বাংলাদেশে কোভিড-১৯ বিশ্ব মহামারির ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ ধীরে ধীরে নিচে নামছে। অনেকের মনে শঙ্কা, আবার ‘তৃতীয় ঢেউ’ আসবে না তো? বিশেষ করে যখন নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতে এখন বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু ঘটছে। তবে ভারতে যদি এ মুহূর্তে কোভিড-১৯ বিশ্ব মহামারির তাণ্ডব না-ও থাকতো তবুও আমাদের দেশে ‘তৃতীয় ঢেউ’ ওঠার শঙ্কা আছে। কারণ সারা বিশ্ব থেকে কোভিড-১৯ মহামারি দূর না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকেই যেকোনো দেশে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। যারা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পেরেছে তারা তত সহজে ‘নতুন ঢেউ’ সামাল দিয়েছে। এ প্রস্তুতি কোথায় কোথায় নিতে হবে?

সংক্রামক ব্যাধির মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতির মূল কাজ হলো সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ রোগীর সংখ্যা কমাতে না পারলে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা যতই বাড়ানো হোক তা এক সময় রোগীর ভিড়ে উপচে পড়বে।

সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রথম কাজ হচ্ছে যারা শনাক্ত হচ্ছেন তাদের প্রত্যেককে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা। সংক্রমিতদের ৯০-৯৫ শতাংশের মধ্যে রোগের লক্ষণ হয় মৃদু নয়তো লক্ষণবিহীন।

এদের সাধারণত হাসপাতালে না গেলেও চলে। এদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল তারা নিজ বাসাতেই পৃথক ঘরে থাকতে পারেন। তারা চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগও করতে পারেন। কিন্তু বেশিরভাগ রোগী সীমিত আয়ের বা একেবারেই ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ মানুষ। তারা বাইরে কাজে না গেলে পরিবারের খাবার না জোটার আশঙ্কা আছে। তাই তারা সামান্য জ্বর-কাশিকে আমলে না নিয়ে কাজে বের হন।

চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ কিংবা সক্ষমতা থাকে না এদের। কিন্তু এদের ভেতরে যদি কারো শরীর একেবারেই খারাপ হয়ে পড়ে, তখন হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয় এবং কারো কারো ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তে তেমন কিছু চিকিৎসা করার উপায়ও থাকে না। এদের চিকিৎসা ও অসুস্থকালে ঘরে রাখার জন্য দরকার সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক সহায়তা। এভাবে নিশ্চিত হতে পারে সংক্রমণের প্রত্যক্ষ উৎসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

সংক্রমণ প্রতিরোধের দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে সব নাগরিকের স্বাস্থ্যবিধি পালন। ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা, বাইরে কোনো কিছু স্পর্শ করার পরে সাবান দিয়ে দু’হাত ধুয়ে ফেলা, অন্য মানুষের কাছ থেকে কমপক্ষে দু’হাত দূরে থাকা, বদ্ধ ঘরে ভিড় সৃষ্টি না করা ইত্যাদি হচ্ছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জনস্বাস্থ্যের নিয়মাবলী।

সংক্রমণের অজানা উৎস থেকে সুরক্ষার জন্য এসব নিয়ম মানা জরুরি। স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানবার ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা খুবই দরকার। সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এর পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সামাজিক উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সক্ষম করে তুলতে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারি ও সামাজিক সহায়তা অপরিহার্য।

সংক্রমণ প্রতিরোধের দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে সব নাগরিকের স্বাস্থ্যবিধি পালন। ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক পরা, বাইরে কোনো কিছু স্পর্শ করার পরে সাবান দিয়ে দু’হাত ধুয়ে ফেলা, অন্য মানুষের কাছ থেকে কমপক্ষে দু’হাত দূরে থাকা...

সংক্রমণের শীর্ষ পর্যায়ে যখন সরকারি নির্দেশে ঘরে থাকতে বলা হয়, যাতায়াত বন্ধ করা হয় এবং সব অফিস-আদালত বন্ধ করে দেওয়া হয় (যা লকডাউন বলে পরিচিত) তখন প্রান্তিক মানুষদের জন্য এ সহায়তাটা সবচেয়ে জরুরি। কারণ প্রান্তিক মানুষদের ঘরে থাকতে হলে তাদের দৈনন্দিন খাদ্যের জোগান দেওয়াটা জরুরি। এ জোগান দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে সরকার ও সামাজিক শক্তিকে। না হলে এ স্বাস্থ্যবিধি অকার্যকর হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, কোভিড-১৯ বিশ্ব মহামারি থেকে একক প্রচেষ্টায় কেউ নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবেন না, সবার সুরক্ষা নিশ্চিত হলেই ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত হতে পারে।

সংক্রমণ প্রতিরোধের তৃতীয় কাজ হচ্ছে কোভিড-১৯ এর টিকা নেওয়া। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে টিকার সরবরাহ সীমিত। কিছুদিনের মধ্যেই আরও টিকা আসছে। টিকার সরবরাহ নিশ্চিত হলে প্রাপ্য সব মানুষকে টিকা নিতে হবে।

বিশেষ করে প্রবীণ জনগোষ্ঠী, ডায়াবেটিস-উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় আক্রান্ত মানুষদেরকে টিকা নিতে হবে। যত বেশিসংখ্যক মানুষ টিকা নেবেন মৃত্যুর ঝুঁকি ততই কমে যাবে।

এ তিনটি কাজের প্রস্তুতি যত ভালো হবে তৃতীয় ঢেউয়ের বিপদ ততই দূরবর্তী হবে। আর নতুন ঢেউ যদি এসেই যায়, সে ঢেউকে দ্রুতই নামিয়ে দেওয়া যাবে, যেমনটি ২০২০ সালের নভেম্বরে করা গিয়েছিল বাংলাদেশে।

ডা. মুশতাক হোসেন ।। উপদেষ্টা, ইন্সটিটিউট অব এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর)