অন্যান্য বস্তুরও কি ডান হাত বাম হাত আছে?
ছোটবেলায় আমার একটা সমস্যা ছিল। আমি ডান দিক বাম দিক চট করে চিনতে পারতাম না। কেউ যদি বলতো ডানে যাও, একটু চিন্তা করে দিক ঠিক করে তারপর ডানে যেতে হতো। পরে একটা বুদ্ধি বের করি। আমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে পোড়াচিহ্ন আছে, সেদিকটা হচ্ছে আমার ডানদিক। এরপর থেকে অনেক বড়বেলা পর্যন্ত ডান-বামের ব্যাপার থাকলে দ্রুত ঐ আঙুলটা দেখে দিক ঠিক করতাম। এখন আর প্রয়োজন হয় না, তবে অভ্যাসের দাস হিসেবে মনের অগোচরে আঙুলটা দেখে নেই কি না তা বলতে পারবো না। মানুষের হাতের এই যে ডান-বাম থাকা, এই হ্যান্ডেডনেসকে বাংলায় ‘পার্শ্ব-ধারণা’ বলা যেতে পারে। দিক না বলে ‘পার্শ্ব’ শব্দটাই জুতসই মনে হলো। দিক বলতে সাধারণত পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, ঊর্ধ্ব, অধ-এই দশ দিক বোঝায়। মানুষের ডান হাত বাম হাতের উদাহরণ দিয়ে বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- কাইরালিটি সহজে বোঝা যায়। কাইরালিটির আভিধানিক সংজ্ঞা আগে দেখে নেওয়া যাক। কাইরালিটি গ্রিক শব্দ ‘খেইর থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হাত। কাইরালিটি বলতে কোনো বস্তুর অসমমিতিক বা অসামঞ্জস্যসূচক সেই বৈশিষ্ট্যকে বোঝায় যার ফলে একটি বস্তু তার আয়নাচিত্র বা প্রতিচ্ছবির মতো হয় না, আলাদা হয়। বস্তুটিকে তার আয়নাচিত্র বা প্রতিচ্ছবির ওপর হুবহু মিল করে বসানো যায় না।
উদাহরণ দিলে আশা করি পরিষ্কার হবে। আমাদের ডান ও বাম হাত একে অপরের আয়নাচিত্র। আপনি যদি আপনার বাম হাতটি আয়নার সামনে ধরেন, তাহলে আয়নায় যে প্রতিবিম্বটি দেখবেন, সেটি আপনার ডান হাতের মতো দেখাবে। কিন্তু আয়নার ডান হাত যেদিকে মুখ করে আছে, আপনি যদি আপনার বাম হাতটি ঘুরিয়ে সেদিকে মুখ করে ওই ডান হাতের উপর রাখেন, তাহলে দেখবেন যে এদের হুবহু মিলানো যাচ্ছে না, বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি বাম দিকে থেকে যাচ্ছে, ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ডান দিকে থেকে যাচ্ছে; তর্জনী, মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠাও পরস্পরের উপরে বসছে না। দুটি হাত একে অপরের আয়নাচিত্র, কিন্তু আমরা একটিকে ঘুরিয়ে অন্যটির উপর পুরোপুরি বসাতে পারি না। এই বৈশিষ্ট্যটিকেই কাইরালিটি বলা হয়। এবার ক্রিকেট ব্যাটটি দেখুন। মূল ব্যাটটি (ব্যাটের মূল চিত্রটি) তার আয়নাচিত্রের উপর সুপারইম্পোজ করা যাচ্ছে; এমনভাবে মিলেছে যে কোন পার্থক্য করা যাচ্ছে না, ব্যাট একটা দেখাচ্ছে। অর্থাৎ ক্রিকেট ব্যাটের কাইরাল বৈশিষ্ট্য নেই।
বিজ্ঞাপন
একটি বস্তু, সিস্টেম বা অণুকে কাইরাল বলা হয় যদি এটিকে তার আয়নাচিত্র থেকে পার্থক্য করা যায়। এভাবেও বলা যায়, যদি একটি বস্তু এবং তার আয়নাচিত্র সুপারইম্পোজ করা না যায়, তাহলে বস্তুকে কাইরাল বলে। একটি কাইরাল বস্তু এবং তার আয়নার প্রতিচ্ছবিকে ইন্যানটিওমর্ফ বলে, গ্রিক ভাষায় যার অর্থ বিপরীত রূপ। আর যদি একটি বস্তু এবং এর আয়নাচিত্র সুপারইম্পোজ করা যায়, তাহলে বস্তুটি অ্যাকাইরাল, অর্থাৎ কাইরাল নয়। অতএব ক্রিকেট ব্যাট অ্যাকাইরাল।
মানুষ কাইরাল, কারণ মানুষের ডান এবং বাম হাত একে অপরের আয়নাচিত্র, কিন্তু অভিন্ন নয়। তবে মানুষেরই যে কেবল ডান হাত বাম হাত আছে তা নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাইরালিটি বস্তুজগতের জন্যও একটি মৌলিক ধারণা। এই কারণেই বাম হাতের দস্তানা ডান হাতে পরা যায় না, বিপরীতভাবে ডান হাতের দস্তানা বাম হাতে পরা যায় না। কাইরাল বস্তুর আরও উদাহরণ: জুতা, স্ক্রু, শামুকের খোলস ইত্যাদি। বাম জুতা এবং ডান জুতা একে অপরের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু ডান পায়ে বাম জুতা পরা যায় না। একটি ডান হাতের স্ক্রু (যা ঘড়ির কাঁটার দিকে শক্ত হয়) হলো বাম হাতের স্ক্রুর (যা ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে শক্ত হয়) আয়না প্রতিচ্ছবি এবং তারা একই নয়। বেশিরভাগ শামুকের খোলস ডানদিকে সর্পিল হয়, কিন্তু কিছু বামদিকে সর্পিল হয় এবং এগুলো একে অপরের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু সুপারইম্পোজেবল নয়।
বিজ্ঞাপন
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কাইরালিটি নিয়ে আলোচনার অবতারণা? কাইরালিটির গুরুত্ব কী? কাইরালিটি একটি ধারণা এবং আপাতদৃষ্টিতে এটিকে একটি ছোট বিষয় বলে মনে হতে পারে, তবে এর পরিণতি বিশাল হতে পারে। পূর্বে কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছি, এবারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এর যে দৃষ্টান্তসমূহ রয়েছে, তার বর্ণনায় আসছি। বিজ্ঞানে এই বৈশিষ্ট্যটির উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে, বিশেষ করে অণুর আচরণ, ওষুধ ও পদার্থের নকশা বোঝার ক্ষেত্রে। পদার্থের অণুর জন্যও কাইরালিটি একটি মৌলিক ধারণা। অণু হলো ক্ষুদ্র বিল্ডিং ব্লক যা আমাদের চারপাশের সবকিছু তৈরি করে। কিছু অণু ঠিক আমাদের হাতের মতো; তার একটি আয়না-প্রতিচ্ছবি থাকে যা গড়নে-গঠনে ঐ অণুর মত নয়, আলাদা। এই অণুগুলো কাইরাল বলে এবং তাদের আয়না-প্রতিচ্ছবিকে ইন্যানটিওমার বলে। অণুর জৈবিক কার্যকলাপে কাইরালিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্যানটিওমারগুলোর জৈবিক কার্যাবলীতে ভিন্নতা থাকতে পারে এবং কাইরালিটির গুরুত্ব সেখানেই। প্রায়শই একটি ইন্যানটিওমার (যেমন, বা-হাতি বা খ-ফর্ম) উপকারী প্রভাব ফেলতে পারে, অন্যদিকে অপরটি (যেমন, ডান-হাতি বা উ-ফর্ম) নিষ্ক্রিয় বা এমনকি ক্ষতিকারকও হতে পারে।
আরও পড়ুন
