২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে নানা খাতের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ার প্রত্যাশা ছিল সবার। সূচনায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যে জরুরি ও অপ্রত্যাশিত আর্থিক প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা মেটাতে, আর অর্থনীতির নানা দিকে ক্ষয়ক্ষতি পূরণে তা পুনরুদ্ধারের কৌশল হিসেবে মূলত বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।

সরকার নতুন বাজেটের আকার ৬ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ধরে এগোচ্ছে, যা শেষ মুহূর্তে কিছু বাড়তে-কমতে পারে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।

আমাদের দেশে যেসব রোগ হয় এবং উদ্ভূত রোগের দিকে খেয়াল রেখে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি আর দক্ষ জনশক্তি যা দরকার সেসব ভেবে করা হয়েছে বলে মনে হয় না। ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে, গত অর্থবছরে এ বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ কোটি টাকা। এবার তা ২০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী যারা করোনা মোকাবিলায় কাজ করছেন তাদের জন্য ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাংলাদেশে করোনা মহামারির কারণে স্পষ্ট হয়েছে এতদিন স্বাস্থ্য খাতে কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্বাস্থ্য খাতের নানা ক্ষেত্রে যে সংস্কার জরুরি তা প্রমাণিত হয়েছে।

সংক্রমণ মোকাবিলায় সুরক্ষা সামগ্রী পিপিই, গ্লাভস, মাস্কের দাম এবং নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র পরিচালনার যন্ত্রপাতির দাম কমার আশা ছিল। সার্বিকভাবে মনে হয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত ছিল স্বাস্থ্য সুরক্ষা আর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। স্বাস্থ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামাজিক খাতেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল। অসংখ্য মানুষ দরিদ্র হচ্ছে, দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হবে তাদের স্বাস্থ্য রক্ষা আর জীবন রক্ষার সামাজিক নিরাপত্তা বলয় প্রয়োজন ছিল।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গুরুত্ব পেয়েছে মনে হয়নি। দরিদ্র মানুষের জন্য স্বাস্থ্য বিমা চালু করা দরকার ছিল। এতে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের দায়বদ্ধতা আরও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হতো। এদেশে এখনো টাকা দিলে ভালো স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে।

এস্কেপ এর ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, জিডিপি’র বিচারে এশীয় আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ আছে। ১৭ কোটি মানুষের জন্য যে পরিমাণ স্বাস্থ্য বরাদ্দ, এতে মাথা পিছু যা পড়ে তাতে তা সংকুলান হয় না। আমাদের দেশের মানুষ এজন্য নিজের পকেট থেকে ৬৬ শতাংশ খরচ করে স্বাস্থ্যের ব্যয় মেটাতে, ফলে বাড়ে দারিদ্র্য আর বৈষম্য। মানুষ বঞ্চিত হয় স্বাস্থ্য সেবা থেকে, এতে আসে রুগ্নতা আর অকাল মৃত্যু।

তাই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ দেওয়া জরুরি ছিল। এই বাজেটে রোগ প্রতিরোধ, রোগ চিকিৎসা, আর দেশবাসীর ভালো থাকার খাতে অর্থ বরাদ্দ আরও শক্তিশালী করা উচিত আর এসব কারণেই প্রস্তাবিত বাজেটের অর্থ বরাদ্দ অন্তত দ্বিগুণ করা উচিত।

রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। আমরা মেডিকেল কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নকে মাথায় রেখে কাজ করেছি কেবল চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর যেনতেন প্রচেষ্টা যত করেছি তত মনোযোগ দেয়নি গুণগত মানের দিকে।

আমরা স্বাস্থ্য অবকাঠামো, দালান নির্মাণ আর ক্রয়ে বড় খরচ করি। আর হলো প্রশিক্ষণ, বেতন ভাতাতে আমাদের খরচ বেশি। আমাদের যেমন আছে সক্ষমতার অভাব তেমনি আছে দুর্বৃত্তায়ন। আছে অপচয়, দুর্নীতি।

গবেষণায় এবার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো কিন্তু এতে কাঙ্ক্ষিত সফলতা হয়নি। এটি সত্য যে, গবেষণায় আমাদের মান এবং পরিমাণ বা গুণগত অবস্থান খুব নিচু। এর পেছনে যেমন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বড় কারণ তেমনি চিকিৎসকদের মধ্যে গবেষণায় অনীহা একটি কারণ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে এর গুরুত্ব অনুধাবন করেন বলে এর বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু ফলপ্রসূ কিছু হলো না। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার তিনটি দিক স্বাস্থ্য সেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা আর গবেষণা। চিকিৎসা ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা আর নতুন উদ্ভাবনী শক্তির সক্ষমতা বিচারে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে আসতে পারেনি।
যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি সেসব বিষয়ে গবেষণা, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণা উল্লেখযোগ্য। সংক্রামক ব্যাধি আর ভাইরাস রোগ নিয়ে গবেষণা; অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ক্যান্সার, মানসিক রোগ, অটিজম, ট্রমা আর ইনজুরি। মেডিকেল এডুকেশন আর এপিডেমিওলজি বিষয়ে গবেষণা; প্রয়োজন মৌলিক কিছু বিষয়ে গবেষণা আর উন্নত ল্যাব স্থাপনা। যেমন ভাইরোলজি, মলিকুলার বায়োলজি, ক্লিনিক্যাল বায়োকেমিস্ট্রি আর ইমুনোলজি আর জেনেটিক ল্যাব।

আমাদের বিনিয়োগ করা উচিত ভ্যাকসিন উৎপাদনে, এতে দেশ যেমন ভ্যাকসিন উৎপাদনে স্ব-নির্ভর হবে তেমনি বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি হওয়া উচিত গবেষণার বিষয়। এজন্য অধিক বরাদ্দ প্রয়োজন হবে, আমরা পরিকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ স্বাস্থ্য জনশক্তি তৈরি এদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত।
আমরা স্বাস্থ্য অবকাঠামো, দালান নির্মাণ আর ক্রয়ে বড় খরচ করি। আর হলো প্রশিক্ষণ, বেতন ভাতাতে আমাদের খরচ বেশি। আমাদের যেমন আছে সক্ষমতার অভাব তেমনি আছে দুর্বৃত্তায়ন। আছে অপচয়, দুর্নীতি। এজন্য স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে অর্থের ব্যয়ের ব্যাপারে।

আমাদের রোগী সেবার বরাদ্দ বেশি হওয়া উচিত ছিল স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা আর সুশাসন আনা জরুরি। দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ানো, কেবল ডাক্তার নয় সহযোগী নার্স আর মেডিকেল টেকনোলজিস্ট তৈরি করা জরুরি। দক্ষ, দায়বদ্ধ আর অনুপ্রাণিত স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে পারলে স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব আনা সম্ভব।

অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী ।। প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