লকডাউন নামে পরিচিতি পাওয়া করোনাকালীন সাম্প্রতিক বিধিনিষেধ অনেকটা গরিব মারা এবং ধনীবান্ধব হয়ে গেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার এবার ঈদে বাড়ি যাওয়া নিরুৎসাহিত করেছে, দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে। তারপরও প্রয়োজনের তাগিদে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ অনেক কষ্ট করে শিমুলিয়া এবং পাটুরিয়া ঘাটে পৌঁছানোর পর দেখতে পান ফেরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরে আবার ফেরি চলাচলের অনুমতিও দেওয়া হয়। এই যাত্রীরা নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির, যাদের পদে পদে কষ্ট সইতে হয়েছে।

অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্যও রয়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা উত্তরাঞ্চলের পথে কোনো ফেরি না থাকায় গাড়িতে করে সহজেই যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু যে পথে ফেরি আছে তাদের যাত্রাপথ সেখানে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে পথের কষ্ট দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে।

বড়লোকদের কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি, কারণ অনেক আগেই অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া তারা নিজের গাড়িতে করে গিয়েছেন, ফেরি বন্ধ থাকলে ঘুরে অন্য রাস্তায় গিয়েছেন। যেকোনো উপায়ে বাড়ি গিয়ে ফেসবুকে হাস্যোজ্জ্বল পারিবারিক ছবি পোষ্ট করেছেন এক প্রতিমন্ত্রী।

এর আগে রাজধানীতে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সাধারণ চাকরিজীবীদের অফিসে বা কাজে যেতে-আসতে চরম কষ্টভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু প্রাইভেটকার চলতে পেরেছে অবাধে, যানজট কম থাকায় বেশ আরামেও।

চলাচলের বিধিনিধেষ জারি করা হয়েছিল করোনা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য ছিল শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা। কিন্তু কি ঘটল? গণপরিবহন বন্ধ করে অফিস খোলা রাখায় লোকজন গেল এক সিএনজিতে ৫/৬ জন করে। আর ঈদে মানুষ কীভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি গিয়েছে সে ছবি আমরা সবাই দেখেছি।

সংক্রমণ কমানোর জন্য নেওয়া ব্যবস্থা, সংক্রমণের আশঙ্কা উল্টো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। ফেরি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মধ্যরাতে। পরদিন যে হাজারো মানুষ ফেরিঘাটে গেল তাদের অনেকেই সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা এ খবর জানতেন না।

চলাচলের বিধিনিধেষ জারি করা হয়েছিল করোনা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য ছিল শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা। কিন্তু কি ঘটল? গণপরিবহন বন্ধ করে অফিস খোলা রাখায় লোকজন গেল এক সিএনজিতে ৫/৬ জন করে। আর ঈদে মানুষ কীভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি গিয়েছে সে ছবি আমরা সবাই দেখেছি।

অথচ গত দুটো ঈদও কিন্তু করোনাকালেই পড়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারের ঈদযাত্রার বিষয়টি আগেই ভাবা যেত। আপনি যদি ফেরি বন্ধ রাখার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেন তাহলে মানুষজন যেন ঢাকা শহর থেকে বেরই হতে না পারে সে ব্যবস্থা নিলেন না কেন? বিধিনিষেধ সংক্রান্ত সরকারের সর্বশেষ সার্কুলারে বলা হয়েছিল সরকারি-বেসরকারি কোনো চাকরিজীবী কর্ম এলাকা ছাড়তে পারবেন না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার অনুরোধ-আহ্বান জানিয়েছেন অন্তত এবার ঈদে বাড়ি না গিয়ে যার যার জায়গায় থাকতে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কাগুজে ওই সিদ্ধান্ত এবং এই অনুরোধ-আহ্বান যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন কোনো বাধা মানে না।

যদি সিদ্ধান্ত থাকতো যে, কাউকে ঢাকা ছাড়তে দেওয়া হবে না তাহলে কয়েকদিন আগেই স্পষ্ট বলে দিতে হতো যে, কেউ বাড়ি যেতে পারবে না, রাস্তাঘাট সব বন্ধ থাকবে, জরুরি কাজ ছাড়া রাস্তায় কাউকে পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাহলে ফেরিঘাটের এমন ছবি দেখতে হতো না।

অথবা গত দুটো ঈদের অভিজ্ঞতা থেকে যেহেতু আমরা জানি যে, এক শ্রেণির মানুষ যেকোনো পরিস্থিতিতে ঈদে বাড়ি যাবেই, যে যাত্রায় স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই থাকে না, শারীরিক দূরত্ব রাখা যায় না, সেক্ষেত্রে অর্ধেক যাত্রী নেওয়ার শর্তে সব ধরনের গণপরিবহন খোলা রাখলে ক্ষতি তুলনামূলক কম হতো।

পাশের দেশ ভারতের করোনা পরিস্থিতি আমরা সবাই জানি। সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পাশের দেশ নেপালের পরিস্থিতি এখন ভারতের মতো হতে চলেছে। আমরাও ভারতের পাশের দেশ। সরকারিভাবেই বলা হয়েছে করোনার ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট’ নামের বিপজ্জনক ধরনটি ইতোমধ্যেই দেশে ঢুকেছে। এটি যদি ব্যাপকভাবে দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তার ফল কী হতে পারে নেপাল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

যদি সিদ্ধান্ত থাকতো যে, কাউকে ঢাকা ছাড়তে দেওয়া হবে না তাহলে কয়েকদিন আগেই স্পষ্ট বলে দিতে হতো যে, কেউ বাড়ি যেতে পারবে না, রাস্তাঘাট সব বন্ধ থাকবে, জরুরি কাজ ছাড়া রাস্তায় কাউকে পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাহলে ফেরিঘাটের এমন ছবি দেখতে হতো না।

প্রশাসনের উচিত হবে ঈদের এই সময়টায় যশোরের দিকে বিশেষ নজর রাখা। কারণ ভারতের পরিস্থিতির চরম অবনতির পর সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হলেও সেদেশে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের মধ্যে যারা বিশেষ বিবেচনায় বেনাপোল সীমান্ত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তাদেরকে যশোরের বিভিন্ন এলাকায় কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।

যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ৮ মে রাতে এক টিভি টক শো’তে জানিয়েছেন, এইসব কোয়ারেন্টাইনে প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না। ভারত ফেরত কয়েকজন, যাদের করোনা শনাক্ত হয়েছে তার নমুনা সংগ্রহ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জিনম সিকোয়েন্স করে তাতে ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট’ মিলেছে।

সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে যারা শেষ পর্যন্ত বাড়ি গিয়েছেন বা এখনো যাচ্ছেন তারা ইতোমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত বা ভাইরাসটির বাহক হয়ে যেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের মাধ্যমে অন্য কেউ যাতে সংক্রমিত না হয় সে ব্যাপারে তারা এখন একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।

আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা, আড্ডার ক্ষেত্রে তারা যদি বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংযত থাকেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করেন তাহলে শুধু তাদের স্বজনদের প্রতিও সুবিচার করা হবে না, দেশ ও আপামর জনগণের ভালোর জন্যও অবদান রাখা হবে।

ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফেরার সময় যাতায়াতের ক্ষেত্রে যদি এখনকার মতোই বিধিনিষেধ বহাল থাকে তাহলে যাওয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধি যেভাবে দলিত হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আমার প্রস্তাব-অর্ধেক যাত্রী বহনের শর্তে বাস, ট্রেন, লঞ্চ-সব ধরনের গণপরিবহন খুলে দেওয়া হোক। এতেও স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি রক্ষা করা যাবে তা আশা করি না কিন্তু এ পদক্ষেপ তুলনামূলক গরিব-বান্ধব হবে, করোনা সংক্রমণের আশঙ্কাও কমে যাবে বলে ধারণা করি।

রেজোয়ান হক ।। বার্তা প্রধান, মাছরাঙা টিভি