আমার ছেলের বয়স সাড়ে তিন বছর হতেই, তার মা তাকে নিয়ে চলে গেলেন বাংলাদেশে। উদ্দেশ্য, দেশে ছেলেকে প্রি-স্কুলে ভর্তি করানো। কিন্তু নানান কারণে মিশন ব্যর্থ হলো। পাঁচ মাস বাদেই মা-ছেলে ফিরে এল বেইজিং। এখন কী করি? খোঁজ নিয়ে জানলাম, বেইজিংয়ে কোনো বাংলা স্কুল নেই।

বাংলাদেশি দূতাবাস থেকে নানান সময়ে স্কুল খোলার উদ্যোগের কথা শুনেছি, কিন্তু কোনো উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। ভারতীয় দূতাবাসে নাকি একসময় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছিল। কিন্তু বিশেষ কারণে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানের দূতাবাস এখনো একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল চালায়। ফি-ও তুলনামূলকভাবে কম। আর আমি তখন ডেসপারেট। কিন্তু বাদ সাধলো দূরত্ব। আমরা থাকি শহরতলীতে। আর পাকিস্তানি স্কুল হচ্ছে শহরের কেন্দ্রে। এতো দূরে ওদের কোনো বাস সার্ভিসও নেই। ছেলেকে ওখানে ভর্তি করালে প্রতিদিন আসা-যাওয়ায় রাস্তাতেই কাটবে ৩ ঘণ্টা।

বেইজিংয়ে অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে। কোনো কোনোটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কোনো কোনোটির এক মাসের ফি আমার বেতনের দ্বিগুণ-তিনগুণ হবে। কিছুদিন খোঁজ-খবর নিয়ে ক্ষান্ত হলাম। কিন্তু ছেলেকে তো কোথাও-না-কোথাও দিতে হবে! এখানকার সরকারি স্কুলে তাকে ভর্তি করানো যায়, কিন্তু তার জন্য দু’বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, ৬ বছর না হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের ভর্তি করানো হয় না। অথচ ছেলের বয়স মাত্র ৪! মাথা নষ্ট হওয়ার উপক্রম। এসময় বাড়ির কাছাকাছি একটি ইন্সটিটিউটের খোঁজ পেলাম। ডিজনি ইংলিশ। সপ্তাহে দু’দিন ক্লাস, এক ঘণ্টা করে। শুধু ইংরেজি শেখাবে। শিক্ষকদের অধিকাংশই বিদেশি। এক বছরের জন্য একসঙ্গে ফি দিতে হবে ২৪ হাজার ইউয়ান (এক ইউয়ান সমান বাংলাদেশের ১৩ টাকা)। আমার জন্য অংকটা যথেষ্ট বড়। কিন্তু আমার সামনে তখন কোনো অপশন নেই। ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলাম। এতে দুটো লাভ হলো, ছেলে ইংরেজিটা শিখতে শুরু করলো এবং প্রাতিষ্ঠানিক কালচারের সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকল।

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে সরকারি কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের ভর্তি করানো খুব কঠিন কাজ। শুনেছি, যে শিশুটি আজ জন্মগ্রহণ করেছে, সেই শিশুটির জন্যও কোনো কোনো বাবা-মা নির্দিষ্ট কিন্ডারগার্টেনে সিরিয়াল দিয়ে রাখেন! মানে, সাড়ে তিন বছর পর শিশুটি ওই কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হবে বলে নাম রেজিস্ট্রেশন করান!

এক বছর পর ছেলেকে একটা সরকারি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করানোর সুযোগ পেলাম। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে সরকারি কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের ভর্তি করানো খুব কঠিন কাজ। শুনেছি, যে শিশুটি আজ জন্মগ্রহণ করেছে, সেই শিশুটির জন্যও কোনো কোনো বাবা-মা নির্দিষ্ট কিন্ডারগার্টেনে সিরিয়াল দিয়ে রাখেন! মানে, সাড়ে তিন বছর পর শিশুটি ওই কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হবে বলে নাম রেজিস্ট্রেশন করান! বুঝতেই পারছেন, ‘আগে আসলে, আগে পাবেন’ ভিত্তিতে ভর্তির কাজ চলে। কোনো দুই নম্বরি নেই। সেই হিসেবে আমার ছেলের কোনো চান্স নেই। আমি তাকে নিয়ে গেলাম একটা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনে। খরচ মোটামুটি আয়ত্তের মধ্যে। কথাবার্তাও মোটামুটি ফাইনাল। ছেলের মেডিকেল টেস্ট করানো হলো। ভর্তির দিনক্ষণও ঠিক হলো। কিন্তু ভর্তির দিন গিয়ে দেখি ঝামেলা বেধেছে।

কিন্ডারগার্টেনের কোনো অনিয়মের কারণে সরকার সেটি বন্ধ করে দিয়েছে এবং সেখানকার সকল শিশু-শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তির সুযোগ দিচ্ছে (এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো। অনিয়মের কারণে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়েই সরকার ক্ষান্ত হয়নি, সেখানকার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, তাও নিশ্চিত করেছে!)। আমার ছেলে তখনও অফিসিয়ালি ভর্তি হয়নি। কিন্তু চীনা সহকর্মী শিয়ে নান (আকাশ)-এর দৌড়ঝাঁপ ও অফিসের শ্রমিক ইউনিয়নের চেষ্টায়, আমার ছেলেটাও একটি সরকারি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তির সুযোগ পেল। সেটা ছিল আমার জন্য একটা বড় রিলিফ। কারণ, সরকারি কিন্ডারগার্টেনের মান ভালো এবং খরচও কম।

সরকারি কিন্ডারগার্টেনে মূলত বাচ্চাদের সারাদিন টেক-কেয়ার করা হয়। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বাচ্চারা সেখানেই ঘুমায়। খেলাধুলার ছলে লেখাপড়াও হয়। চীনা ভাষা, ইংরেজি বর্ণমালা ইত্যাদি শেখানো হয়। আসলে সেখানে বাচ্চাদের তৈরি করা হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য। চীনা বাচ্চারা মূলত আড়াই বছর কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সুযোগ পায়। আমার ছেলে পেয়েছে মাত্র এক বছর। কিন্তু এই এক বছরে সে মোটামুটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য। এক বছর পর বাড়ির কাছাকাছি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করানো হলো। শুরুর দিকে ভাষার কারণে ঝামেলা হচ্ছিল। ক্লাসে লেকচার চলে চীনা ভাষায়। আমার ছেলে খুব একটা চীনা ভাষা বোঝে না। কিন্তু শিক্ষকদের ধৈর্য ও ছেলের আগ্রহে শেষ পর্যন্ত ভাষার বাধা মোটামুটি উতরে গিয়েছে।

ছেলের লেখাপড়ার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুয়ারে ধরনা দিয়ে আমি এটুকু বুঝেছি যে, চীনারা ইংরেজির উপর যথেষ্ট জোর দিয়ে থাকে। ডিজনি ইংলিশে আমি ছেলেকে মাত্র এক বছর পড়িয়েছি, কনটিনিউ করিনি। কারণ, এটি ভীষণ ব্যয়বহুল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে চীনা শিশুদের ভিড় লেগেই থাকে।

শিশু সন্তানদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে চীনা বাবা-মা’রা বিপুল অর্থ ব্যয় করতেও পিছপা হন না। চীনের অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেও পড়ছে অসংখ্য চীনা শিক্ষার্থী। আগেই বলেছি, আন্তর্জাতিক মানের কোনো কোনো স্কুলে খরচ অনেক বেশি। অথচ সেসব স্কুলের কোনো কোনোটিতে টাকা থাকলেও ভর্তি হওয়া যায় না! রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হয়। কারণ, চাহিদা বেশি। বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনগুলোতে বাচ্চাদের ইংরেজি শেখানো হয়। এমনকি, সরকারি কিন্ডারগার্টেনেও টুকটাক ইংরেজি শেখানো হয়। আর প্রাথমিক স্কুলে তো ইংরেজি বাধ্যতামূলক।

চীনে ২০০১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় গ্রেড থেকে ইংরেজি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এর মানে, চীনের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় গ্রেড থেকেই ইংরেজি ভাষা শেখানো হয়। কোনো কোনো স্কুলে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে ইংরেজি শেখানো হয় প্রথম গ্রেড থেকেই। আমার ছেলে যে স্কুলে পড়ে, সে স্কুলের প্রথম গ্রেড থেকেই চীনা ভাষা ও গণিতের পাশাপাশি ইংরেজি পড়ানো হয়। চীনে ‘কাওখাও’ (gaokao) নামের একটি জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়। এই পরীক্ষার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। একে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-পরীক্ষাও বলা যায়। তো, ১৯৭৮ সালে কাওখাও পরীক্ষার অংশ করা হয় ইংরেজি ভাষাকেও। অর্থাৎ চীনা ভাষা ও গণিতের পাশাপাশি, এই পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি জ্ঞানও পরখ করা হয়।

চীনে ২০০১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় গ্রেড থেকে ইংরেজি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ইংরেজি ভাষায় চীনাদের দক্ষতা ক্রমশ বাড়ছে। একটা সময় ছিল যখন চীনের রাজধানীতেও ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যা ছিল বিরল। কিন্তু দিন বদলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরও বহু চীনা শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষার ওপর আরও দক্ষতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কোর্স করে থাকে। আজকাল বহু চীনা শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে। বিদেশে যেতে জিআরই (Graduate Record Examinations), আইইএলটিএস (International English Language Testing System), টোফেল (Test of English as a Foreign Language) ইত্যাদি টেস্টে ভালো স্কোর লাগে। এসব টেস্টে অংশগ্রহণকারী চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

