ব্যক্তিজীবনের কিছু ঘটনা দিয়েই শুরু করতে চাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে দিনের অধিকাংশ সময়ই ক্যাম্পাসে কাটাতে হয়। নিজের আবাসস্থল ক্যাম্পাস সংলগ্ন হওয়ায় বিভাগে যাওয়ার জন্য ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ব্যবহার করি অধিকাংশ সময়।

নিজের গাড়িটি সন্তানদের স্কুল/কোচিংয়ে আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রেই বেশি ব্যবহার হয়। কিন্তু ইদানীং আমার স্ত্রী প্রায়ই অনুযোগ করেন যে, ক্যাম্পাসের প্রবেশ পথে তাকে নাকি প্রায়শই কর্তব্যরত প্রহরী ও পুলিশ সদস্যের জেরার সম্মুখীন হতে হয়। ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক’ নামক স্টিকার না থাকাতে এসব বিড়ম্বনা। স্টিকার লাগানোর বিষয়টি তাকে কর্তব্যরত প্রহরী ও পুলিশ সদস্যরাই বলেছেন।

গাড়িতে স্টিকার ব্যবহার করলে আমার স্ত্রীকে হয়তো তার ভাষায় ‘অনভিপ্রেত জেরার’ মুখোমুখি হতে হবে না। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়ের স্টিকার লাগিয়ে নিজেকে জাহির করার বিষয়টিকে কেন জানি আমি মেনে নিতে পারি না।

বিভিন্ন পেশার মানুষের ব্যবহৃত গাড়িতে যেভাবে স্টিকার লাগানো দেখি—ডাক্তার, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ সরকারি-বেসরকারি প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের, তাতে মাঝে মাঝে বেশ বিব্রত হই। কেন জানি মনে হয়, সকল ক্ষেত্রে কি এগুলোর প্রয়োজন রয়েছে?

কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শ্রম-ঘামের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রীয় সম্পদ তথা জিডিপির সুফল নিয়ে আমরা যারা সমাজে নিজেদের তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করি, তারা ওইসব মেহনতি মানুষের প্রতি অবিচার করছি না তো? হয়তো এটাই সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মূল্যবোধই হয়তো আমরা ধারণ করছি।
২০০৬ সাল। সম্ভবত জুন মাস। আমি তখন নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় সপ্তাহের একটি কোর্সে অংশগ্রহণ করছি। দীর্ঘদিন ধরে অসলো শহরে বাস করছেন এমন একজন বাঙালি ভদ্রলোক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সে দেশের রাজপরিবার সম্পর্কে একটি গল্প শোনালেন।

রাজপরিবারের কোনো একজন সদস্য নাকি রেলস্টেশনে টিকিট কাটার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। টিকিট ক্রেতাদের কেউ তাকে চিনতে পেরে সামনে গিয়ে টিকিট সংগ্রহের অনুরোধ করলেও তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।

কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শ্রম-ঘামের বিনিময়ে অর্জিত রাষ্ট্রীয় সম্পদ তথা জিডিপির সুফল নিয়ে আমরা যারা সমাজে নিজেদের তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করি, তারা ওইসব মেহনতি মানুষের প্রতি অবিচার করছি না তো? হয়তো এটাই সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মূল্যবোধই হয়তো আমরা ধারণ করছি।

আবার ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের একটি স্যান্ডউইচ শপে স্যান্ডউইচ কেনার গল্প শুনেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি নাকি অনেক সকালে গাড়ি করে সরকারি কাজে যাওয়ার পথে নাস্তা কিনতে স্যান্ডউইচ শপে গিয়েছিলেন।

ইংল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে দেখে ক্রেতাদের অনেকেই তাকে সামনে যাওয়ার অনুরোধ করলেও বিক্রেতা বয়স্ক নারী কিন্তু তাতে বাদ সাধলেন। পরিচয় জানার পরে বিক্রেতা কিছুটা লজ্জিত হলেও ক্যামেরন কিন্তু তাকে বাহবা দিয়েছিলেন। এটাই তো সৌজন্যবোধ, শিষ্টাচার, সভ্য মানুষদের আচরণ। তাই নয় কি?

