ছোটবেলায় বেশ চঞ্চল ছিলেন। তাই দাদা ডাকতেন ‘চঞ্চল’ বলে। পুরো নাম চঞ্চল মাহমুদ। তার জন্ম করাচিতে, বাবার কর্মস্থলে। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার ঝোঁক। ছবি এঁকে বহু পুরস্কারও পেয়েছিলেন। এরপর বাবা বদলি হয়ে চলে গেলেন ইসলামাবাদে। সেই সময় তার ফটোগ্রাফির নেশাও পেয়ে বসে।

প্রতিবেশীদের সবার বাসায় ক্যামেরা। বাবাকে বললেন ক্যামেরা কিনে দিতে। বাবা বললেন, ‘ক্যামেরা ট্যামেরা লাগবে না। ছবি আঁকো।’ অনেক চাপাচাপির পর বাবা তাকে একটা সাধারণ মানের ইয়াশিকা ক্যামেরা আর চারটা কালার ফিল্ম কিনে দিয়ে বললেন আগামী ছয় মাস কিছু পাবে না।

এটা ১৯৬৮ সালের কথা। প্রথম যে ছবি তুলেছিলেন নেগেটিভে তার কিছুই আসেনি। আসবে কীভাবে? তিনি তো তখনো ফিল্ম লোড, শাটার স্পিড, অ্যাপারচার আর এক্সপোজার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। প্রথমে তুলেছিলেন দুটো বেড়াল ছানা ও তাদের মায়ের ছবি।

সেই ফিল্ম ডেভেলপ করতে গিয়েছিলেন ইসলামাবাদের কাবার্ড বাজারের এক স্টুডিওতে। ডেভেলপের পর কাশ্মিরি লোকটি বললেন, ‘কিছুই তো উঠেনি।’ ভদ্রলোক সেদিন তাকে ফিল্ম লোড করা শিখিয়ে দিলেন।

চঞ্চল মাহমুদের সাথে সাহাদাত পারভেজ; ছবি রায়না মাহমুদ

এরপর ল্যান্ডস্কেপ আর ফুলের ছবি তুলে নিয়ে যেতেন সেই কাশ্মিরি ভদ্রলোকের কাছে। ছবি দেখে তিনি প্রশংসা করতেন। পাশের চেয়ারে বসতে দিয়ে কীভাবে ফটোশুট করতে হয় তা দেখার সুযোগ করে দিতেন। বাসা থেকে তখন তাকে ফিল্ম কেনার পয়সা দেওয়া হতো না।

টিফিন না করে আর হেঁটে হেঁটে স্কুলে গিয়ে যে পয়সা বাঁচতো তা দিয়ে ফিল্ম কিনতেন। সেই ফিল্মে তুলতেন স্কুলের স্পোর্টস আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি। ক্লাসে যারা ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হতো, তুলতেন তাদের ছবিও। এই করে করে স্কুলের হেডমিস্ট্রেস আর শিক্ষকদের নজর কাড়েন। এভাবেই আলোকচিত্রের মায়ায় জড়িয়ে পড়েন চঞ্চল মাহমুদ।

বাংলাদেশের মডেল ও ফ্যাশন ফটোগ্রাফির আইকন হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও চঞ্চল মাহমুদের পেশাগত জীবন কিন্তু শুরু হয়েছিল ল্যান্ডস্কেপ আর মানুষের ছবি তোলার মধ্য দিয়ে। এই বিষয়টা এখনকার বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা।

১৯৫৯ সালের ১২ মার্চ জন্ম নেওয়া সেই চঞ্চল মাহমুদ নব্বইয়ের দশকে হয়ে উঠেন বাংলাদেশের তারকাদের তারকা। তাকে ‘তারকাদের তারকা’ বলছি এই কারণে যে, কোনো তারকাই তারকা হতে পারতেন যদি না তার জাদুযন্ত্র-ক্যামেরার সামনে না দাঁড়াতেন।

তারকা ছাড়াও ওই সময়ের তরুণ-তরুণীরা তার কাছে ফটোসেশন করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। বলা যায়, আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের মডেল, ফ্যাশন আর গ্ল্যামার ফটোগ্রাফির যে শিশুকাল চলছিল, তাকে হাত ধরে টেনে যৌবনে নিয়ে গেছেন চঞ্চল মাহমুদ।

আর এভাবেই তিনি এই শিল্পমহলের এক ধ্রুবতারা হয়ে উঠেন। ২০ জুন ২০২৫ রাতে বাংলাদেশের আলোকচিত্রাকাশ থেকে সেই ধ্রুবতারাটি চিরতরে খসে পড়লো। তিনি চলে গেলেন অনাদরে-অবহেলায়, বুকে ব্যথা আর অভিমান নিয়ে। তার এই চলে যাওয়া বাংলাদেশের আলোকচিত্রশিল্পের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।

বাংলাদেশের মডেল ও ফ্যাশন ফটোগ্রাফির আইকন হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও চঞ্চল মাহমুদের পেশাগত জীবন কিন্তু শুরু হয়েছিল ল্যান্ডস্কেপ আর মানুষের ছবি তোলার মধ্য দিয়ে। এই বিষয়টা এখনকার বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা। বহু বছর আগে একান্ত এক আলাপে তিনি আমায় বলেছিলেন তার আলোকচিত্রী হয়ে ওঠার গল্প।

ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় ফিরে তিনি তার গুরুর সন্ধান পান। সেই গুরুর কাছেই ফটোগ্রাফির প্রকৃত দীক্ষা নেন। তার সেই গুরুর নাম মনজুর আলম বেগ, যিনি আলোকচিত্রের আচার্য। তার কাছেই বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি বা বিপিএসের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কথা জানতে পারেন চঞ্চল মাহমুদ।

সাহাদাত পারভেজের ক্যামেরায় চঞ্চল মাহমুদ

এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি পুরোদুস্তর ছবি তুলতে শুরু করেন। বিপিএসের কোনো আউটিং তিনি মিস করতেন না। সেই সময় নরমাল লেন্সে তুলতেন ল্যান্ডস্কেপ আর টেলিফটোতে মানুষের এক্সপ্রেশনস। তার তোলা সেইসব ছবি বিপিএসের মাসিক প্রতিযোগিতার কোনো না কোনো বিভাগে পুরস্কার জিততো। ওই সময় তার পালকে যুক্ত হয় কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও।

চঞ্চল মাহমুদ পড়তেন ঢাকা কলেজে। কিন্তু পড়াশোনায় তার মনোযোগ ছিল না। তাকে সব সময় দেখা যেত ক্যামেরা কাঁধে চারুকলায়। ছেলের এই চালচলন পছন্দ করতেন না তার বাবা। তার বাবা ছিলেন সরকারের যুগ্ম সচিব।

তিনি চাইতেন ছেলে লেখাপড়া শিখে তার মতো বড় সরকারি আমলা হবে। কিন্তু তিনি চাইতেন স্বাধীন জীবন। ছাত্রজীবনেই সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন। জগন্নাথ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ার সময় যুক্ত হন জাসদের রাজনীতির সঙ্গে। ফলে বাবার সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ে। এক সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

ইসলামাবাদে যখন ছিলেন তখন পাশের বাড়ির এক কাশ্মিরি মেয়ের ছবি তুলেছিলেন চঞ্চল মাহমুদ। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। মেয়েটির নাম ছিল বিবি। নিজের ছবি দেখে বিবি খুব খুশি হয়েছিলেন। বিবির ওই খুশিই তাকে মডেল ফটোগ্রাফির দিকে ধাবিত করে কী না, তা জানবার এখন আর কোনো সুযোগ নাই। এখন খুব আফসোস হচ্ছে কেন যে বেঁচে থাকতে সেই প্রশ্ন করলাম না!

১৯৮০ সালে তিনি একটি স্টুডিও করার চিন্তা করেন চঞ্চল মাহমুদ। তিনি স্টুডিওটির নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘টাইম’। পরামর্শ আর আশীর্বাদের জন্য গেলেন গুরুর কাছে। গুরু ‘টাইম’ নামটা কেটে দিলেন। নাম দিলেন ‘চঞ্চল মাহমুদ ফটোগ্রাফি’। চঞ্চল মাহমুদ তার গুরুকে বললেন, ‘আমি এমন কী হয়েছি যে আমার নামে স্টুডিও হবে?’

গুরু বললেন, ‘আপনার স্টুডিও একদিন ব্র্যান্ড হবে, বটগাছ হবে।’ চঞ্চল মাহমুদ বললেন, ‘আমি তো নিজেই বটগাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’ গুরু বললেন, ‘ছোট গাছগুলোই তো একদিন বড় হয়। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি যেদিন থাকবো না, সেইদিন আমার এই কথা আপনার মনে পড়বে।’

এই স্টুডিও করার পর চঞ্চল মাহমুদকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দিন-রাত কাজ করেও তার কাজ শেষ হতো না। তার স্টুডিওতে মডেল, অভিনেতা আর অভিনেত্রীদের ভিড় লেগে থাকতো। দেশের শীর্ষ স্থানীয় প্রায় সব পত্রিকার প্রচ্ছদে-ভেতরে তার তোলা ছবি ছাপা হতো। বিজ্ঞাপন-বিলবোর্ড—সর্বত্রই তার ছবি। আর এভাবেই চঞ্চল মাহমুদ সারা দেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত হয়ে ওঠেন।

সাহাদাত পারভেজ সম্পাদিত ‘ক্যামেরার জাদুকর-চঞ্চল মাহমুদ’

আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ চাইতেন তার ছাত্রদের মাধ্যমে ফটোগ্রাফির শিক্ষাটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুক। ফটোগ্রাফির উন্নতির জন্য তিনি তার গোটা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। স্টুডিওটা চালাতে চালাতে গুরুর ওই বিদ্যাকেন্দ্রিক প্রভাবটা তার ওপর ভর করে।

১৯৯৯ সালে ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ির দোতলায় নিজের স্টুডিওর ভেতর খোলেন ফটোগ্রাফির স্কুল। স্কুলটার নাম রাখেন ‘চঞ্চল মাহমুদ : স্কুল অব ফটোগ্রাফি’। ওই বছরই ওই স্কুলে আমি ফটোগ্রাফির বেসিক শিখেছি চঞ্চল মাহমুদের কাছে। আমি ছিলাম তার পঞ্চম ব্যাচের ছাত্র। আমার আলোকচিত্রী হওয়ার স্বপ্নকালে তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার বাবাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন আমাকে একটা ক্যামেরা কিনে দিতে।

পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে চঞ্চল মাহমুদকে খুব কাছ থেকে জেনেছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের সম্পর্কটা ঠিক ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; আমি তার পরিবারের একজন হতে পেরেছিলাম—এটা আমার সৌভাগ্যই বলা যায়।

এতক্ষণ ধরে যে কথাগুলো লেখার চেষ্টা করলাম সেগুলো তার পেশাগত জীবনের বক্তব্য। এই কথামালার মধ্য দিয়ে ‘মানুষ চঞ্চল মাহমুদ’ চিত্রিত হয়ে উঠেনি। তাকে বোঝার জন্য কিছু ব্যক্তিগত কথা বলা দরকার।

পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে চঞ্চল মাহমুদকে খুব কাছ থেকে জেনেছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের সম্পর্কটা ঠিক ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; আমি তার পরিবারের একজন হতে পেরেছিলাম—এটা আমার সৌভাগ্যই বলা যায়।

চঞ্চল মাহমুদ তার ছাত্রদের ভালোবাসতেন। তার হৃদয়টা ছিল আকাশের মতো বিশাল, ফটোগ্রাফির ভাষায় আমরা যাকে বলি ‘ইনফিনিটি’। অনেক আলাপী মানুষ ছিলেন। কথা না বলে থাকতে পারতেন না। প্রিয়জনদের কাছে পেলে গল্পে-আড্ডায় মেতে উঠতেন।

কথা বলতে বলতে অনেক সময় আবেগী হয়ে উঠতেন, শিশুর মতো কেঁদে ফেলতেন। তার সবচেয়ে বড় গুণ—মানুষকে তিনি সম্মান দিতে জানতেন। প্রিয়জনদের নিমন্ত্রণ দিয়ে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। কাউকে সাহায্য করতে পারলে খুশিতে তার অন্তর-আত্মা ভরে উঠতো। আজ তিনি নেই কিন্তু তার স্মৃতি, কর্ম, জীবন আমাদের সজীব। পরপারে তিনি শান্তিতে থাকুন এই প্রার্থনা সবসময়।

সাহাদাত পারভেজ : আলোকচিত্রী, গবেষক ও শিক্ষক