মতিহার সবুজ চত্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সবুজে ঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই সারি সারি লম্বা লম্বা বিদেশি গাছ। চোখ এড়িয়ে যাওয়া লম্বা পিচ ঢালা পথ (যার নাম প্যারিস রোড বলে পরিচিত) গিয়ে ঠেকেছে শহীদ অধ্যাপক মুহাম্মদ শামসুজ্জোহার সমাধি স্থলে।
তারপর একটা গোল বৃত্ত। এইবার আপনি পথ খুঁজে নেন কোন দিকে যাবেন। উন্মুক্ত চিন্তার জন্য আপনাকেই বেছে নিতে হবে সঠিক পথ কোনটি। ঠিক একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীকটির (লোগো) দিকে দৃষ্টি রাখলে বুঝতে পারবেন এটিও বৃত্তাকারের এবং চারপাশে সূর্যের আলোকরশ্মির রেখা এবং একটি বই, একটি আকাশ। তা হয়তো প্রমাণ করে বিশ্বের প্রতীক।
বিজ্ঞাপন
একটি উন্মুক্ত গ্রন্থ যা জ্ঞানের প্রতীক এবং আকাশদৃষ্টি থেকে শাপলা ফুল সৌন্দর্য, পবিত্রতা ও জাতীয় প্রতীক। এটি সূর্য অর্থেও প্রমাণ ও শক্তির উৎস। প্রতীকের রং বৃত্ত ও মূল গ্রন্থ কোবাল্ট ব্লু। তা হয়তো আকাশ, নদী ও উদারতার রং-এর পরিচয় বহন করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামটির মূল নকশা করেন গোলাম সারওয়ার, পরবর্তীতে কিছুটা পরিবর্তন আনেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং শিল্পী হাশেম খান।
গ্রন্থের বাইরের রেখা রক্তলাল, জাতীয় পতাকার রং যেমন হয়। গ্রন্থের মধ্যরেখা সোনালী, সোনার মতোই মূল্যবান শিক্ষার গুণগত মূল্য। ১৯৫৩ সালে ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সময় গড়াতে গড়াতে আজ এই সময়ে এসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখনো।
বিজ্ঞাপন
রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ইতিহাসে বিবর্তনে, বয়সের অভিজ্ঞতায় আগামী প্রজন্মকে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু আমাদের শোনার সময় নেই। এখানে একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা বলি, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করি তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামটি কে করেছিল, মানে লোগোর নকশা কে করেছিল বলতে পারো?
শিক্ষার্থী উত্তর করতে পারলেন না। শেষে আমাকেই বলতে হলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামটির মূল নকশা করেন গোলাম সারওয়ার, পরবর্তীতে কিছুটা পরিবর্তন আনেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং শিল্পী হাশেম খান। আমাদের জানার অনেক কিছু আছে কিন্তু জানি না কিছুই।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়টি ঝাঁকড়া সবুজ, সময়ের আন্দোলনের প্রতীক মাথা উঁচু করে আছে। এবার তেমন উৎসব নেই, তবে বিশ্ববিদ্যালয়কে আলোকিত করার জন্য রঙিন বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার মতো তেমন কোনো সংগঠনের প্রস্তুতি এখনো পর্যন্ত চোখে পড়লো না।
আমার জানামতে, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে। কিন্তু সেখানেও কোনো আলোচনা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না। শুধু র্যালির আয়োজন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে (৬ জুলাই ২০২৫ আশুরা থাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছে না) বর্তমানে সাংস্কৃতিক চর্চা অনেকটাই স্তিমিত।
সংগঠনের প্রধানদের ভাষ্য, সেমিস্টারের নিয়মে পড়ালেখার পরে আমরা কোনো শিক্ষার্থীর তেমন একটা পাচ্ছি না, তাছাড়া আগ্রহ অনেকটাই কম। আগ্রহ কমারই কথা, যেখানে রাকশু ভবন থাকা সত্ত্বেও রাকশুর কার্যক্রম নেই, বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক দল গুলো নিজের অর্থ দিয়ে চলতে হয়, সেখানে সাংস্কৃতিক চর্চা বর্তমানে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই মনে করছে না।
আরও পড়ুন
যেখানে হাতের মুঠোতে, মুঠোফোনে পৃথিবী আবদ্ধ সেখানে চার পাঁচ ঘণ্টা মহড়া কক্ষে বসে নাটকের সংলাপ, কবিতা পাঠ, গানের লাইন মুখস্থ করার কী দরকার? এমনটাই হালহকিকত। তবু বেঁচে থাকে সংস্কৃতি। কেউ কেউ মনের টানে অল্প সময়ের জন্য দলের সদস্য হন। আলোচনা হয় আগামীতে আমাদের সংস্কৃতি চর্চা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন নেই, কোনো উৎসব নেই, নেই কোনো সাহিত্য আড্ডা। এখন মাঝেমধ্যে বিতর্কের কিছু দল আছে, নাটকের দল, গানের দল তারাই মাঝেমধ্যে বসছে, (যাদের দূর থেকে আমরা পাগল বলি) সেই পাগলা শিক্ষার্থীরা কারও সাত-পাঁচে নেই তারাই ক্যাম্পাসের চত্বরে আম গাছের নিচে, পড়ন্ত বিকেল থেকে সন্ধ্যায় গলা ছেড়ে ঢোল- করতাল, হারমোনিয়াম নিয়ে গান ধরে। এমনি করে বেঁচে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক অঙ্গ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের মধ্যে নাট্যকলা বিভাগ, সংগীত বিভাগ থাকলেও তারা শুধু বিভাগের কারিকুলাম এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কালেভদ্রে দেখা যায় বহিরঙ্গে দু-একটা অনুষ্ঠান করতে। যে অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু আগামী প্রজন্মকে কতটুকু রিপ্রেজেন্ট করে তা ভাবার বিষয়।
...সংস্কৃতি চর্চায় ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিদ্রোহ, হত্যা, পাশবিক-বর্বরতা, স্বদেশের কথা উঠে এসেছে বারবার। এর সাথেই পথ চলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রজন্মের আর দোষ কোথায় রাষ্ট্র কাঠামো, রাজনৈতিক কাঠামো যখন পাল্টে যায়, তখন ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে, তার পথ খুঁজে নিতে দাঁড়াতে হয় একটা বৃত্তের মধ্যে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনের সামনে বৃত্ত আকারের মধ্যে শহীদ অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা চিরনিদ্রায় আছেন। যে বৃত্ত থেকে শুরু হয় জীবনের বেঁচে থাকার লড়াই। সাহিত্যশাসিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কতটুকু স্বাধীন তার মাপকাঠি আমাদের হাতের বাইরে।
বাংলাদেশ ভৌগলিক সীমারেখার খণ্ডিত অংশ এবং বাংলাদেশে 'কাব্য', 'নাটক' খণ্ডিত ভূখণ্ডের একটি কাব্যিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরি। বাংলাদেশের ভূখণ্ডটি খণ্ডিত হয়েও একক, স্বাধীন। বাংলাদেশের সংস্কৃতির চেহারার আদল পাল্টেছে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে। সাহিত্য সংস্কৃতির স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা।
রাজনীতিই বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা সার্বভৌম রাষ্ট্র দিয়েছে, স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। রাজনীতিই সংস্কৃতিকে আলাদা করেছে। সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত আবার একাত্তর থেকে আজ অবধি বাংলাদেশের সংস্কৃতির চেহারা আমূল পাল্টেছে। সংস্কৃতি চর্চায় ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিদ্রোহ, হত্যা, পাশবিক-বর্বরতা, স্বদেশের কথা উঠে এসেছে বারবার। এর সাথেই পথ চলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের গর্বের বিষয় এখান থেকে হাজারও শিক্ষার্থীরা পাঠদান শেষ করে রাষ্ট্রের মূল্যবান স্থানে বসে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। কিন্তু তারা কি একবারও মনে করতে পারছেন না তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বছরে মেঘে ঢাকা, ঝড় বৃষ্টির মধ্যে রোদে পুড়ে পুড়ে পথ চেয়ে বসে আছে তাদেরই জন্যে।
শুধু শিক্ষার্থী নয়, যেকোনো প্রাক্তনী এসে দেখিয়ে দিক নতুন প্রজন্মকে—সবুজ মতিহার চত্বরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিয় বিদ্যাপীঠ, যে বিদ্যাপীঠ কোনো বাধাকে স্বীকার করে না। অন্যায়ের প্রতিবাদে সব সময় প্রতিবাদ মুখর।
ড. আরিফ হায়দার : অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়