করোনাভাইরাসের প্রেক্ষিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাত। মূলত করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি অর্থবছরেই বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় প্রস্তাবিত বাজেটেও এ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে—চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ যেখানে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১২.৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা যা অবশ্যই ইতিবাচক।

তবে শুধুমাত্র অর্থের বিবেচনায় বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও, এ বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৭.৮ শতাংশ ও উন্নয়ন বাজেটের ৫.৮ শতাংশ- সার্বিক বিবেচনায় বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বরাদ্দ বেড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে (১) বয়স্ক ভাতা (মোট বরাদ্দ বেড়েছে ৪৮১ কোটি টাকা), যার আওতায় সহায়তা পাবেন অতিরিক্ত ৮ লাখ মানুষ; (২) বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা (মোট বরাদ্দ বেড়েছে ২৫৫ কোটি টাকা) এবং এক্ষেত্রে সহায়তা পাবেন আরও ৪ লাখ ২৫ হাজার নারী; (৩) প্রতিবন্ধী ভাতায় মোট বরাদ্দ বাড়বে ২০০ কোটি টাকা যেখানে অতিরিক্ত ২ লাখ ৮ হাজার প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সহায়তার আওতায় আসবেন।

উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন প্রস্তাবনা করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা ভাতার ক্ষেত্রে এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু ১২ হাজার টাকা থেকে বেড়ে প্রস্তাবিত বাজেটে মাসিক বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০ হাজার টাকা এবং এর ফলে এ ভাতায় মোট বরাদ্দ বাড়বে ১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এছাড়া বয়স্ক ও বিধবা ভাতার ক্ষেত্রে ১১২টি উপজেলার সাথে আরও ১৫০টি উপজেলায় শতভাগ বয়স্ক/বিধবা মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

সুবিধাভোগীর আওতা বাড়লেও, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ খাতেই মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়েনি।

মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ভিন্ন দুটি কার্যক্রমের অধীনে ৯২ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে এবং করোনাকালীন নিম্ন আয়ের ৩৫ লাখ মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তাও দেওয়া হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়ক হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে বিশেষ করে এই করোনাকালীন কাজ হারানো মানুষকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে ও কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন বড় কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে মোট বরাদ্দ ও সুবিধাভোগীর বৃদ্ধি সার্বিকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে বেশকিছু বিষয়ে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে করোনা পরিস্থিতিকে বিবেচনায় এনে বরাদ্দ বিবেচনা করা হয়নি।

প্রথমত, বিভিন্ন গবেষণায় যদিও উঠে এসেছে যে, করোনা মহামারির কারণে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষই আয় হারিয়ে কিংবা বেকার হয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন দরিদ্রদের কেন্দ্র করে কোনো নতুন কর্মসূচি কিংবা বরাদ্দের প্রস্তাবনা নেই।

দ্বিতীয়ত, শহরাঞ্চলের দরিদ্র কিংবা বস্তিবাসীদের জন্য বাজেট বক্তৃতায় বরাদ্দ কিংবা কর্মসূচির বিবেচনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না, যেটি কি না বিশেষ করে শহরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় জরুরি ছিল।

তৃতীয়ত, সুবিধাভোগীর আওতা বাড়লেও, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়া অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ খাতেই মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়েনি। অথচ, এমনকি জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেটি কি না সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্য সবচাইতে প্রাসঙ্গিক সরকারি দলিল, সেটির প্রস্তাবনা বিবেচনায় আনলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এনেও প্রয়োজনের আঙ্গিকে বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতেই মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাবনা ছিল।

চতুর্থত, সার্বিকভাবে টাকার অনুপাতে ও মোট বাজেটের শতকরা হার বিবেচনায় ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়লেও চলতি অর্থবছরের মতো এ বাজেটেও পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ও স্কুল ভাতা কর্মসূচি বাবদ একটি বড় বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যে বরাদ্দের আওতায় অনেকক্ষেত্রেই নিম্ন আয়ের মানুষেরা পড়ছেন না।

প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট বরাদ্দ ধরা হয়েছে মোট বাজেটের ১৭.৮ শতাংশ কিন্তু এই তিনটি খাত বাদ দিলে শতাংশের হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ দাঁড়ায় বাজেটের ১১.৫ শতাংশ।

করোনাকালীন কাজ হারানো মানুষকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে ও কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন বড় কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি না।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে বিশেষ করে এই করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে কয়েকটি দিক বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল, যার মধ্যে নতুন দরিদ্র ও শহরাঞ্চলের দরিদ্রদের এই কর্মসূচির আওতায় আনার পাশাপাশি, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া আবশ্যক ছিল।

এছাড়া জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের (এনএসএসএস) দ্রুত বাস্তবায়ন ও এক্ষেত্রে বর্ণিত জীবন-চক্র পদ্ধতির মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়কে ঢেলে সাজানোর দরকার রয়েছে এবং এ ব্যাপারে দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তবে মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর সুফল পাওয়ার জন্য সবচাইতে জরুরি হচ্ছে দরিদ্র (নতুন দরিদ্রসহ) জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এবং সে প্রেক্ষিতে জরুরি ভিত্তিতে একটি ডিজিটাল তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা।

বস্তি অঞ্চলে ও গ্রামাঞ্চলে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে খাত ভিত্তিক/শিল্পভিত্তিক এবং এলাকাভিত্তিক পর্যায়ে, প্রয়োজনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এনজিওর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া সরকারের জিটুপি পদ্ধতির কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা আনা যেতে পারে—এই পদ্ধতির আওতায় সামাজিক নিরাপত্তার সকল কর্মসূচিকে আনতে হবে।

পরিশেষে যেটি দেখা প্রয়োজন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য যেন, শুধুমাত্র অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে আপদকালীন সহায়তা দেওয়া নয়, বরং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষদেরকে স্বনির্ভর করে তোলা।

ড. সায়মা হক বিদিশা ।। অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়