এক অদৃশ্য আততায়ীর সঙ্গে লড়ছে গোটা পৃথিবী। করোনা মহামারি স্থবির করে দিয়েছে মানুষের জীবন। রুদ্ধ হয়ে পড়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবন-স্পন্দন। মানুষ মরণশীল প্রাণী-এ কথা কম বেশি সব মানুষই জানেন। তাই মৃত্যু এক স্বাভাবিক প্রসঙ্গ। মৃত্যুকে কেউ ভয় পায়, কেউবা কামনা করে অর্থবহ মৃত্যু। জীবন মানুষকে এ শিক্ষাই দেয়- বাঁচতেও হবে বাঁচার মতো- অর্থাৎ অর্থবহ বাঁচা, মরতেও হবে মরার মতো; অর্থাৎ অর্থবহ মৃত্যু।

জন্ম মুহূর্তে মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে এ অর্থবহতা; তথা যদি অর্থনীতির শব্দে বলা যায়, তবে বলতে হবে ‘ভ্যালু অ্যাড’ হয়। অর্থাৎ ‘মূল্য সংযুক্ত’ হয়। এ সংযোজিত মূল্য কিংবা অর্থবহতার মানে তাহলে কী? কীভাবে আমরা বুঝব তাকে? একটা মাত্র শব্দে এ অর্থবহতাকে বুঝতে হলে বলতে হবে- ‘পরার্থপরতা’- কবির ভাষায়, ‘সকলের তরে সকলে আমরা,/ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। পৃথিবীতে প্রতিটি জীবন প্রস্ফুটিতও হয়- পরার্থপরতার মূল্য ধারণ করে।

একটি শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন এবং সমাজে একটি স্বপ্নের জন্ম হয়। সে স্বপ্ন হচ্ছে শিশুটি তার জীবন পরিক্রমণের মধ্য দিয়ে মানুষ এবং পৃথিবীকে কী দিয়ে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে। তাই জন্ম হওয়া মাত্রই একটি স্বপ্নের সূচনা। আর সেই স্বপ্নগুলোর বাস্তব রূপায়ণের মধ্য দিয়েই আজকের সভ্যতার বর্তমান পরিণতি ও বাস্তবতায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি।

পরার্থপর জীবনের অর্থবহ চেতনায় অসংখ্য সাহসী সন্তান এই দুঃসময়ে স্বেচ্ছাব্রতী হয়ে কাজ করেছেন। ফলে করোনা মহামারির প্রথম ঢেউকে আমরা সামাল দিতে পেরেছি বলা চলে অল্প ক্ষতির বিনিময়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি।

মানুষ তার জন্ম এবং মৃত্যু দুটোকেই অর্থবহতায় পূর্ণ করতে চায়। সেখানেই তার জীবনের সার্থকতা এবং চরিতার্থতা। মানুষের সেই চরিতার্থ জীবনকে তুচ্ছ করে দেয়, ব্যর্থ করে দেওয়ার প্রয়াস পায়- মহামারি। অতীতে প্লেগ মহামারিতে অনেক মানুষ মারা গেছে। বিভিন্ন রোগ, প্রাকৃতিক-দুর্যোগ এবং দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ মারা গেছে। এ মৃত্যু সন্দেহ নেই মানবসভ্যতার, মানব সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি, অকল্পনীয় অপচয়।

প্রায় কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি মানবসভ্যতাকে ফের সেই ক্ষতি এবং অপচয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সচেতন মানুষ একে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বলেই শনাক্ত করছেন। কিন্তু এই যুদ্ধের কোনো প্রকাশ্য শত্রু নেই। কোনো দৃশ্য যোগ্য মারণাস্ত্র নেই। এক অদৃশ্য অনিয়ন্ত্রিত ভাইরাস ঘরে বাইরে আমাদের তাড়িয়ে ফিরছে মৃত্যু আতঙ্কে।

যেকোনো দুর্যোগে, দুঃসময়ে আমাদের জাতীয় চরিত্রের অর্থবহ দিকটা মহিমান্বিত হয়ে প্রকাশিত হয়। করোনা দুর্যোগের শুরুতেই এ অসম যুদ্ধের লড়াইয়ে ‘আমরা বাইরে আছি, আপনারা ঘরে থেকে সংক্রমণ রোধে সহযোগিতা করুন’- এরকম স্ট্র্যাটেজিতে সরকারের পদক্ষেপে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়ে সংক্রমণকে এড়াতে ভূমিকা রেখেছেন।

সরকার ছুটি ঘোষণা করে, মানুষকে সংক্রমণের বাইরে রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়েছে। একই সঙ্গে কর্মহীন মানুষকে বাঁচাতে ঘরে ঘরে জীবনোপকরণ পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। পরার্থপর জীবনের অর্থবহ চেতনায় অসংখ্য সাহসী সন্তান এই দুঃসময়ে স্বেচ্ছাব্রতী হয়ে কাজ করেছেন। ফলে করোনা মহামারির প্রথম ঢেউকে আমরা সামাল দিতে পেরেছি বলা চলে অল্প ক্ষতির বিনিময়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। যদিও ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত গবেষণা ও পরিশ্রমে ভ্যাকসিন এসে গেছে।