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমি হঠাৎ করে কেন ব্যক্তিগত ঘটনার অবতারণা করলাম? গত ১৮ এপ্রিল ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে একজন চিকিৎসক, পুলিশ সদস্য এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বাগবিতণ্ডার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ইতোমধ্যেই সবার নজরে এসেছে। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তুলেছে। ঘটনাটি লকডাউন চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাইদা শওকত জেনির গাড়ি আটকে পরিচয় জানতে চাওয়াকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) কর্তৃক মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর লিখিত চিঠিতে ঘটনাটিকে চিকিৎসকদের হেনস্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিএমএ তাদের চিঠিতে অভিযোগ করে বলেছে যে, নিজ গাড়িতে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের স্টিকার লাগানো এবং নিজের নামাঙ্কিত চিকিৎসকের গাউন পরিহিত অবস্থায় নিজের পরিচয় দেওয়ার পরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্যরত সদস্যরা চিকিৎসককে হেনস্তা করেছেন। এ ঘটনার সাথে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনার দাবি করেছে বিএমএ।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন তাদের প্রতিবাদ লিপিতে জনৈক চিকিৎসক কর্তৃক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের প্রতি অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং উক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ মো. মামুনুর রশীদকে বরিশালে বদলি করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি দেখে আমি কিন্তু বিব্রতই হয়েছি। ক্ষমতার দম্ভ মানুষকে কতটা অন্ধ করতে পারে তা ভিডিওটি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্যরত সদস্যদের সাথে চিকিৎসকের বাগযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত পরিবার এমনকি মন্ত্রী মহোদয়ের ফোন পর্যন্ত গড়িয়েছে।

করোনা মহামারিতে কোন পেশার অবদান কতটুকু সে বিষয়টিও এখানে উত্থাপিত হয়েছে। কে বড়? ডাক্তার, নাকি পুলিশ, নাকি ম্যাজিস্ট্রেট সেটাও বলা হয়েছে। কার বাবা মুক্তিযোদ্ধা সেটা দিয়েও নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভিডিওটি দেখে মনে হচ্ছিল, গ্রামের অল্প শিক্ষিত কিছু মানুষ প্রায় বিনা কারণে ঝগড়া করছেন। কেউ কাউকে না হারানো পর্যন্ত থামছে না।

মহামারিকালে কোনো মানুষের অবদানকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে মানুষকে বাঁচানোর জন্য জীবন দিয়ে যুদ্ধ করছেন তা যেমন অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই, ঠিক একইভাবে জীবন বাজি রেখে সার্বিক পরিস্থিতি কার্যকর করাসহ পুলিশ ও প্রশাসনের সদস্যরা যেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছেন তাদের অবদানকেও অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

২০২০ সালের শুরু থেকেই আমরা এমনকি গোটা বিশ্ব নতুন মহামারির সাথে যুদ্ধ করছি। সমাজের প্রায় প্রতিটি মানুষকে প্রতিনিয়ত এই মহামারির সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কেউ পরিবারের সদস্যদের জন্য দু’মুঠো অন্ন জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন, কেউ আবার সম্মুখসমরে থেকে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কেউ আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।

এই মহামারিকালে কোনো মানুষের অবদানকেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যেভাবে মানুষকে বাঁচানোর জন্য জীবন দিয়ে যুদ্ধ করছেন তা যেমন অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই, ঠিক একইভাবে জীবন বাজি রেখে সার্বিক পরিস্থিতি কার্যকর করাসহ পুলিশ ও প্রশাসনের সদস্যরা যেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছেন তাদের অবদানকেও অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, করোনা মহামারিতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রায় শ’খানেক পুলিশ সদস্য জীবন দিয়েছেন, প্রায় ২০ হাজারেরও অধিক পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। একইভাবে, গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রায় দেড়শ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। একইভাবে প্রশাসনেরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, করোনা মোকাবিলায় ডাক্তার-পুলিশ-প্রশাসন কারো ভূমিকাই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অবস্থা ও প্রকৃতিভেদে একেকজন তাদের নিজেদের জায়গা থেকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। দেশে যখন প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যায় রেকর্ড হচ্ছে, ঠিক সে সময় কে বড় এইসব তর্ক করে নিজেদের মধ্যে শুধু হিংসারই জন্ম দিতে পারে। সামষ্টিক কিংবা বৃহত্তর কোনো কল্যাণ এতে নেই। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে একটা পেশার সবাইকে মাপার সুযোগ নেই।

আসলে সময়টা দাম্ভিকতার নয়, বাগবিতণ্ডার নয়। সময়টা ঐক্যের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মহামারি রুখতে যেভাবে দিনরাত কাজ করছেন, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। গত ১৮ এপ্রিলের ঘটনায় কিন্তু কাউকেই সহনশীল মনে হয়নি। এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত মানুষজন সবাই সমাজের তথাকথিত উঁচু স্তরের। তাদের কাছ থেকে আমরা অন্তত সৌজন্যমূলক আচরণ প্রত্যাশা করি।
ডেল কার্নেগির ভাষায় বলতে হয়, ‘যে নদী যতো গভীর তার বয়ে চলার শব্দ ততো কম’। নিজেকে যদি সত্যিই শিক্ষিত মনে করি তবে সময়টা সহনশীলতার, দাম্ভিকতা প্রদর্শনের নয়।

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়