স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট যত পেশা আছে তার মধ্যে ফার্মাসিস্ট অন্যতম। এটি একটি প্রাচীন ও সুপ্রতিষ্ঠিত পেশা। রোমের বিখ্যাত চিকিৎসক ও দার্শনিক গ্যালেনের (খ্রিস্টপূর্ব ১২৯-২১৬) মাধ্যমে ওষুধবিদ্যা তথা ফার্মেসির সূচনা হয়, তাই গ্যালেনকে বিশ্বের প্রথম ফার্মাসিস্ট ও ফার্মেসির জনকও বলা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সময়ে ওষুধ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা ও ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ওষুধের দ্রুত বিস্তারের ফলে ফার্মাসিস্টদের কাজের ধরনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ফার্মেসি শিক্ষা ওষুধ প্রস্তুতি থেকে সরে এসে ক্রমান্বয়ে রোগীকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।

উন্নত বিশ্বে ফার্মাসিস্টদের কাজের ধরণ দেখলে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশন (FIP) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ও ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্টিস্টের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ।

বিশাল সংখ্যক ফার্মাসিস্টদের প্রায় অর্ধেক (৫০-৬০ শতাংশ) কাজ করেন কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট হিসেবে, ৩০-৪০ শতাংশ কাজ করেন ক্লিনিক্যাল এবং হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে, ৫-১০ শতাংশ কাজ করেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মাসিস্ট হিসেবে, প্রায় ৫ শতাংশ শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে এবং বাকিরা বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন।

সম্প্রতি আমাদের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২২ হাজার গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মাসিস্ট। আমাদের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেশের মাত্র ১-২ শতাংশ ফার্মাসিস্ট কাজ করেন কমিউনিটি ও হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হিসেবে। অথচ, বহির্বিশ্বে এ দুটি সেক্টরেই কাজ করেন প্রায় ৮০-৯০ ভাগ ফার্মাসিস্ট।

কোনো দেশের ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও নার্সের ঘনত্ব দেখে সে দেশ স্বাস্থ্যসেবার মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। উন্নত দেশ সমূহের মধ্যে জাপান, মাল্টা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্যে ফার্মাসিস্টের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। উত্তর আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) ও ইউরোপের দেশসমূহে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টের অনুপাত প্রায় ৩:১। জাপানে এটি প্রায় ১:১।

বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টের ঘনত্ব প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কারণ, কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট, ক্লিনিক্যাল ফার্মাসিস্ট এবং হসপিটাল ফার্মাসিস্ট মিলিয়ে দেশে ফার্মাসিস্টের সংখ্যা ২০০-৩০০-এর বেশি হবে না। অর্থাৎ, দেশের জনগণ ফার্মাসিস্টের সেবা থেকে প্রায় পুরোপুরি বঞ্চিত। 

রোগীদের ওষুধ সম্পর্কিত সঠিক সেবা দেওয়ার জন্য কমিউনিটি ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশে জনগণকে ওষুধ সম্পর্কিত সব সেবা দেওয়ার জন্য এলাকভিত্তিক লোকসংখ্যার উপর ভিত্তি করে অত্যন্ত পরিকল্পিত ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কমিউনিটি ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রত্যেক কমিউনিটি ফার্মেসিতে এক বা একাধিক গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট, ফার্মাসিস্টের সহকারী হিসেবে ফার্মেসি টেকনিশিয়ান এবং ডিসপেন্সার থাকেন। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা রয়েছে এরকম সব দেশেই কমিউনিটি ফার্মাসিস্টকে ফার্মেসি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হয় এবং ফার্মেসিতে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের জন্য উচ্চমানের প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং সরকারের সাথে সমন্বয় করে অত্র এলাকার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করতে হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২২ হাজার গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মাসিস্ট।

কমিউনিটি ফার্মেসিকে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সবচেয়ে বেশি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন আমেরিকান শিক্ষাবিদ, গবেষক ও ফার্মাসিস্ট উইলিয়াম প্রক্টার জুনিয়র (William Procter Jr.)। তিনি মনে করতেন, ফার্মেসি শুধুমাত্র ওষুধ বিক্রির জায়গা নয় বরং এটি একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, যেখানে জনগণ সঠিক পরামর্শ, নিরাপদ ওষুধ ও স্বাস্থ্য তথ্য পেতে পারে।

তার এ ধারণা পরবর্তী কালে কমিউনিটি ফার্মেসি সেবার মূল দর্শনে রূপ নেয় এবং কমিউনিটি ফার্মেসি একটি পেশাগত সেবা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। ফার্মেসি শিক্ষা ও পেশায় উইলিয়াম প্রক্টর জুনিয়রের অবদানের জন্য তাকে ‘আধুনিক ফার্মেসির জনক’ বলা হয়।

উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা আছে এমন সব দেশেই বর্তমানে একজন কমিউনিটি ফার্মাসিস্টকে যেসব দায়িত্ব পালন করতে হয় তার মধ্যে রয়েছে রোগীর প্রেসক্রিপশন যাচাই ও মূল্যায়ন করা; প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রোগীকে সঠিক ওষুধ সরবরাহ করা; ওষুধের ডোজ, গ্রহণের নিয়ম, সংরক্ষণের নিয়ম ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করা; ওষুধ ক্রয় ও সংরক্ষণ করা, টিকা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা; রোগীর মেডিকেশন ইতিহাস সংরক্ষণ করা; ওষুধের অপব্যবহার রোধে ভূমিকা পালন করা এবং  ফার্মাসিউটিক্যাল সেবা (যেমন- ড্রাগ ড্রাগ ইন্টার‍্যাকশন চিহ্নিতকরণ, ওষুধ সম্পর্কিত সমস্যা সমাধান করা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা, ওষুধ বা ডোজের পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সঠিক ওষুধ সঠিক ডোজে প্রদান নিশ্চিত করা, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন হয় এমন রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, অ্যাজমা রোগীদের বিশেষ সেবা দেওয়া) প্রদান করা ইত্যাদি। এসব দেশে কমিউনিটি ফার্মাসিস্টদের সামাজিক মর্যাদা ও বেতনও অনেক উঁচু। যেমন ইংল্যান্ডে একজন কমিউনিটি ফার্মাসিস্টের বেতন বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার পাউন্ড যা প্রায় ৭০ লাখ টাকা।

বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোগীদের ওষুধের খরচ কমানো, মানসম্পন্ন ওষুধ সঠিক দামে প্রাপ্তি এবং ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সারা দেশে ৭০০ ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছে। প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন (২৩ এপ্রিল ২০২৫) বলছে, প্রস্তাবিত ৭০০ ফার্মেসির ৪২৯টি উপজেলা হাসপাতালে, ৫৯টি জেলা বা সদর হাসপাতালে, ৩৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ২১টির মতো বিশেষায়িত হাসপাতালে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এছাড়া সরকারের অন্যান্য স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ও বড় বড় শহরেও  দোকান বা ঘর ভাড়া করে ফার্মেসি স্থাপন করা হবে।

এ সরকারি ফার্মেসিগুলো প্রতিদিন সবসময় খোলা থাকবে। এসব ফার্মেসিতে প্রয়োজনীয় সব ওষুধ থাকবে এবং  প্রশিক্ষিত ফার্মেসিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী নিবন্ধিত ফার্সাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে এসব ফার্মাসিস্ট চলবে। ফার্মাসিস্টরা ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি ওষুধ ব্যবহারের বিষয়ে রোগীকে পরামর্শ দেবেন বা কাউন্সিলিং করবেন ও ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করবেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে বলা হয়েছে, সরকার শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ফার্মেসি নেটওয়ার্ক এবং থাইল্যান্ডের হসপিটাল ফার্মেসির ব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করবে। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ফার্মেসি নেটওয়ার্ক “রাজ্য ওষুধ সালা” (Rajya Osu Sala) নামে পরিচিত। এ চেইন ফার্মেসিগুলো স্টেট ফার্মাসিউটিক্যালস কর্পোরেশন (SPC) নামক একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়।

রাজ্য ওষুধ সালাগুলো সরাসরি এসপিসি দ্বারা পরিচালিত হয় অথবা লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলে পরিচালিত হয়। সেখানে এসপিসি টেন্ডারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে ওষুধ আমদানি করে বা ক্রয় করে এবং সংগৃহীত ওষুধ সারা দেশে সরবরাহ করে।

শ্রীলঙ্কার উক্ত মডেল বাংলাদেশের ব্যবহার করা খুব সহজ হবে না। মনে রাখতে হবে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ওষুধ তৈরির সক্ষমতা ও ওষুধের বাজার এক নয়। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ, যার নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা, রফতানি ও অভ্যন্তরীণ বিতরণ নেটওয়ার্ক রয়েছে।

বাংলাদেশে ২৮৪টি সক্রিয় ওষুধ কোম্পানি রয়েছে, অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় এবং পাশাপাশি ১৫০টির বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি হয়। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা তার চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করে এবং মাত্র ১৫–২০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়।

শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও ফ্রাঞ্চাইজি মডেলের ব্যক্তিমালিকানাধীন সব ফার্মেসি পরিচালিত হয় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট দ্বারা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট দিয়েও ফার্মাসি পরিচালনা করা হয়।

বাংলাদেশের রপ্তানি করা ওষুধের প্রায় ২০ শতাংশ ওষুধ যায় শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কার স্টেট ফার্মাসিউটিক্যালস কর্পোরেশন বা এসপিসি ৫৩ বছর ধরে ওষুধের আমদানি, ক্রয় ও দেশব্যাপী ফার্মেসিগুলোয় ওষুধ সরবরাহ করার ফলে ব্যক্তিমালিকানাধীন সাপ্লাই চেইন গড়ে উঠেনি যা বাংলাদেশের ঠিক বিপরীত।

তবে, শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও ফ্রাঞ্চাইজি মডেলের ব্যক্তিমালিকানাধীন সব ফার্মেসি পরিচালিত হয় গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট দ্বারা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট দিয়েও ফার্মাসি পরিচালনা করা হয়। অথচ, বাংলাদেশে এটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। দেশে বর্তমানে প্রায় দুই লাখের বেশি ওষুধের দোকান রয়েছে যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক দোকানের কোনো লাইসেন্স নাই। বড় শহরে কিছু মডেল ফার্মেসি ছাড়া কোন ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট, এমনকি ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টও নেই। ভেজাল ও নকল ওষুধে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে।

তাই শুধু, সরকার নিয়ন্ত্রিত ফার্মেসি প্রতিষ্ঠা করলে ও ওষুধ কম দামে বিক্রয় করলেই ফার্মাসিউটিক্যাল সেবার মান বাড়বে তা নয়। এর পাশাপাশি দরকার প্রস্তাবিত সব ফার্মেসিতে আধুনিক কমিউনিটি ফার্মেসির সব সেবা চালু করা, ফার্মাসিস্টদের উন্নত বিশ্বের মতো কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া, নকল ও ভেজাল ওষুধ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। উন্নত বিশ্বের মতো ফার্মাসিস্টদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

ড. মো. আজিজুর রহমান ।। অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ajijur.rubd@gmail.com