আমরা দেখছি দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে দেশে কঠোর লকডাউন দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। দীর্ঘমেয়াদে লকডাউন কার্যকর কোনো প্রতিরোধক নয়- এ কথা সত্য। কিন্তু যেখানে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনায় আক্রান্ত মৃতদের লাশ সৎকারে জ্বালানি কাঠের অভাবের সংবাদ পাচ্ছি; শ্মশানে-কবরে লাশের সারির খবর জানছি- তখন আমাদের সচেতন, সংযমী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সে কারণেই সরকার লকডাউনের পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু জীবনের অনিবার্য প্রয়োজনে আমরা স্বল্পমেয়াদি লকডাউনও মানিয়ে নিতে পারছি না। ফলে শিথিল হয়ে পড়ছে সে পদক্ষেপ। আর এ শিথিলতার মধ্যেই ঘনিয়ে এসেছে ঈদুল ফিতর।

গত বছরাধিকাল কেবল ধর্মীয়ই নয়- কোনো সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক উৎসবই আমরা পালন করতে পারিনি। সেই সংযম আমাদের কিছুটা হলেও রক্ষা করেছে- এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে। ধর্মীয় উৎসব, ঈদ এবং অন্যান্য উপলক্ষ আমরা সেই সংযম অক্ষুণ্ণ রেখে আমাদের জীবনকে অর্থবহ করব এমনটাই আমার বিশ্বাস। ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরিচয়ে আমাদের কখনো কার্পণ্য ছিল না। করোনাকালেও আমরা তার অজস্র উদাহরণ দেখেছি।

করোনায় আমরা আমাদের অনেক প্রিয়জনকে অকালে হারিয়েছি। সেই তালিকা কম দীর্ঘ নয়। হিসাব করলে দেখা যাবে দেশের প্রায় সিংহভাগ পরিবারে কেউ না কেউ প্রিয়জন হারানোর অপূরণীয় শোক, ক্ষতি এবং অভাববোধ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি, পারিনি। এ রূঢ় বাস্তবতাকে সঙ্গী করে আমাদের এ অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। টিকে থাকতে হবে। অন্যদের টিকিয়ে রাখতে হবে।

আজীবন প্রায় হুইল চেয়ারে জীবন কাটানো মহাবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং’র মৃত্যু সম্পর্কে কথাগুলো অবিস্মরণীয়। তিনি বলেছেন, ‘মৃত্যু নিয়ে আমি ভীত নই। কিন্তু মরার জন্য তাড়াও নেই আমার। তার আগে করার মতো অনেক কিছু আছে আমার’। এটাই হচ্ছে অর্থপূর্ণ জীবনের অভিব্যক্তি এবং দাবি।

ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানীরা আমাদের জানাচ্ছেন যে, করোনাভাইরাস আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গী হয়ে যাবে। তাই এই মূর্তিমান আতঙ্ক সঙ্গীকে পরাস্ত করতে হলে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন পরিচালনা করতে হবে। শারীরিক দূরত্ব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক ব্যবহার এসব কঠোর কর্তব্য জ্ঞানে মানতে হবে।
মৃত্যু নিয়ে আমাদের প্রয়াত জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের একটি কথা স্মরণ করছি- তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধুর মৃত্যু একটি অঙ্গ হারানোর সমতুল্য।’ করোনা মহামারিতে আমরা আমাদের অনেক আত্মীয়, পরমাত্মীয় বন্ধু, সহকর্মীকে হারিয়েছি যা কিনা আমাদের এক রকমভাবে খঞ্জ করে গেছে।

আমাদের সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হবে একদিকে, আরেকদিকে নতুন করে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হই সেজন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকতে হবে। সর্বার্থে- আমরা যেন এমনভাবে চলি, যেন আমার জন্য অন্যের একবিন্দুও ক্ষতি না হয়।

আজীবন প্রায় হুইল চেয়ারে জীবন কাটানো মহাবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং’র মৃত্যু সম্পর্কে কথাগুলো অবিস্মরণীয়। তিনি বলেছেন, ‘মৃত্যু নিয়ে আমি ভীত নই। কিন্তু মরার জন্য তাড়াও নেই আমার। তার আগে করার মতো অনেক কিছু আছে আমার’। এটাই হচ্ছে অর্থপূর্ণ জীবনের অভিব্যক্তি এবং দাবি।

দীর্ঘ একটি মাস সিয়াম সাধনা, সংযমের শেষে যে উৎসব, যে ঈদ-সেই উৎসবটিকে যেন আমরা এই মৃত্যু আতঙ্কের খড়গের নিচে সংযতরূপে, সুন্দরভাবে, পরার্থপরতার চেতনায়-উদযাপন করে, পৃথিবীর সব মানুষের মনে, সাহস সঞ্চারিত করতে পারি। একটা কাজের জীবন, অর্থবহ জীবনের পৃথিবীতে সবাই প্রাণের কোলাহলে আবারও যাতে উজ্জীবিত হতে পারি, মিলিত হতে পারি সেটাই আমাদের আজকের প্রার্থনা।

সাইফুল আলম ।। সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব; সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর