গত কয়েক মাস ধরে বেশ কয়েকটি আলোচিত বিষয় হলো, সুন্দরবনে আগুন লাগা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বনাঞ্চলে আগুন, বাবুই পাখিকে পুড়িয়ে হত্যা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা ইত্যাদি। একজন প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে বিষয়গুলো আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে এবং মারাত্মকভাবে আহত করেছে। এই সংকটে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি মনে পড়ছে। কবিগুরু লিখেছেন—

‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু
নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ
তুমি কি বেসেছ ভালো।’

কবিগুরু প্রকৃতি এবং পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিচারের ভার সৃষ্টিকর্তার কাছে দিয়ে গেছেন। প্রকৃতির প্রতি ক্ষুধা, অপরিসীম লোভ এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন আজ মানুষকে প্রকৃতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

জীববৈচিত্র্যের আধার বলে খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বনাঞ্চলে প্রায় প্রতিবছর আগুন লাগানো হয়। এবছর আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান বনজ, ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ। পুড়ে কয়লা হয়েছে বিলুপ্ত প্রায় গুই সাপ, ছোট-বড় অগণিত প্রাণী। দমকল বাহিনী এনে নেভাতে হয়েছে আগুন। সচেতন ছাত্র-শিক্ষক, পরিবেশ প্রেমীরা প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু দুষ্কৃতিকারীরা ধরা পড়েনি, ধরা পড়বেও বলে মনে হয় না।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে সুন্দরবনে ২৩ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর আগের ২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ‘৭১ একর’ বনভূমির নানা গাছ, গুল্ম-লতা পুড়ে গেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জীববৈচিত্র্য।

প্রকৃতির প্রতি ক্ষুধা, অপরিসীম লোভ এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন আজ মানুষকে প্রকৃতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই দশকে সুন্দরবনে ২৩ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০০২ সালে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার; একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দার বাড়িয়ায় দু’বার; ২০০৫ সালে ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দু’বার; ২০০৬ সালে পচাকোড়ালিয়া তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার; ২০০৭ সালে নাংলী পচাকোড়ালিয়া ও ডুমুরিয়ায় তিনবার; ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার; ২০১১ সালে নাংলীতে দু’বার; ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার; ২০১৬ সালে পচাকোড়ালিয়া নাংলী ও তুলাতলায় তিনবার এবং ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

২০২১ সালের ৯ এবং ১০ এপ্রিল ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে বাসা ভেঙ্গে ও পুড়িয়ে প্রায় ১৮৩টি বাবুই পাখি হত্যা করা হয়। সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটাপথ, খাবারের দোকানসহ নানান স্থাপনা তৈরির সময় গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। যেখানে মানুষের সাথে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্যপূর্ণ সহবস্থান হওয়ার কথা সেখানে তা না হয়ে ধীরে ধীরে আমরা বৈরিতার দিকে যাচ্ছি।

পৃথিবী নামক এই ছোট্ট গ্রহটিকে মানুষ কেবল নিজেদের জন্যই ভাবছে! গাছের সুশীতল ছায়া, পাখির কলকাকলি, ময়ূরের নাচন, শিয়াল ও বন বিড়ালের ডাক, সকালের সোনা রোদ, প্রশান্তিময় বিকেল ইত্যাদি মানুষ যেন আজ হারিয়ে ফেলতে ব্যস্ত।

প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে অযাচিত ও অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে পৃথিবীকে আমরা ভারসাম্যহীন করে চলেছি। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি প্রকৃতির এক ধরনের প্রতিশোধ বলে অনেকেই মনে করেন। করোনাকালীন যেখানে আমাদের বেঁচে থাকাই অনিশ্চিত, সেই সময়েও আমরা নিজের স্বার্থে দ্বিধাহীনভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছি।

মানুষ যখন থেকে আধুনিক সভ্যতার সন্ধান পেয়েছে তখন থেকেই প্রকৃতি-পরিবেশে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। কোনো উদ্যান বা বনে একটি বাস্তুসংস্থান থাকে। আর সেখানে থাকে একটি খাদ্য শৃঙ্খল এবং খাদ্য জাল। এই বাস্তুসংস্থানে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সমন্বয় থাকে।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি প্রকৃতির এক ধরনের প্রতিশোধ বলে অনেকেই মনে করেন। করোনাকালীন যেখানে আমাদের বেঁচে থাকাই অনিশ্চিত, সেই সময়েও আমরা নিজের স্বার্থে দ্বিধাহীনভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছি।

বাস্তুসংস্থানের একটি জীব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য জীবকে উপকার করে। এই আবাসস্থল ধ্বংস করার অর্থ হল খাদ্য শৃঙ্খলকে ভেঙে দেওয়া। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানবজাতির জন্যই ক্ষতির কারণ। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিবে, ধ্বংস করবে মানব জাতিকে।

জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে পরিবেশ নষ্ট করে ভালো থাকা যায় না। প্রকৃতিতে মানুষের যেমন প্রয়োজন আছে ঠিক তেমনি প্রয়োজন অন্যান্য জীবের। এই পৃথিবীতে ছোট বড় উদ্ভিদ ও প্রাণীর বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। মানুষের আচরণগত কারণে যদি পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে সেটাকে পরিবেশের অধিকার ভঙ্গের শামিল হিসেবে বিবেচনা করাটা অত্যন্ত জরুরি।

প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংসকারী শক্তির মোকাবিলায় প্রয়োজন ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ সচেতনতা এবং মিডিয়ার সহযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপনেরও প্রয়োজন।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৮ক অনুচ্ছেদ পরিবেশের সংরক্ষণ, পরিবেশের মানোন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করাকে রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশে আইন ও নীতিমালাও রয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় ও মেট্রোপলিটন শহরে পরিবেশ আদালত গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরও শাস্তি হওয়া তো দূরের কথা, ধরা পড়ে না সুন্দরবন বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন লাগানোর দুষ্কৃতিকারীরা।

প্রকৃতির সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্ব জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে, জীবনধারণকে আরও উপযোগী করে। সুস্থ প্রকৃতি ও পরিবেশ আধুনিক সভ্যতা ও আগামীকে সত্যিকারার্থে স্থায়িত্ব দান করবে। প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে বৈরিতা নয় চলুন সেতুবন্ধন রচনা করি।
কবিগুরুর মতো আমিও বলতে চাই—

‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ
ধূলিরে ধন্য করো করুণার পুণ্যে হে কোমল প্রাণ।’

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়