এই যে প্রি-স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার চর্চা, তার সুফলও পাচ্ছে চীন। ইংরেজি ভাষায় চীনাদের দক্ষতা ক্রমশ বাড়ছে। একটা সময় ছিল যখন চীনের রাজধানীতেও ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যা ছিল বিরল। কিন্তু দিন বদলেছে। এখন অনেকে, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের অনেকেই ভালো ইংরেজি বলতে পারে। আমরা মানে বিদেশিরা যখন পথে চলাচল করতে সাহায্যের জন্য কোনো চীনার দিকে হাত বাড়ানোর প্রয়োজন বোধ করি, তখন তরুণ-তরুণীদের দিকেই প্রথমে তাকাই। অনেক সময় দেখা যায় স্কুল-পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও ফটফট করে ইংরেজি বলে।

শুধু যে আমাদের মানে বিদেশিদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে দাবি করছি যে, ইংরেজিতে চীনাদের দক্ষতা বেড়েছে ও বাড়ছে, তা কিন্তু নয়। জরিপ থেকেও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

সুইডেনের শিক্ষা কোম্পানি ‘ইএফ এডুকেশন ফার্স্ট’ (EF Education First) বিগত দশ বছর ধরে ইংরেজি দক্ষতা সূচক (English Proficiency Index) প্রকাশ করে আসছে। যেসব দেশে ইংরেজি মূল ভাষা নয়, সেসব দেশের মানুষের ইংরেজিতে দক্ষতা কেমন, তা এই সূচক দেখে ধারণা করা যায়।

কোম্পানি ২০২০ সালে যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে স্থান পেয়েছে ১০০টি দেশ, যেসব দেশের মূল ভাষা ইংরেজি নয়। এই তালিকা প্রকাশ করার আগে কোম্পানিটি এসব দেশের ২২ লাখ ইংরেজি জানা মানুষের ইংরেজিতে লেখা ও পড়ার দক্ষতা যাচাই করেছে। এই ২২ লাখ মানুষের গড় বয়স ২৬। তাদের ৯৪ শতাংশের বয়স ৬০-এর নিচে এবং ৫৪ শতাংশ হচ্ছে নারী।

কোম্পানির বিশ্লেষণ অনুসারে, নন-ইংলিশ স্পিকিং দেশগুলোর মধ্যে হল্যান্ডের মানুষের ইংরেজিতে দক্ষতা সবচেয়ে বেশি। তারা ৮০০ পয়েন্টের মধ্যে পেয়েছে ৬৫২ পয়েন্ট। ডেনমার্ক (৬৩২) দ্বিতীয়, ফিনল্যান্ড (৬৩১) তৃতীয় এবং সুইডেন (৫২৫) আছে চতুর্থ স্থানে। আর সবচেয়ে কম ৩৮১ পয়েন্ট পেয়েছে তাজিকিস্তান। আর চীনের অবস্থান তালিকায় ৩৮তম; স্কোর ৫২০। তবে, উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, আগের বছরের তালিকায় চীনের অবস্থান ছিল ৪০তম। এর মানে, এক্ষেত্রে চীনের উন্নতি হচ্ছে, ধীরে হলেও। কোম্পানির বিশ্লেষণ অনুসারে, চীনের অভ্যন্তরে ইংরেজিতে দক্ষতা সবচেয়ে ভালো সাংহাই ও হংকংয়ের। এর পরেই তাইওয়ান ও বেইজিংয়ের স্থান।

চীন একদা ‘ব্যাম্বু কার্টেন’-এর আড়ালে নিজেকে ঢেকে রেখেছিল। বাকি বিশ্বের কাছে চীন ছিল অনেকটাই অজানা-অচেনা। কিন্তু ১৯৭৮ সালের পর থেকে এ অবস্থার আমূল পরিবর্তনের সূচনা হয়। চীন ‘ব্যাম্বু কার্টেন’-এর আড়াল থেকে বের হয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করতে থাকে বাকি বিশ্বের সামনে। স্বাভাবিকভাবেই বাকি বিশ্বের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের মূল ভাষা-মাধ্যম হয়ে ওঠে ইংরেজি। সেই থেকে চীনাদের মধ্যে ইংরেজি শেখার আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা চলে।

ইএফ চায়না-র নির্বাহী ভাইস-প্রেসিডেন্ট জিন লিউ বলেছেন, চতুর্দশ পাঁচসালা পরিকল্পনায় চীনের সরকার আরও উচ্চমানের উন্মুক্তকরণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্য ঠিক করেছে। এই লক্ষ্য পূরণে ইংরেজি ভাষায় চীনাদের দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)