একটি ঐতিহাসিক ঘটনা দিয়ে দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ১৯৫০-দশকের শেষের দিকে এবং ৬০-দশকের গোড়ার দিকে থ্যালিডোমাইড নামক একটি ওষুধ বিশ্বের ৪৬টি দেশে গর্ভবতী মহিলাদের সেবনের জন্য ব্যবহৃত হতো। এটি মূলত গর্ভবতী মহিলাদের ‘মর্নিং সিকনেস’ (সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর খারাপ লাগা, বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি) উপশমের জন্য দেওয়া হতো। কিন্তু ৬০-দশকেই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে থ্যালিডোমাইড চিকিৎসার ফলে হাজার হাজার শিশু গুরুতর জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিচ্ছে। নভেম্বরে জার্মানির শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. উইডুলিন্ড লেঞ্জ এবং পরের মাসে অস্ট্রেলিয়ার ড. উইলিয়াম ম্যাকব্রাইড রিপোর্ট করেন যে থ্যালিডোমাইড গ্রহণকারী মায়েদের জন্ম নেওয়া শিশুদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গুরুতর ত্রুটি রয়ে যাছে। জন্মগত ত্রুটিগুলোর মধ্যে ছিল ফোকোমেলিয়া (হাত বা পা অস্বাভাবিকভাবে ছোট, আঙুল ও পায়ের আঙুল সংযুক্ত, নিতম্ব এবং উরুর হাড়ের অনুপস্থিতি ইত্যাদি), অ্যামেলিয়া (এক বা উভয় বাহু বা পা না থাকা), বোন হাইপোপ্লাশিয়া (হাড়ের বৃদ্ধি যথাযথভাবে না হওয়া) এবং কান, হৃদপিণ্ড বা অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো প্রভাবিত করে এমন সব ত্রুটি। গর্ভাবস্থায় থ্যালিডোমাইড ব্যবহারের ফলে আক্রান্ত মোট ভ্রূণের সংখ্যা ছিল ১০,০০০ এরও বেশি (মতান্তরে ২০,০০০ পর্যন্ত); এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ জন্মের সময় বা তার কিছুক্ষণ পরেই মারা যায়। হাজার হাজার গর্ভপাত সংঘটিত হয়। যারা বেঁচে ছিলেন তাদের উপরোল্লিখিত ত্রুটিসমূহ থেকে যায়। বিশ্বজুড়ে ব্যাপক হইচই পড়ে যায়। ইউরোপের বাজার থেকে ১৯৬১ সালে ওষুধটি প্রত্যাহার করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরুতেই থ্যালিডোমাইডের অনুমোদন প্রত্যাখ্যান করেছিল; এফডিএর কাছে আবেদনকারী ‘রিচার্ডসন-মেরেল ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি’র চাপের বিরুদ্ধে ফার্মাকোলজিস্ট ফ্রান্সেস ওল্ডহ্যাম কেলসির আপসহীন বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়। কেলসি ১৯৬২ সালে জন এফ. কেনেডির কাছ থেকে ‘রাষ্ট্রপতির পুরস্কার’ পেয়েছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে একটি ক্লিনিকাল পরীক্ষামূলক কর্মসূচির সময় ১,০০০ জনেরও বেশি চিকিৎসকের কাছে ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি থ্যালিডোমাইড বিতরণ করা হয়েছিল। অনুমান করা হয় যে প্রায় ২০,০০০ রোগীকে এ ওষুধ দেওয়া হয়েছিল; তার মধ্যে কয়েকশ গর্ভবতীকে মর্নিং সিকনেস এবং বাকিদের অস্থিরতা, দুর্বল মনোযোগ, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং হাইপোথাইরয়েডিজমের চিকিৎসার জন্য দেওয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থ্যালিডোমাইড-সম্পর্কিত বিকৃতি নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা ছিল ১৭ জন। যুক্তরাজ্যে সংখ্যাটি ছিল ২,০০০ এবং পশ্চিম জার্মানিতে ২,৫০০। বিভিন্ন দেশে ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করা হয়। যুক্তরাজ্যে থ্যালিডোমাইড বাজারজাতকারী ডিস্টিলার্স কোম্পানির (বর্তমানে ডিয়াজিওর অংশ) সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি ক্ষতিপূরণ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। কানাডা ১০৯ জন বেঁচে থাকা ব্যক্তিকে এককালীন ৫৬,০০০-৮৩,০০০ ডলার প্রদানের জন্য ১৯৯১ সালে অসাধারণ সহায়তা পরিকল্পনা চালু করে। ২০২০ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ১৪০ জনেরও বেশি আক্রান্ত ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির জন্য নিবন্ধন করে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ পার্লামেন্টে তাদের এবং তাদের পরিবারের কাছে জাতীয় ক্ষমা প্রার্থনা করেন; সরকার জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। জোসি লেক একজন কানাডিয়ান প্যারালিম্পিক স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত সাঁতারু, থ্যালিডোমাইড থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি এবং থ্যালিডোমাইড ভিক্টিমস অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডার সভাপতি। একই কারণে ফোকোমেলিয়ায় আক্রান্ত যুক্তরাজ্যের লরেন মার্সার অলিম্পিক মশাল বহন করেছিলেন।
থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডিকে ‘অদ্যাবধি সর্ববৃহৎ মানবসৃষ্ট চিকিৎসা বিপর্যয়’ হিসেবে বিবেচিত করা হয়। কিন্তু বিপর্যয়টির কারণ কী ছিল? বস্তুত এটি গর্ভবতী মহিলাদের উপর পরীক্ষা না করেই মর্নিং সিকনেসের ওষুধ হিসেবে চালু করা হয়েছিল। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে থ্যালিডোমাইড কেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা জানতে রসায়নবিদ এবং ফার্মাকোলজিস্টরা থ্যালিডোমাইডের আণবিক গঠন পরীক্ষা করতে শুরু করেন। তারা আবিষ্কার করেন যে থ্যালিডোমাইডের কাইরাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ২টি ইন্যানটিওমার রয়েছে; একটি এস-ইন্যানটিওমার, অপরটি আর-ইন্যানটিওমার। S-enantiomer অ্যাঞ্জিওজেনেসিস অর্থাৎ রক্তনালী গঠনে বাধা দেয় এবং ভ্রূণের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনের কার্যাবলীতে হস্তক্ষেপ করে, যার ফলে জরায়ুতে শিশুর জন্মগত ত্রুটি দেখা দেয়। পক্ষান্তরে অপরটি মস্তিষ্কের প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক নিউরোট্রান্সমিটার GABA-কে শক্তিশালী করে প্রশান্তি, তন্দ্রা এবং শিথিলতা সৃষ্টি করে, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং মর্নিং সিকনেস হ্রাস করে। মানুষের হাতের মতো কিছু চাবির একটি ‘বাম-হাতি’ সংস্করণ এবং একটি ‘ডান-হাতি’ সংস্করণ থাকে। এই সংস্করণগুলোর মধ্যে কেবল একটি মানুষের শরীরের তালায় ফিট হতে পারে, অন্যটি নাও হতে পারে, অথবা আরও খারাপ, তালা আটকে পর্যন্ত দিতে পারে! ঠিক যেমন একটি চাবি কেবল একটি নির্দিষ্ট তালার সাথে খাপ খায়, নির্দিষ্ট ধরনের অণুও নির্দিষ্ট ‘হাতওয়ালা’র সাথে কাজ করার জন্য ডিজাইন করা। গর্ভবতী নারীর দেহে R enantiomer হিতকর ভূমিকা পালন করলেও, S-enantiomer ভয়ংকর ভূমিকা পালন করেছিল। এটি ছিল একটি ভুল চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করার মতো - এটি কাজ করেনি, উল্টো তালা আটকে দিয়েছিল। তবে, লক্ষণীয়, তখন থ্যালিডোমাইডের নিরাপদ R-ইন্যানটিওমারটিই ব্যবহার করা হয়েছিল। তাহলে কেন বা কীভাবে বিপর্যয়টি ঘটেছিল? উত্তর হচ্ছে Racemization (রেসমাইজেশন অর্থাৎ আন্তঃরূপান্তর)-এর মাধ্যমে। শুধুমাত্র একটি ইন্যানটিওমার প্রয়োগ করা হলেও, শেষ পর্যন্ত উভয় ফর্মই উপস্থিত থাকতে পারে। রেসমাইজেশন বলতে কাইরাল অণুদ্বয় একটি ইন্যানটিওমারের ফর্ম (সাধারণত জৈবিকভাবে সক্রিয় L-ফর্ম) থেকে তার আয়না প্রতিচ্ছবি (D-ফর্ম)-তে অর্থাৎ বাম-হাতি থেকে ডান-হাতিতে অথবা ডান-হাতি থেকে বাম-হাতিতে রূপান্তরকে বোঝায়। রেসমাইজেশন প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উভয়ভাবেই ঘটতে পারে। থ্যালিডোমাইডের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবে ঘটেছিল; উপকারী ইন্যানটিওমারটি গর্ভবতী নারীদেহে কোনো এনজাইমের দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অপকারী ইন্যানটিওমারে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং ভ্রূণের বিকাশে হস্তক্ষেপ করে জন্মগত ত্রুটিসম্পন্ন শিশু উৎপাদন করেছিল। ক্রিকেটে হঠাৎ হঠাৎ আমরা এমন রেসমাইজেশন দেখে থাকি; ব্যাটসম্যান আসলে ডানহাতি, কিন্তু বোলার বল নিক্ষেপ করার সামান্য আগে বা পরে তিনি বামহাতি ব্যাটসম্যান হয়ে শট খেলেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এভাবে রিভার্স সুইপ শট খেলার জন্য বিখ্যাত।
থ্যালিডোমাইড ট্র্যাজেডি ওষুধ উৎপাদনে কাইরালিটি বিবেচনা করার গুরুত্বকে উঁচিয়ে ধরেছিল এবং নতুন ওষুধের জন্য আরও কঠোর পরীক্ষা এবং মান নিয়ন্ত্রণের সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। এটি প্রমাণ করে দেয় যে, অণুর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝা মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর কীরকম গভীর প্রভাব ফেলতে পারে এবং নিরাপদ ওষুধ তৈরির জন্য তা অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি, থ্যালিডোমাইড বিপর্যয় ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা বিষাক্ততা পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো পদ্ধতিগত বিষাক্ততা পরীক্ষার প্রোটোকল তৈরি করতে প্ররোচিত করে। অনেক দেশ ওষুধের পরীক্ষা এবং লাইসেন্সিংয়ের জন্য আরও কঠোর নিয়ম চালু করতে বাধ্য হয়। জেনে রাখা ভালো যে, ১৯৮০-এর দশকে থ্যালিডোমাইড দ্বিতীয় জীবন লাভ করে, যখন প্রমাণিত হয় যে এর ইমিউনোমোডুলেশন করার ক্ষমতা আছে; অর্থাৎ এটি TNF-α (টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর-আলফা) উৎপাদন হ্রাস করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। তাছাড়াও এর রয়েছে অ্যান্টি-অ্যাঞ্জিওজেনিক শক্তি, যা টিউমারে রক্তনালীগুলোর বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে থ্যালিডোমাইড ক্যান্সার (যেমন রক্তের ক্যান্সার মাল্টিপল মায়লোমা), লেপ্রোসি ও বিভিন্ন অটো-ইমিউন রোগের চিকিৎসায় কার্যকর হয়ে ওঠে। থ্যালিডোমাইড রেসমাইজেশনের জন্য কুখ্যাত। কিন্তু এক্ষেত্রে থ্যালিডোমাইড একটি রেসিমিক মিশ্রণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়-উভয় ইন্যানটিওমারই উপস্থিত থাকে। ইমিউনোমোডুলেশন ও অ্যান্টি-অ্যাঞ্জিওজেনিক প্রভাবগুলো একটি একক ‘বিশুদ্ধ’ ইন্যানটিওমারের পরিবর্তে রেসিমিক ফর্মুলেশন থেকে উদ্ভূত হয়।
কাইরাল অণুর ডান-হাতি বা বাম-হাতি ইন্যানটিওমার নামকরণের জন্য L/D পদ্ধতি এবং R/S পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। L এবং D নামকরণটি ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে: laeuvs (অর্থ বাম) এবং dextrus (অর্থ ডান)। আর R/S নামকরণও ল্যাটিন থেকে এসেছে: Rectus (অর্থ ডান) এবং Sinister (অর্থ বাম বা অশুভ)। তবে দুই পদ্ধতির নির্ধারণ প্রক্রিয়া ভিন্ন। L/D আদর্শ রেফারেন্স অণুর উপর ভিত্তি করে একটি আপেক্ষিক পদ্ধতি; R/S একটি পরম কনফিগারেশন পদ্ধতি। আণবিক ‘হ্যান্ডেডনেসে’র সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো একটি কার্বন পরমাণু, যার সাথে চারটি ভিন্ন গ্রুপ সংযুক্ত থাকে। এটি একটি সদর এলাকার কেন্দ্রের মতো, যার সাথে চারটি ভিন্ন ধাঁধার টুকরো সংযুক্ত থাকে। যদি এই টুকরোগুলো সব আলাদা হয়, তাহলে অণুটি কাইরাল হয়ে যায়। L/D পদ্ধতি গ্লিসারালডিহাইড (কাইরাল কেন্দ্রসহ সবচেয়ে সরল কার্বোহাইড্রেট)-এর সাথে কাইরাল অণুর কাঠামোগত সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। উদাহরণ: চিনি বা অ্যামাইনো অ্যাসিডের ক্ষেত্রে ফিশার প্রক্ষেপণে শীর্ষে অবস্থানকারী কার্বনিল গ্রুপ থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত কার্বনকে কাইরাল হিসেবে শনাক্ত করা হয়। ওই কাইরাল কার্বনের সাথে যদি হাইড্রক্সিল গ্রুপটি ডানদিকে থাকে তবে অণুটি L-, আর যদি বাম দিকে থাকে তবে অণুটি D-। অন্যদিকে, R/S পদ্ধতিতে কোন অণুতে যদি কাইরাল কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত গোষ্ঠীগুলোর অগ্রাধিকার ঘড়ির কাঁটার দিকে হ্রাস পায়, তাহলে কনফিগারেশনটি R হিসেবে নির্ধারিত হয়, যদি তারা ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে হ্রাস পায়, তাহলে তা S। যদিও এই শব্দগুলো বাম এবং ডান-এর ইঙ্গিত দেয়, তবু R/S লেবেল (থ্যালিডোমাইডের মতো গবেষণায় ব্যবহৃত) এবং L/D লেবেল (সাধারণত জৈব রসায়নে অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং শর্করার জন্য) স্বতন্ত্র এবং সাবধানে স্টেরিওকেমিক্যাল বিশ্লেষণ ছাড়া বিনিময় করা উচিত নয়।
কাইরাল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আরও কয়েকটি ওষুধের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: ডোপা (ডাইহাইড্রোক্সিফেনিল্যালানিন), পেনিসিলামাইন, মেথামফেটামিন এবং ইথামবুটল। এই যৌগগুলোর প্রতিটিরই কাইরাল সেন্টার রয়েছে, যার অর্থ এগুলো বিভিন্ন ইন্যানটিওমার হিসেবে বিদ্যমান থাকতে পারে এবং সে অনুযায়ী তাদের জৈবিক কার্যকলাপে তারতম্য ঘটতে পারে। L-ডোপা (L-ইন্যানটিওমার) হলো ডোপার বাম-হাতি রূপ এবং পার্কিনসন রোগের চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়; কিন্তু ডান-হাতি রূপ D-ডোপা (D-ইন্যানটিওমার) এর সম্ভাব্য বিষাক্ততার কারণে থেরাপিউটিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। D-পেনিসিলামাইন ভারী ধাতুগুলো চিলেট করা এবং ইমিউন সিস্টেমকে মডিউলেট করার ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় উইলসন রোগ এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়; এর L-ইন্যানটিওমার উচ্চ বিষাক্ততার সাথে যুক্ত এবং থেরাপিউটিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ওপর D-মেথামফেটামিনের উদ্দীপক প্রভাব রয়েছে এবং এটি মনোযোগ ঘাটতি হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার এবং স্থূলতার কিছু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়; আর L-মেথামফেটামিনের কেন্দ্রীয় প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল এবং এটি বন্ধ নাক খোলার জন্য ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ হিসেবে পাওয়া যায়। L-ইথাম্বুটল থেরাপিউটিকভাবে ব্যবহার করা হয় না, কারণ এটি চোখে বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে; কিন্তু D-ইথাম্বুটল ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরের সংশ্লেষণে বাধা দিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে, ফলশ্রুতিতে এটি কার্যকর যক্ষ্মা-বিরোধী ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুতরাং এই যৌগগুলোর থেরাপিউটিক প্রয়োগ তাদের ইন্যানটিওমারের নির্দিষ্ট ফর্মের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।
কাইরালিটি এমন কিছু নয় যা ওষুধের মতো আমরা কেবল ল্যাবরেটরিতে তৈরি করি। এটি প্রকৃতি জুড়ে পাওয়া যায়। আমিষ (প্রোটিন) ও শর্করা (কার্বোহাইড্রেট)-র কথা ধরা যাক। প্রোটিন গঠিত হয় অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে। ২০টি আদর্শ অ্যামাইনো অ্যাসিডের মধ্যে গ্লুটামিক অ্যাসিড একটি। যেহেতু শরীর প্রায় নিরপেক্ষ pH পরিবেশে থাকে, তাই গ্লুটামিক অ্যাসিড বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শরীরের ভেতরে গ্লুটামেট হিসেবে বিদ্যমান থাকে। গ্লুটামেট হলো গ্লুটামিক অ্যাসিডের ডিপ্রোটোনেটেড (আয়নযুক্ত) রূপ, যার অর্থ এটি তার কার্বক্সিল গ্রুপ থেকে একটি হাইড্রোজেন আয়ন (প্রোটন) হারিয়েছে। বস্তুত, গ্লুটামেটই গ্লুটামিক অ্যাসিডের কার্যকরী রূপ। গ্লুটামেট কাইরাল বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। এর দুটি ইন্যানটিওমার রয়েছে: L-গ্লুটামেট এবং D-গ্লুটামেট। মানবদেহে তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে পৃথক। L-গ্লুটামেট হলো জৈবিক প্রক্রিয়াগুলোর জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক রূপ এবং মানবদেহে প্রধানত এই রূপই থাকে। L-গ্লুটামেট বিপাকের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, নাইট্রোজেন ভারসাম্যে একটি মূল অণু হিসেবে এবং অন্যান্য অ্যামাইনো অ্যাসিড এবং বিপাক প্রক্রিয়ার পূর্বসূরি হিসেবে কাজ করে; মস্তিষ্কে প্রধান উত্তেজক নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে, যা সিনাপটিক ট্রান্সমিশন এবং স্নায়ু যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে D-গ্লুটামেট সাধারণত প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না এবং এর জৈবিক তাৎপর্য সীমিত। সাধারণত মানুষের এনজাইম দ্বারা বিপাকিত হয় না, কারণ আমাদের বিপাকীয় যন্ত্রপাতি L-ফর্মের জন্য স্টেরিওস্পেসিফিক। তবে D-গ্লুটামেট ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরের একটি স্বাভাবিক উপাদান (পেপটিডোগ্লাইকেন কাঠামোর অংশ হিসেবে)। মানবদেহে যখন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হয়, তখন তাদের কোষপ্রাচীরের টুকরোগুলো নির্গত হতে পারে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই টুকরোগুলো বিদেশি (প্যাথোজেন-সম্পর্কিত আণবিক প্যাটার্ন, বা PAMPs) হিসেবে চিহ্নিত করে, যা প্রদাহ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। শরীর কীভাবে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই প্রতিক্রিয়া তার একটি অংশ। সুতরাং, D-গ্লুটামেট মানবদেহে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির একটি চিহ্নিতকারী বটে, কিন্তু এটি নিজে কোন রোগ সৃষ্টিকারী পদার্থ নয়।
শর্করার উদাহরণে আসি। যেমন চিনি একটি কাইরাল খাদ্য অণু যা ২টি আকারে বিদ্যমান থাকতে পারে: L-চিনি (Levorotatory বা বাম-হাতি চিনি) এবং D-চিনি (Dextrorotatory বা ডান-হাতি চিনি)। চিনির এই 'হ্যান্ডেডনেস' এর কারণেই আমরা কিছু চিনি হজম করতে পারি, কিন্তু অন্যগুলো হজম করতে পারি না। D-চিনির উদাহরণ: ডি-গ্লুকোজ, ডি-ফ্রুক্টোজ, ডি-গ্যালাকটোজ। এল-চিনির উদাহরণ: এল-ফ্রুক্টোজ, এল-গ্যালাকটোজ। প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত বেশিরভাগ চিনি হচ্ছে D-চিনি অর্থাৎ ডান-হাতি; অ্যামাইনো অ্যাসিডের বিপরীত। L-চিনি প্রকৃতিতে বিরল, কিন্তু কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষিত হতে পারে। ডি-গ্লুকোজ হলো শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক জ্বালানি। আমাদের শরীর শক্তির জন্য যে গ্লুকোজ ব্যবহার করতে পারে তা মূলত D-গ্লুকোজ। কেন শরীর ডি-চিনি পছন্দ করে? এক কথায় উত্তর হচ্ছে- এনজাইমের নির্দিষ্টতা। আমাদের পরিপাকতন্ত্রের এনজাইমগুলো বিশেষায়িত কাজে নিয়োজিত থাকে; এনজাইম বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় খাদ্য অণুতে নির্দিষ্ট ধরনের রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে ফেলতে পারে। পাচক এনজাইম (যেমন: হেক্সোকিনেজ, অ্যামাইলেজ) বিশেষভাবে গ্লুকোজের D-রূপটি শনাক্ত করা এবং ভেঙে ফেলার জন্য ডিজাইন করা। যার কারণে আমরা এগুলো সহজেই হজম করতে পারি। অপরদিকে, L-চিনি বেশিরভাগ এনজাইম দ্বারা স্বীকৃত হয় না, তাই তারা শক্তি উৎপাদনের জন্য বিপাকিত হতে পারে না এবং D-চিনির মতো রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে না। তাহলে কি ডায়াবেটিস রোগ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কৃত্রিম চিনি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা কি L-চিনি (যেমন, L-ফ্রুক্টোজ)। উত্তর হচ্ছে, না, তা নয়। বেশিরভাগ ডায়াবেটিস-বান্ধব খাবার এবং পানীয়তে যেসব কৃত্রিম বা প্রাকৃতিক মিষ্টি ব্যবহার করা হয়, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র সুক্রলোজ চিনি থেকে তৈরি করা হয় (সুক্রোজের রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত সংস্করণ থেকে), অন্যগুলো এমনকি চিনিও নয়। যেমন: অ্যাসপার্টেম পেপটাইড বেইজড, স্যাকারিন সালফার বেইজড, স্টেভিয়া উদ্ভিদ-ভিত্তিক। এগুলো সুলভে পাওয়া যায় এবং সাধারণত চিনি-মুক্ত ক্যান্ডি, ডায়েট কোক-সোডা এবং ডায়াবেটিক স্ন্যাক্সে ব্যবহৃত হচ্ছে। L-চিনি কম ক্যালোরিযুক্ত কৃত্রিম চিনি হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত না হওয়ার প্রধান কারণ এর উচ্চ উৎপাদন ব্যয়। এখন পর্যন্ত L-চিনির ব্যবহার ল্যাবরেটরি গবেষণায় সীমিত আছে। ইনসুলিন প্রতিক্রিয়া ট্রিগার না করেই গ্লুকোজ বিপাক অধ্যয়নের জন্য কখনও কখনও গবেষণায় L-গ্লুকোজ ব্যবহার করা হয়। অন্ত্রে শর্করা কীভাবে শোষিত হয় তা অধ্যয়ন করতে L-চিনি গবেষকদের সহায়তা করে। কিডনি কীভাবে অশোষিত শর্করা প্রক্রিয়াজাত করে তা ট্র্যাক করার জন্য L-গ্লুকোজের ব্যবহার রয়েছে। তবে উৎপাদন খরচ কমে গেলে ভবিষ্যতে L-চিনি কম-ক্যালোরির মিষ্টি হিসেবে আহার্য হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাছে।
ওষুধ ছাড়াও মানুষের জন্য কল্যাণমূলক বিবিধ পণ্য তৈরিতে কাইরালিটির ভূমিকা রয়েছে। আমরা কীভাবে স্বাদ এবং সুগন্ধ উপলব্ধি করি তাতে কাইরালিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই অণুর দুটি ইন্যানটিওমারের গন্ধ এবং স্বাদ নাটকীয়ভাবে ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট অণুর একটি ইন্যানটিওমার লেবুর মতো গন্ধ পেতে পারে, অন্যটির গন্ধ কমলার মতো হতে পারে। খাদ্য বিজ্ঞানীরা খাদ্যপণ্যে নির্দিষ্ট স্বাদ তৈরি বা উন্নত করার জন্য এই জ্ঞান ব্যবহার করেন। কিছু কৃত্রিম মিষ্টি কাইরাল। কাইরালিটি বোঝার মাধ্যমে এমন মিষ্টি তৈরি করা সম্ভব হয় যা তীব্র মিষ্টি, কিন্তু কিছু পূর্ববর্তী মিষ্টির মতো অবাঞ্ছিত আফটারটেস্ট থাকে না। কৃষিকাজে ব্যবহৃত অনেক কীটনাশক কাইরাল অণু। মানুষের ওষুধের মতো কীটনাশকের একটি ইন্যানটিওমার কীটপতঙ্গ নিধনে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে, অন্যদিকে অন্যটি পরিবেশের জন্য কম কার্যকর বা এমনকি ক্ষতিকারকও হতে পারে। বিজ্ঞানীরা সক্রিয় ইন্যানটিওমার সমৃদ্ধ কীটনাশক তৈরি করতে কাইরাল সংশ্লেষণ ব্যবহার করেন, যা তাদের আরও কার্যকর করে এবং প্রয়োজনের পরিমাণ হ্রাস করে, ফলে পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস পায়। ভেষজনাশকও কাইরাল হতে পারে। কাইরাল হার্বিসাইড তৈরির ফলে লক্ষ্যবস্তু আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, যা ফসল বা আশেপাশের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতির ঝুঁকি হ্রাস করে। টিভি এবং স্মার্টফোনের মতো ইলেকট্রনিক্সের ডিসপ্লেতে ব্যবহৃত তরল স্ফটিক কাইরাল হতে পারে। অণুগুলোর কাইরালিটি তরল স্ফটিকগুলো কীভাবে সারিবদ্ধ হয় এবং আলোর সাথে মিথস্ক্রিয়া করে তা প্রভাবিত করে, যা পরিষ্কার এবং প্রাণবন্ত প্রদর্শন তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু পলিমার, পুনরাবৃত্তিমূলক একক দিয়ে তৈরি বৃহৎ অণু, কাইরাল হতে পারে। পলিমার চেইনের কাইরালিটি উপাদানের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রভাবিত করতে পারে, যেমন এর শক্তি, নমনীয়তা এবং এটি কীভাবে আলোর সাথে মিথস্ক্রিয়া করে।
প্রাণিজগতে মানুষই একমাত্র কাইরাল প্রাণী নয়, আরও কিছু প্রাণীর কাইরাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অন্যান্য প্রাণীও আছে যারা হাতের ব্যবহার প্রদর্শন করে, যদিও এটি মানুষের মতো ঠিক একই রকম নাও হতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ: শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাংওটানসহ অনেক প্রাইমেট নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য এক হাতের উপর অন্য হাত ব্যবহার করতে পছন্দ করে, যেমন খাবারের জন্য হাত তোলা বা সাজসজ্জা করা। বিড়াল এবং কুকুরও এক থাবার উপর অন্য থাবা ব্যবহার করতে পছন্দ করে, যদিও জনসংখ্যার দিক থেকে মানুষের মতো ডান-হাতি বা বাম-হাতি পছন্দ করা হয় বলে মনে হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে যে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী, যেমন ইঁদুর এবং ঘোড়া, তাদের আচরণে পার্শ্বীয় পক্ষপাত প্রদর্শন করে। কিছু ব্যাঙেরও এক পার চেয়ে অন্য পা ব্যবহার করতে পছন্দ করা হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ করা গেছে। তোতাপাখির মতো কিছু পাখিরও কিছু কাজের জন্য এক পার চেয়ে অন্য পা ব্যবহার করতে পছন্দ করা হয়েছে বলে দেখা গেছে। এমনকি কিছু প্রমাণ রয়েছে যে উদ্ভিদ অন্যান্য উপায়ে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে পারে, যেমন তাদের বৃদ্ধির দিক বা তাদের পাতার বিন্যাস।
ফরাসি রসায়নবিদ এবং মাইক্রোবায়োলজিস্ট লুই পাস্তুর কাইরালিটির আবিষ্কারের কৃতিত্বের অধিকারী, যিনি জীবাণু তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য, টিকা তৈরি করার জন্য এবং পাস্তুরাইজেশন আবিষ্কার করার জন্য জগদ্বিখ্যাত। ১৮৪৮ সালে পাস্তুরের কাইরালিটি আবিষ্কারের পেছনের ঘটনা এমন- তিনি আসলে মাইক্রোস্কোপের নিচে টারটারিক অ্যাসিডের স্ফটিক অধ্যয়ন করছিলেন, যখন তিনি লক্ষ্য করলেন যে এগুলো দুটি স্বতন্ত্র আকারে আসে, একে অপরের প্রতিচ্ছবি, ডান হাত বাম হাতের মতো। এই পর্যবেক্ষণ তার কৌতূহলো জাগিয়ে তোলে এবং তিনি টুইজার ব্যবহার করে সাবধানতার সাথে দুই ধরনের স্ফটিককে পৃথক করেন। এরপর তিনি প্রতিটি স্ফটিককে জলে দ্রবীভূত করেন এবং তাদের মধ্য দিয়ে মেরুকৃত আলো ছড়িয়ে দেন। তিনি দেখতে পান যে স্ফটিকগুলোর একটি রূপ আলোকে ডানদিকে বাঁকিয়ে দিছে, আর আয়নার চিত্ররূপটি আলোকে বাম দিকে বাঁকিয়ে দিছে। ফলে তিনি প্রস্তাব করেন যে টারটারিক অ্যাসিডের অণুগুলো নিজেই কাইরাল, যা সেই সময়ে একটি বিপ্লবাত্মক ধারণা ছিল। পাস্তুরের কাইরালিটি আবিষ্কার রসায়নে একটি বড় অগ্রগতি ছিল এবং স্টেরিওকেমিস্ট্রি, অণুতে পরমাণুর ত্রিমাত্রিক বিন্যাস বোঝার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
জাপানি বিজ্ঞানী রিওজি নয়োরি, মার্কিন বিজ্ঞানী উইলিয়াম এস. নোলস এবং কে. ব্যারি শার্পলেস কাইরাল বিষয়ক গবেষণার জন্য ২০০১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তারা তিনজন মূলত কাইরাল অনুঘটক-এর ভূমিকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। কাইরাল অনুঘটকর এমন অণু যা রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং নিশ্চিত করে যে বিক্রিয়াটি প্রাথমিকভাবে কাঙ্ক্ষিত অণুর একটি নির্দিষ্ট ‘হ্যান্ডেডনেস’ তৈরি করেছে। লেগো দিয়ে একটি জটিল কাঠামো নির্মাণ করার সময় এটা নিশ্চিত করতে হয় যে সব অংশ খুব নির্দিষ্ট উপায়ে কেন্দ্রীভূত। কাইরাল অনুঘটকগুলো বিশেষায়িত তেমন সরঞ্জামের মতো যা প্রতিবার সঠিক ‘হ্যান্ডেডনেস’ দিয়ে সেই অংশগুলো একত্রিত করতে সাহায্য করে, প্রক্রিয়াটিকে আরও দক্ষ এবং সুনির্দিষ্ট করে তোলে। নোলস কাইরাল হাইড্রোজেনেশনের বিকাশের পথিকৃৎ ছিলেন। নয়োরি নোলসের কাজের ওপর ভিত্তি করে কাইরাল হাইড্রোজেনেশনের জন্য আরও কার্যকর কাইরাল অনুঘটক তৈরি করেছিলেন। তার কাজ কাইরাল অনুঘটকের পরিধি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত করেছিল। শার্পলেস কাইরাল জারণ নামক একটি ভিন্ন ধরনের বিক্রিয়ার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি এমন অনুঘটক তৈরি করেছিলেন যা অণুতে অক্সিজেন পরমাণু নির্বাচনীভাবে যুক্ত করতে পারে, আবার একটি নির্দিষ্ট কাইরাল ফর্মও গঠন করতে পারে। তাদের কাজ বিভিন্ন শিল্পের উপর গভীর প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে ওষুধের উন্নয়নে, যেখানে একটি অণুর ‘হাতের ব্যবহার’ জীবন বা মৃত্যুর বিষয় হতে পারে। যার ফলে অধিক দক্ষতার সাথে ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে এবং অবাঞ্ছিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানো সম্ভব হয়েছে।
এখন, শুরুতে যে উল্লেখ করেছিলাম শৈশবে আমার ডান বা বাম দিক দ্রুত শনাক্ত করতে সমস্যা হতো তাকে কাইরালিটিজনিত সমস্যা বলা যায় কী না? উত্তর হচ্ছে, না, একে কাইরালিটির সমস্যা বলা যায় না। ডান বা বাম দিক শনাক্তজনিত সমস্যাটি ব্যক্তির স্থানিক সচেতনতা (চারপাশের বিশ্বকে বোঝার এবং তার সাথে মিথস্ক্রিয়া করার ক্ষমতা), বডি স্কিমা (মহাকাশে নিজের শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রতিনিধিত্ব), মনোযোগের অভাব বা চিত্তবিক্ষিপ্ততা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা বাম-ডান বৈষম্যের সাথে বেশি সম্পর্কিত। ডান থেকে বাম পার্থক্য করার এই ক্ষমতা একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার মধ্যে মস্তিষ্কের একাধিক অংশ একসাথে কাজ করে। আমরা আমাদের পরিবেশ (যেমন: চাক্ষুষ সংকেত, শারীরিক সংবেদন) এবং শারীরিক অবস্থানের অভ্যন্তরীণ অনুভূতি থেকে সংবেদনশীল তথ্য পায়। মস্তিষ্কের উপরে এবং পেছনে অবস্থিত প্যারাইটাল লোব এই তথ্যকে একীভূত করে এবং মহাকাশে আমাদের শরীরের মানসিক উপস্থাপনা এবং পরিবেশের সাথে এর সম্পর্ক স্থাপন করে স্থানিক সচেতনতা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ডান প্যারাইটাল লোব, ডান এবং বামের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মস্তিষ্কের সামনের দিকে অবস্থিত ফ্রন্টাল লোব ডান এবং বাম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে এই স্থানিক তথ্য ব্যবহার করে (প্রায়শই শেখা নিয়ম বা কৌশলের উপর নির্ভর করে)। মস্তিষ্কের পেছনে ও নীচে অবস্থিত সেরিবেলাম স্থানিক সচেতনতা এবং শরীরের অবস্থানের অনুভূতিতে অবদান রাখে, যা পরোক্ষভাবে ডান/বাম বৈষম্যকে সমর্থন করে। যদি মোটর আউটপুট (শারীরিক ক্রিয়া)-এর প্রয়োজন হয় (যেমন, বাম বা ডানে ঘুরানো), তখন মস্তিষ্ক পেশিগুলো নড়াচড়া সম্পাদনের জন্য সংকেত পাঠায়। কাইরালিটি রসায়ন, পদার্থ এবং জীববিজ্ঞানের একটি বিমূর্ত ধারণা, যা অণুর অন্তর্নিহিত অসামঞ্জস্যকে বোঝায়; এটি ব্যক্তির স্থানিক যুক্তি ক্ষমতা বিষয়ক নয়।
এবারে প্রশ্ন হচ্ছে কেউ ডানহাতি, কেউ বামহাতি, কেউ উভয়হাতি বা সব্যসাচী হওয়ার কারণ কাইরালিটি কি না? উত্তর হচ্ছে, না, এটিও কাইরালিটিজনিত বিষয় নয়। মানুষের মস্তিষ্কের দুটি দিক বা গোলার্ধ রয়েছে: বাম এবং ডান। প্রতিটি গোলার্ধ শরীরের বিপরীত দিক নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং, মস্তিষ্কের বাম দিক ডান হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মস্তিষ্কের ডান দিক বাম হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে। বেশিরভাগ মানুষের জন্য মস্তিষ্কের এক দিক নির্দিষ্ট কাজের জন্য ‘প্রধান’। এর অর্থ হলো এই কার্যকলাপের ক্ষেত্রে এটি আরও সক্রিয় এবং নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডানহাতিদের জন্য মস্তিষ্কের বাম দিক সাধারণত হাত নিয়ন্ত্রণ, ভাষা এবং অন্যান্য কাজের জন্য প্রাধান্য পায়। বামহাতিদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ডান দিকটি সাধারণত হাত নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাধান্য পায়। মস্তিষ্কের কোনো এক গোলার্ধের আধিপত্য খুব তাড়াতাড়ি, এমনকি জন্মের আগেই বিকশিত হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এটি বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে-
জিন: বাবা-মায়ের কাছ থেকে ডান-বা বাম-হাতি হওয়ার প্রবণতা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া;
পরিবেশ: গর্ভে অবস্থান বা শৈশবকালে অভিজ্ঞতার মতো বিষয়গুলোর ভূমিকা;
এলোমেলো সম্ভাবনা: কখনও কখনও এটি কেবল সুযোগের বিষয় হতে পারে যে, মস্তিষ্কের কোন দিকটি প্রাধান্য পাবে। হাতের আধিপত্য মস্তিষ্কের আধিপত্যের একটি উদাহরণ মাত্র। এটি অন্যান্য বিষয়গুলোও প্রভাবিত করতে পারে, যেমন কেউ কোন পা দিয়ে বল লাথি মারতে পছন্দ করেন বা কোন চোখ ব্যবহার করে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখেন। অর্থাৎ মস্তিষ্ক দুজন খেলোয়াড় নিয়ে গড়া একটি দলের মতো। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ‘বাম-মস্তিষ্কের খেলোয়াড়’ শক্তিশালী এবং সে ডান হাত নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব নেয়। কিন্তু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ‘ডান-মস্তিষ্কের খেলোয়াড়’ শক্তিশালী এবং সে বাম হাতের জন্য নেতৃত্ব নেয়। এই ‘খেলোয়াড়ের পছন্দ’কেই আমরা কে কোন ‘হাতি’ সেটা বলি।
আবার কিছু মানুষ উভয় হাত সমানভাবে ব্যবহার করতে পারে, যাদের সব্যসাচী বলে। এর অর্থ হলো তাদের মস্তিষ্কে কোনো এক গোলার্ধের আধিপত্য কম স্পষ্ট অথবা তারা উভয় গোলার্ধে দক্ষতা অর্জন করেছে। আবার ক্রিকেটে দেখা যায় কিছু খেলোয়াড় আছেন যারা বাম হাতে বল করেন কিন্তু ডান হাতে ব্যাট করেন এবং বিপরীতভাবেও ঘটে। এটিকে বলা হয় ক্রস-ডোমিন্যান্স বা মিশ্র-হ্যান্ডেডনেস। ডান হাতে ব্যাটিং করা কিন্তু বাম হাতে বোলিং করার জন্য ওয়াসিম আকরাম, শেন ওয়ার্ন, শন পোলক, মাইকেল বেভান, মিচেল স্টার্কের মতো খেলোয়াড়রা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বিপরীতভাবে, বাম হাতি ব্যাটসমান কিন্তু ডান হাতি বোলার হিসেবে সৌরভ গাঙ্গুলি, শিখর ধাওয়ান, ব্রায়ান লারা, বেন স্টোকস, ডেভিড ওয়ার্নারের নাম নেওয়া যেতে পারে। কেন এমন ঘটে? একজন খেলোয়াড় শুরুতে ব্যাটিংয়ে এক হাতের জন্য পছন্দ বা শক্তি এবং পরে বোলিং করার জন্য আলাদা হাত তৈরি করতে পারে, যা কোচিং, স্বাভাবিক যোগ্যতা বা এমনকি সুযোগের উপর ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে। আবার খেলোয়াড়রা বিশেষজ্ঞ হওয়ার সাথে সাথে তাদের কৌশলগুলো আরও পরিমার্জন করে। এর ফলে একটি নির্দিষ্ট হাতের জন্য একটি বিশেষ পছন্দের প্রবণতা তৈরি হতে পারে, এমনকি যদি তারা অন্য হাতটি ব্যবহার করতে পারে তবুও। কখনও কখনও একজন খেলোয়াড় কৌশলগত কারণে, যেমন বৈচিত্র্য তৈরি করা বা ব্যাটসম্যানদের অবাক করার জন্য তাদের অ-প্রভাবশালী হাত দিয়ে বোলিং করতে পছন্দ করতে পারে।
শিল্পকলা, বিজ্ঞান, এমনকি রাজনীতি যাই হোক না কেন, উভয় হাত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করার ক্ষমতা একটি অনন্য সম্পদ হতে পারে। চিত্রকর, বিজ্ঞানী, বহুবিদ্বান লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বাম হাতে আয়না লিপিতে লিখতেন, তবে ডান হাতেও দক্ষ ছিলেন। সব্যসাচীর কাতারে আরও যারা চলে আসবেন তারা হলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, মিডিয়া মোগল অপরাহ উইনফ্রে (আংশিক), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জেমস এ. গারফিল্ড, বারাক ওবামা (আংশিক), আধুনিক বিকল্প কারেন্ট (এসি) বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নকশা জন্য বিখ্যাত নিকোলা টেসলা প্রমুখ। কিংবদন্তি পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন সব্যসাচী ছিলেন বলে শোনা যায়, তবে এটি নিশ্চিত করা যায়নি। রাসায়নিক জগতেও এমন অণু আছে যারা অ্যাম্বিডেক্সটেরিটি প্রদর্শন করে, যদিও এটি একটি বিরল ঘটনা। এই অণুগুলো, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, বাম-হাতি এবং ডান-হাতি উভয় ধরনের হেলিকাল কনফার্মেশন গ্রহণ করতে পারে। এই ধরনের অণুর একটি উদাহরণ হলো নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিড অবশিষ্টাংশ দ্বারা গঠিত একটি পেপটাইড। এই পেপটাইডগুলো হেলিকাল স্ট্রাকচার তৈরি করতে পারে এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে, তারা বাম-হাতি বা ডান-হাতি দিকে মোচড় দিতে পারে।
রাজনীতিতে বামপন্থী এবং ডানপন্থী-এই দুটি পরিভাষা বেশ আলোচিত। শব্দ দুটির উৎপত্তি ফরাসি বিপ্লবের সময় ফরাসি জাতীয় পরিষদে আসন বিন্যাস থেকে। ১৭৮৯ সালে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লব জাতীয় পরিষদ গঠনের দিকে পরিচালিত করে, যেখানে সদস্যরা একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য একত্রিত হন। ফরাসি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত নিয়ে সমাবেশটি বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিল। রাজতন্ত্র এবং অভিজাতদের সমর্থকরা অ্যাসেম্বলি হলের ডান পাশে বসতেন। তাদের সাধারণত অধিক রক্ষণশীল বলে মনে করা হতো এবং তারা ঐতিহ্যবাহী সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার পক্ষে ছিলেন। বিপ্লব এবং আরও আমূল পরিবর্তনের সমর্থকরা বাম পাশে বসতেন। তাদের সাধারণত আরও উদারপন্থী বলে মনে করা হতো এবং তারা বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতার পক্ষে ছিলেন। সময়ের সাথে সাথে ‘বাম’ এবং ‘ডান’ শব্দ দুটি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং অবস্থান বর্ণনা করার জন্য সংক্ষিপ্ত রূপে পরিণত হয়। বামপন্থীরা সাধারণত এমন মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে যা সামাজিক সমতা, অগ্রগতি এবং অর্থনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপের ওপর জোর দেয়, যা কমিউনিজম বা সোশ্যালিজমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা প্রায়শই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা জাল এবং পরিবেশগত সুরক্ষার মতো নীতির পক্ষে কথা বলে। ডানপন্থীরা সাধারণত এমন মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে যা ব্যক্তি স্বাধীনতা, সীমিত সরকারি হস্তক্ষেপ এবং ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের ওপর জোর দেয়। তারা প্রায়শই মুক্ত বাজার এবং শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষার মতো নীতির পক্ষে কথা বলে। আবার কিছু কিছু দেশে ডানপন্থী বা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সাথে চরম বা উগ্র জাতীয়তাবাদের সংযোগ পরিলক্ষিত হছে।
ধাঁধা: আমাদের শরীরের কোন অঙ্গ/প্রত্যঙ্গ আমরা বাম হাত দিয়ে ধরতে পারি, কিন্তু ডান হাত দিয়ে ধরতে পারি না?
উত্তর: একটু পর।
বাংলা ভাষায় ডান হাতকে দক্ষিণ হাত বলা হয়। এর পেছনে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত কারণ বিদ্যমান। সংস্কৃতে দক্ষিণ মানে কেবল দক্ষিণ দিকই নয়, বরং কুশল বা সঠিক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তাই, দক্ষিণ হাত বলতে মূলত দক্ষ বা সঠিক হাতকেই বোঝানো হয়, যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ ডানহাতি এবং এই হাতকেই প্রধান হাত ধরা হয়। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে এবং হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, ডান হাতকে শুভ ও পবিত্র ধরা হতো, কারণ এটি খাওয়া, আচার-অনুষ্ঠান ও শুভ কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়; দক্ষিণা শব্দও এই ধারণা থেকে এসেছে, যার অর্থ কিছু প্রদান বা উপহার; ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী একলব্য দ্রোণাচার্যকে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি গুরুদক্ষিণা দিয়েছিলেন। কারও সাথে ডান হাত দিয়ে দেওয়া-নেওয়া করা বাঙালি মুসলমান সমাজের শিষ্টাচার। সংস্কৃতের শাখা ভাষাগুলোয় (যেমন, হিন্দি, মারাঠি, ওড়িয়া) ডান হাতকে দক্ষিণ হাত বলা হয়, কিন্তু বাম হাতের জন্য নির্দিষ্ট দিকনাম নেই। তবে বাম হাতের ভাবগত নেতিবাচকতা রয়েছে। বাম শব্দের অর্থ অশুভসূচক, প্রতিকূল, বাঁকা। যেমন: বিধি বাম (বিধি অনুকূলে না থাকা), বাঁ হাতের কাজ/ব্যাপার (ঘুষ খাওয়া) ইত্যাদি। আবার ডান হাতের ব্যাপার বাগধারাটির অর্থ আহার করা। মজার ব্যাপার, বাম শব্দের একটি অর্থ ‘সুন্দর’, যেমন: বামলোচনা/বামাক্ষী অর্থ যে নারীর চোখ সুন্দর, বামস্বভাবা অর্থ যে নারীর স্বভাব সুন্দর। বাঁহাতিদের নিয়ে একটি দিবসও আছে।
১৩ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস। ১৯৭৬ সালে ডি আর ক্যাম্পবেল দিবসটি প্রথম পালন করেন। তিনি লেফট হ্যান্ডার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। ডানহাতিদের দুনিয়ায় বাঁহাতি হওয়ার সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতেই দিনটি উদযাপন করা হয়। দুই হাত নিয়ে আলোচনা হলো, তৃতীয় হাত নিয়ে কোন কথা হলো না, যেটি আবিষ্কার করেছিলেন অমর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের তিনটি হাত, বাম হাত, ডান হাত আর অজুহাত। মানুষ ডান হাত বা বাম হাত কোনোটাই ব্যবহার করে না কিন্তু অজুহাত ব্যবহার করে।’
ধাঁধার উত্তর: ডান হাত।
হাতে লাঠি জাতীয় জিনিস দিয়ে খেলতে হয় এমন কয়েকটি খেলা হচ্ছে- হকি, ক্রিকেট, বেইজবল, ব্যাডমিন্টন, লন টেনিস, টেবিল টেনিস, গল্ফ। এগুলির মধ্যে গল্ফ ছাড়া সব খেলাতে ডানহাতি বামহাতি সকলের জন্য একই হাতিয়ার (স্টিক/ব্যাট); কেবল গল্ফে ডানহাতি বামহাতির জন্য আলাদা হাতিয়ার, যাকে বলে ‘ক্লাব’ (গল্ফ স্টিক)। তো, স্বামী-স্ত্রী গল্ফ খেলছিলেন, হঠাৎ স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সোনা, আমি মারা গেলে তুমি কি আবার বিয়ে করবে?’ স্বামী বললেন, ‘না প্রিয়তমা।’ স্ত্রী বললেন, ‘আমি নিশ্চিত তুমি করবে।’ তাই স্বামী বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি করব’। তারপর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি তাকে আমাদের বিছানায় ঘুমাতে দেবে?’ এবং স্বামী উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমার মনে হয়।’ তারপর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি তাকে আমার গল্ফ ক্লাব ব্যবহার করতে দেবে?’ এবং স্বামী উত্তর দিল, ‘না, সে তো বাম হাতি।’
বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ ।। জনস্বাস্থ্য ও হাসপাতাল প্রশাসন বিশেষজ্ঞ, গীতিকার ও প্রবন্ধকার
baizid.romana@gmail.com