রমিজের হ্রস্বদৃষ্টিতে ব্যাটারি রিকশা
‘চোখে দেখেন না?, আপনের সামনেইত আছে!’ দারোয়ানের এমন বকা খেয়ে রমিজ মিয়া অবাক হয়নি কারণ রিকশা চালকদের অ্যান্টিবায়োটিকের মতো নিয়মিত বকা খেতে হয় বরং সে অবাক হয়েছে তার সামনেই রাখা জিনিসটা দেখে।
প্রায় ১০/১২ দিন আগে মাঝরাতে লোডশেডিং এর কারণে গরমে ঘুম ভেঙে যখন দেখল তার গ্যারেজের নিচে রাখা প্রায় ২০টা রিকশার ব্যাটারি চার্জ হচ্ছে আর সে সারাদিন গরমে রিকশার প্যাডেল ঠেলে এসে শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারছে না, তখন মেজাজটাও গরম হয়ে গিয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
তার আশেপাশে আরও কয়েকটা রিকশার গ্যারেজের মতো তার মহাজনও সামনের রাস্তার সরকারি বিদ্যুতের লাইন থেকে কানেকশন নিয়ে ব্যাটারি চার্জের পাকা ব্যবস্থা করেছে। প্রতিটা গ্যারেজেই দিনরাত চার্জ দেওয়া চলছে। এই অন্ধকারে ব্যাটারির চার্জ এর লাল ছোট বাতির দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়েছিল যেভাবে এই ব্যাটারি রিকশা মহামারির মতো বাড়ছে তাতে করে রাস্তায় কয়েকদিন পর কেউ চলতে পারবে না।
শুধু তাই না, যে পরিমাণ বিদ্যুৎ অবৈধ লাইনে খরচ হচ্ছে তাতে করে লোডশেডিং আরও বাড়বে। কয়েকদিন আগে সে শুনেছিল যে সরকার নাকি বড় বড় স্যারদের দিয়ে রিকশার একটা নিরাপদ ডিজাইন বানাচ্ছে আর তার জন্য নাকি চালকদের ট্রেনিংও দেবে। তাই সেই রাতেই রমিজ মিয়া ভেবে রেখেছিল যে, একবার সুযোগ পেলে স্যারদের বানানো রিকশা দেখে আসবে আর মনে মনে এমন একটা রিকশা কেনার পরিকল্পনাও সে করে রেখেছে।
বিজ্ঞাপন
আজকে সে যাত্রী নিয়ে এসেছিল কাছেই, তাই যাত্রী নামিয়ে এখানে এসেছে নতুন ডিজাইনের রিকশা দেখার জন্য। এখানে এসে সে দুই একজনকে জিজ্ঞেস করে। ভবনের সামনে এসে আশেপাশে কোনো রিকশা না দেখে সাহস করে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করাতে, দারোয়ান বিরক্তি মুখে পাশেই রাখা ৩ চাকার সিএনজি অটো রিকশার মতো দেখতে একটা জিনিসের দিকে ইশারা করে, আর তার চোখের দৃষ্টিশক্তি কম এটা জানিয়ে চলে গেল। এরপর প্রায় ১ ঘণ্টা রমিজ মিয়া সেখানে ছিল, এরমধ্যে কয়েকজন সাংবাদিকও এসেছিল জিনিসটা দেখার জন্য। সবার আলোচনা শুনে ফেরার পথে তার মাথায় কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরতে লাগল।
প্রথমত, এই রিকশা নাকি ব্যাটারি দিয়েই চলবে। তারমানে বিদ্যুৎ অপচয় আর লোডশেডিং। এত বড় বড় স্যাররা গবেষণা করে যদি আবার ব্যাটারি সিস্টেমেই রিকশা ডিজাইন করে তাহলে লাভ কী। কারণ এই ব্যাটারি চার্জ দিতে বিদ্যুৎ লাগবে আর এটা হলে বিদ্যুৎ চুরি হবেই।
কেউ যদি ভাবে যে অভিযান করে এগুলো বন্ধ হবে তাহলে সে বোকা, কারণ তার গ্যারেজেই সে দেখছে কী হয়। তাছাড়া অনেক কারখানা, অফিস, বাড়ির লাইন চেক করলেও দেখা যাবে যে, লাইন অবৈধ কিন্তু বছরের পর বছর চলছে। এগুলো অভিযান করে বন্ধ হবে না আর অভিযান যিনি করবেন তাকে ম্যানেজ করা যাবে না সেই গ্যারান্টি নেই।
আচ্ছা, বিদ্যুৎ নির্ভরতা এড়ানোর অন্য কোনো উপায় কি ছিল না? কিছুদিন আগে সে তার ছেলের জন্য একটা খেলনা গাড়ি কিনছিল যেটা একটু চাপ দিয়া ছাড়লেই অনেক দূর চলে। একটা খেলনা যদি ব্যাটারি ছাড়াই খালি চাপ দিয়ে অনেকদূর চালানো যায় তাহলে বড় বড় স্যাররা এমন কোনো বুদ্ধি দিতে পারত না, যেটা বিদ্যুৎ ছাড়াই চলবে এবং একই সাথে চালকের প্যাডেল চালানোর কষ্টও কমে যাবে। গবেষণা মানে সে এতদিন জানতো নতুন জিনিস তৈরি কিন্তু এমন রিকশা তো তার গ্যারেজের পাশেই সোহেল কারিগর প্রায়ই অর্ডার নিয়ে বানায়।
দ্বিতীয়ত, এই রিকশার নাকি সর্বোচ্চ গতি ৩০ কিমি/ঘণ্টা। এটা তার কাছে বিপদজনক মনে হচ্ছে কারণ সে একজনচালক হিসেবে জানে রাস্তায় কী হয়। এ বাহনগুলার বিপদ হচ্ছে, চালকরা থেমে থাকা বা চলন্ত অবস্থা থেকে আচমকা ডানে বা বামে আসে। যেহেতু ৩ চাকা, তাই সামনের চাকা আচমকা ঠেলে দিয়েই এরা আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটাবে নিশ্চিত।
তার চোখের সামনে সে অনেকবার দেখছে কীভাবে আচমকা ডানে-বামে ঘুরে একটা আরেকটার সাথে ধাক্কা দেয়। তাছাড়া এ রিকশা নাকি চলবে গলির রাস্তায়। তাই গলির রাস্তায় এত স্পিড দিয়ে কী হবে এটা তার মাথায় ঢুকে না। আর রাতের বেলা এরা মূল সড়কে চলে আসবে না এই গ্যারান্টি কে দেবে?
এই গতির একটা ৩ চাক্কার রিকশা, যেটা সুযোগ পেলেই ডানে-বামে যায়, সেটা যে বিপদজনক হবে এটা সে ভালোই বুঝতে পারছে। এর ব্রেকিং সিস্টেম ভালো, ৩ চাকায় হাইড্রলিক ব্রেক। কিন্তু সে ভাবছে অন্য কথা, ৩০ কিমি/ঘণ্টা চালানোর সময় যদি চালক ব্রেক করে তাহলে না আবার উল্টে যায়, বিশেষ করে মোড় ঘোরার সময়।
তাছাড়া এই রিকশা চলতে চলতে যখন চাকা পুরোনো হয়ে যাবে তখন ব্রেক করলে চাকা যদি স্লিপ কাটে তাহলেও তো সমস্যা। আচ্ছা এই রিকশা কি এমনভাবে বানানো যেত না যেন চাইলেও এর গতি ১৫ থেকে ২০ কিমি/ঘণ্টা এর বেশি বাড়ানো না যায়? তাহলে সমস্যাগুলা অনেকটুকুই এড়ানো যেত বলে তার মনে হচ্ছে।
তৃতীয়ত, তার মতো অনেক চালকের ইচ্ছা আছে এমন একটা রিকশা কেনার। কিন্তু আজ শুনল এই রিকশার দাম নাকি পড়বে প্রায় ১.৫ লাখ থেকে ২ লাখ টাকা। এই দাম বর্তমান ব্যাটারি রিকশার দামের ২ গুণের বেশি যা তার মতো রিকশাচালকদের নাগালের বাইরে। এই বাহনটি প্রস্তাবের বড় কারণ হচ্ছে বর্তমানে প্রচলিত বাহনগুলো থেকে শিফট করে এই মডেলে নিয়ে আসা।
আরও পড়ুন
এ কাজটি ২ ভাবে করা যায়। প্রথমত সরকার চাইলে পুলিশ দিয়ে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে আর দ্বিতীয়ত মানুষ (চালক বা মালিক) নিজেরাই বর্তমানের চেয়ে ভালো অপশন হিসেবে এই মডেলের রিকশায় শিফট করতে পারে।
প্রথম বিষয়টি জটিল এবং আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে তা ফলপ্রসূ হয়নি। বরং তারমতে এতে করে পুলিশ আর রিকশাচালকদের মুখোমুখি করে দেওয়া হবে। কিন্তু যদি এই নতুন ডিজাইনের রিকশার দাম বর্তমানের চেয়ে কম থাকে তাহলে এমনিতেই মালিক-চালক এই রিকশা কিনবে।
কোনো জিনিসের দাম বেশি হলে তার কোয়ালিটি ভালো হবে এটা সবাই জানে, কিন্তু যেহেতু প্রায় ৪ বছর গবেষণা করে একটি মডেল তৈরি করা হয়েছে সেহেতু তা যদি বর্তমানে বাজারদরের চেয়ে কমদামে করা যেত তাহলে গবেষণায় নতুনত্ব আসত।
পাশাপাশি মানুষ (চালক/মালিক) নিজেরাই এই মডেলটি সাগ্রহে গ্রহণ করত। তাই স্যাররা এই মডেলটির গুনাগুণ ঠিক রেখে দাম কমানো যায় কিনা সেটি বিবেচনা করতে পারে। রিকশা চালালেও রমিজ মিয়া বুঝে যে, দিন দিন গবেষণা করে মানুষ জিনিসপত্রের দাম কমায় কিন্তু এর ক্ষেত্রে উল্টো দাম বেড়ে গেল।
আরেকটা ব্যাপার রমিজ মিয়ার কাছে বড় মনে হয়, এই মডেলটা কেমন জানি আবদ্ধ খাঁচার মতো। এই শহরে সে আজ প্রায় এক যুগ রিকশা চালায় তাই সে জানে যে, যাত্রী যেমন রোদ দেখলে হুড তুলে দেয় আবার বৃষ্টি দেখলে শখ করে হুড ফেলে ভিজে। এইটাই তো রিকশার মজা, রিকশার ঐতিহ্য।
রমিজ মিয়ার মতে নতুন এই ডিজাইনের ফলে আমাদের চিরাচরিত রিকশার যে খোলামেলা বৈশিষ্ট্য তা থাকছে না। চালক ও যাত্রীর মাথার উপরে শেডের ব্যবস্থা করে সেটা ফিক্সড না করে এখনকার মতো ফ্লেক্সিবল রাখলে যাত্রী সিদ্ধান্ত নিতে পারত যে রোদে/বৃষ্টি/বাতাসের সময় তারা কীভাবে উপভোগ করবে। তার রিকশায় কদমফুল হাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অনেক যাত্রীর আবেগ-ভালোবাসা সে বয়ে নিয়ে গেছে। সে চায় এই আবেগ থাকুক। আর কোনো দেশে কি এভাবে কেউ রিকশায় বৃষ্টিবিলাস করতে পারে?
রমিজ মিয়ার ভাবনায় ছেদ পড়ল আরেক যাত্রীর ডাকে। তার রোদ-বৃষ্টি ভেজা পরিশ্রমের এই জীবনে এসব ভাবনা একটা বিলাসিতা। আবার কবে সে এসব ভাবনার সময় পাবে কেউ জানে না। রমিজ মিয়ারা চোখের সামনের জিনিস না দেখলে বকা খায় কিন্তু আমরা তো চোখে দেখি, আমরা তো ভাবতে পারি।
কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ : সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট