ছবি : সংগৃহীত

১৯৬৫ সালের পর ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ঢাকায়, ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এইবার, ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল যশোরে ৪২.৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এইবারই কি শেষ? না।

সূর্যের জ্বলন্ত রশ্মিতে ঝরছে আগুন। নিজের সর্বোচ্চ শক্তিমত্তা দিয়ে জানান দিচ্ছে সূর্য। শহর-গ্রাম, পথ-ঘাট, সড়ক-মহাসড়ক সবখানেই সূর্যের খরতাপ! পিচঢালা পথ যেন জ্বলন্ত উনুন! জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত!

কয়েকদিন ধরে দেশজুড়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে তেঁতে উঠেছে প্রাণীকুলও। বাতাসেও আগুনের ছটা। মৌসুমের প্রথম তাপপ্রবাহই চলতি মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। টানা কয়েকদিন ধরেই তাপমাত্রার পারদ চড়া হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। এরপর যশোর। দিন যত যাচ্ছে ততই একের পর শহরে তাপমাত্রা রেকর্ড ভাঙছে।

প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ছেন। দেখা দিচ্ছে নানাবিধ রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা। বাড়ছে হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যাও।

তীব্র গরমে জনজীবন হয়ে পড়ছে বিপর্যস্ত। প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের হচ্ছেন না ঘর থেকে। অনেকেই বের হচ্ছেন ছাতা নিয়ে। গরমে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন কর্মজীবীরা। বিশেষ করে শ্রমজীবী, ট্রাফিক পুলিশ, চালকরা পড়েছেন বিপাকে। ২২ এপ্রিল ২০২৪ আবারও ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে মৃদু দাবদাহ বলে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে ধরা হয় ভয়াবহ দাবদাহ চলছে। ঢাকা, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে ভয়াবহ দাবদাহ চলতেছে।

প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়ছেন। দেখা দিচ্ছে নানাবিধ রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য সমস্যা। বাড়ছে হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যাও।

ঢাকাসহ সারাদেশেই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের বড় অভাব। কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেইখানে নগর পরিকল্পনার সময় উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়। সুতরাং মানুষকে বাঁচতে হলে তার আদিম জীবনের প্রতিবেশী গাছ-তরুলতাকেও বাঁচাতে হবে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে তাই বিজ্ঞানীরা বারবার বলছেন, পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচতে হলে গাছ-তরুরাজির শ্যামল ছায়ায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে, তাই বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি।

দেশের ইতিহাসে এত বৃহৎ এলাকা জুড়ে তাপমাত্রার রেকর্ড নেই! দেশে চলমান তাপমাত্রা সৌদির চেয়েও ৫ ডিগ্রি বেশি। তীব্র  তাপপ্রবাহের মধ্যে ঝিনাইদহের শত শত নলকূপে উঠছে না পানি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মে মাসের তাপমাত্রা হবে আরও ভয়ংকর, সর্বোচ্চ হতে পারে ৪৪ ডিগ্রি। বর্তমানে তাপপ্রবাহ বইছে ৫১ জেলায়।

দেশজুড়ে বৈধ-অবৈধ অপরিকল্পিত ইটের ভাটা, শহর ও নগর অঞ্চলে মিল কারখানা, শপিংমল, দোকান-মার্কেট, হোটেল-মোটেল, বাসা-বাড়ি, সর্বক্ষেত্রে এসির ব্যবহার প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গিয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরিকল্পিত বৈধ-অবৈধ ব্যাটারি সিএনজি, ডিজেল-পেট্রোল চালিত গাড়ি, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন। প্রত্যেক যানবাহনের নিজস্ব তাপ আছে। এইসব তাপও প্রকৃতি ধারণ করছে।

দৈনন্দিন জীবনে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার বেড়েছে। এইসব ডিভাইসের তাপও বাইরের তাপে প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে বেড়েছে এসির সর্বোচ্চ ব্যবহার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্যমতে, ২০২১ সালে এসি ব্যবহার করতো এক দশমিক ৬০ শতাংশ পরিবার। ২০২২ সালের তা বেড়ে দাঁড়ায় এক দশমিক ৭৪ শতাংশে।

ঢাকাসহ সারাদেশেই আজ শ্যামল সবুজ উন্মুক্ত প্রান্তরের বড় অভাব। কিন্তু বিদেশে এমনটি হয় না। সেইখানে নগর পরিকল্পনার সময় উদ্যান ও প্রান্তরের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়।

বিবিএস আরও বলছে, বর্তমানে স্মার্টফোন রয়েছে ৭৪ দশমিক ৫০ শতাংশ পরিবারে। এছাড়া বাটন ফোন আছে ৮৬ দশমিক ৫০ শতাংশ পরিবারে। ল্যাপটপ, ডেক্সটপ কম্পিউটার রয়েছে ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ পরিবারে। ৪৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ পরিবারে রয়েছে টেলিভিশন। ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, রেফ্রিজারেটর রয়েছে ৫৩ দশমিক ৪০ শতাংশ পরিবারে। মোটরবাইক ও স্কুটি রয়েছে ১১ দশমিক ১১ শতাংশ পরিবারে।

এত এত ডিভাইস থেকে যে তাপ উৎপন্ন হয় তাও কিন্তু পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে। ফলে প্রতিনিয়ত উষ্ণতা বাড়ছে। তারমধ্যে দেশজুড়ে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, জলাশয় যাচ্ছে কমে। কোথাও আবার প্রবাহের অভাবে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, জলাশয় থাকলে যে তাপপ্রবাহ কমে সহজ এই বিষয়টাই আমাদের যেন অজানা। তাই আমরা এইসব ভরাট করছি প্রতিনিয়ত।

এখন সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাছ লাগানো বা বৃক্ষরোপণের কথা বলছেন। প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে পরিকল্পিত উপায়ে বৃক্ষরোপণ হচ্ছে কি? পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেছিলেন, জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী এক কোটি গাছ লাগানো হবে। সেইসব গাছ যদি রোপণ করা হতো তবে কি এত উষ্ণতা বাড়তো?

শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণ করেই এই সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন অসম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটগুলো ফসলের উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্বকেও এখন হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে কৃষিতে নির্বিচারে রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগ।

এই অযাচিত কীটনাশক ফসলের মাটিতে মিশে মাটির কার্বন নিঃস্ফোরণকে বাড়িয়ে তুলছে; যার কারণে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। সবকিছু বিবেচনায় বলা যায়, এই দাবদাহ এখানেই শেষ নয়। এর ফল আরও ভয়াবহ হবে যদি এখনই সঠিক পরিকল্পনা করে কর্মসূচি না নেওয়া হয়।

সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
srb_ccdbseed@yahoo.com