবন ও তাদের ক্লেদজ কুসুম নিয়ে লিখি না শুনতে শুনতে হাল্কা চালে দু’টো ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর গল্পও লিখেছি। তাতেই আমি নিজেও বুঝেছি যে আমার গদ্যের ভাষা থেকে নানা কিছুরই মান পড়ে গেছে।

তারপরও আমি কিন্তু প্রতিটি গল্পে একটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। অনেক সময় না পারলে ‘না’ করে দিই বা সব অনুরোধ রাখতে পারি না। কখনো কখনো দেখবেন কোনো কোনো লেখক বছরের পর বছর প্রেম-পরকীয়া-যৌনতা নিয়ে একই ‘থোড় বড়ি খাড়া’ আর ‘খাড়া বড়ি থোড়’ নামে উপন্যাস বা গল্প লিখে ফেলেছেন।

এখন এই যে প্রতি সপ্তাহের পাঁচ পঙ্‌ক্তির কবিতা, বারোশ শব্দের গল্প আর ঈদের সময় মোটা মোটা ঢাউস পত্রিকা—অনেক লেখক ঈদের সময়ের উপন্যাস ফেব্রুয়ারি আসতে না আসতে বই করে ফেলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাটি আমরা কেউ স্মরণে রাখছি না যে, ‘যশের জন্য লিখিও না। ভাল লিখিলে যশ আপনি আসিবে।’ অথবা ‘লিখিয়াই ছাপিতে দেবেনা।’ কিন্তু আমরা ‘লিখিয়াই ছাপিতে দিচ্ছি’।

তবে অনেকেই যেমন ঈদ সংখ্যায় লেখার বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার, সবাই নীতিগত জায়গা থেকে সোচ্চার তাও নয়। অনেকে নিজেরা লেখার পরিসর না পেয়েও সোচ্চার। ফিওদোর দস্তয়েভ্‌স্কি ২৭ দিনে ‘দ্য পজেসড’ লিখেছিলেন—এটাও সত্য। তবে মূল নৈতিক দায় আমাদের বা লেখকদের। তাড়াহুড়োয় অসম্পাদিত লেখা পাঠালাম কিনা? অথবা একই বিষয়ের গল্প বা উপন্যাস আমি কতদিন ‘খাওয়াব?’

এতকিছুর পরেও পাঠক খুঁজে নেন তার পছন্দের ঈদ সংখ্যা, খুঁজে নেন পছন্দের লেখকদের।

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক